ওমা, ডাক্তার কই? এ তো মেয়ে গো
জি বাংলায় একটি সিরিয়ালের বিজ্ঞাপন আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। যদিও সিরিয়ালের মাধ্যমে অতীতের কোনো বিশেষ মুহূর্তকে আমাদের সামনে তুলে ধরতে চাওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপনটি এমন: বাড়ির আদরের সন্তান অসুস্থ। অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার গাড়িতে চড়ে আসছেন। ডাক্তারের গাড়িটি বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই কয়েকজন বলে উঠল, ‘ডাক্তার এসে গেছে গো।’ কিন্তু গাড়ির ভেতর একজন নারী চোখে পড়তে সবাই একযোগে বলে উঠল, ‘ওমা, ডাক্তার কই? এ তো মেয়ে গো!’ কথাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ভাবিয়ে তোলে।
তখনকার সময়ে ডাক্তার বলতে পুরুষ মানুষকেই বোঝাত। ডাক্তার হিসেবে নারীদের সেথায় সমাজ কোনোকালে বিবেচনায় নেয়নি। সেই সমাজের সঙ্গে অসমভাবে লড়ে নিজেকে ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারা শুধু কঠিন নয়, কষ্টসাধ্য ব্যাপারও বটে। সে অসাধ্য কাজটুকু পূর্ণ করে দেখিয়েছেন যে নারী, তিনি হলেন ‘কাদম্বিনী বসু’। শিক্ষাক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি কাদম্বিনী সমকক্ষতা লাভে উদ্যমী হন। কাদম্বিনীর জন্ম সেই সময়ে, যখন বাংলার লোক মেনে নিল মেয়েদের লেখাপড়া মনে হয় আর ঠেকানো গেল না। কাদম্বিনী প্রমাণ করলেন, নারী মনোবিকারে স্তব্ধ হয়ে গেলেও জেগে উঠতে পারেন। দাঁড়ানোর শত চেষ্টায় সমাজে এগিয়ে চলে। সংসারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে কখনো অন্দরে, কখনো ঘরের বাইরে তাঁদের বিচরণের আঙিনা। স্নিগ্ধতার মিশেলে বেড়ে উঠে জগৎকে আপন করে নিতে জানেন।
সেই সময় কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখী বসু অনেক বাধা ডিঙিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। যদিও তখনকার সময়ে নারীদের পাঠ চলত অন্দরমহলে। পড়াশোনা চলত ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও কলাবিদ্যার মতো বিষয়ে। তারপরও কাদম্বিনী মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পেশা সম্পন্ন করেন। মূলত, তাঁদের হাত ধরেই সমাজে মেয়েদের শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়।
ঔপনিবেশিক যুগে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে স্ত্রীশিক্ষারও প্রসার ঘটে। উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব পড়লে নারীশিক্ষার পথ আরও সুগম হয়। বদলে যায় নারীশিক্ষার চরিত্র। তখন থেকেই শুরু হয় নারীর শৃঙ্খল মোচনের অধ্যায়। তবে শৃঙ্খলমুক্তি সম্ভব হয়েছিল কয়েকজনের হাত ধরেই। সেই অন্দরমহলের দ্যুতি বাইরের জগতে ছড়িয়ে দিতে যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁরা হলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখ। নারীমুক্তি আন্দোলনের নিমিত্তে রাজা রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষার ভালো দিকগুলো সমাজে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে দীর্ঘদিন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। সে উদ্দেশ্যেই ১৮৫৭ সাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় ৩৫টি বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যা নারীশিক্ষা প্রসারে অনন্য ভূমিকা পালন করে। তা ছাড়া কৈলাস বাসিনী দেবী, বামা সুন্দরী দেবী, কামিনী সুন্দরী দেবী নারীশিক্ষা প্রসারে গিয়ে আসেন।
তখনকার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের নারীদেরও স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলনে ব্রতী হতে দেখা যায়। ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী, সাহিত্যে যাঁর সর্বক্ষেত্রে বিচরণ বলা চলে। তিনি প্রায় এক যুগ ধরে ভারতী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ফলে, বাংলা সাহিত্যের মননশীলতায় নারীদের যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি নারীরা সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। নারীশক্তির প্রতিভা স্ফুরণ ঘটে বিভিন্ন সাহিত্যের কর্মকাণ্ডের চেতনায়। স্বদেশপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম এবং আবেগের মিশেলে অনিন্দ্য সাহিত্য রচনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন সেকেলের নারীরা। ফলে, নারীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্র আরও গতিময় হয়ে ওঠে। যার ফলে সমাজে মূল্যবোধের আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
অন্যদিকে, নারীশিক্ষার মাধ্যমে সমাজকে বিকশিত করতে চেয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। সে উদ্দেশ্যে ১৯০১ সাল স্বামীর মৃত্যুর পর একটি বালিকা বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজে অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে নারীশিক্ষায় ব্রতী হন। তাঁর অসামান্য দূরদৃষ্টি দেখতে পাই তাঁর লেখা সাহিত্যের ভেতর দিয়ে। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গ্রন্থে নারীকে বিজ্ঞানমনস্কতার মধ্যে টেনে নিয়ে এসেছেন। সেখানে নারীকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন।
তারই ধারাবাহিকতায়, বর্তমান সমাজে আমাদের নারীদের আলোকিত জীবন বাঁকে খুঁজে পাই। আজকের সমাজের নারীরা অন্দরে বসে থাকেন না। নিজেরাই নিজেদের প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে চলেন। তাই আমরা সহস্র কাদম্বিনীকে অন্তর থেকে মূল্যায়ন করতে শিখি। হাজারো ইতিহাস থেকে উৎসারিত হবেন দ্যুতি ছড়ানো কাদম্বিনীর মতো নারীরা। স্বপ্ন দেখি আমাদের সমাজের নারীরা বীরদর্পে এগিয়ে যাবেন। নিজের স্থানটুকু ধরে রাখতে লড়ে যাবেন। অধিকার আদায়ে সর্বদা তৎপর থাকবেন। তাঁরাও ভালো কিছু গড়তে জানেন, আমাদের উন্নয়নে এগিয়ে চলেন। স্নিগ্ধ পরশে আঁচলখানি বিছিয়ে দেশের তরে কাজ করেন।
সংসারের প্রতিটি কাজের নিদর্শনে থাকে নারীদের শৈল্পিক ছোঁয়া। অর্ধেক আকাশে তাঁদের কল্পনা করি। সে অর্ধেক আকাশটুকুতেই থেকে যায় চাওয়া-পাওয়ার সম্ভার। নারী; শিল্পিত মনে কখনো সাজিয়ে তোলেন, আবার নিজগুণে কখনো গুণান্বিত হয়ে থাকেন। ঐতিহ্য ধরে রাখা যে ঐতিহ্যের ছোঁয়া। কল্পিত মনে একে যায় রঙিন ছবি। পটে থাকে ভালোবাসার দ্যোতনা। সবকিছু সামলে নারীর দৃপ্ত পথচলা। বন্ধুরতার পথকে সামলে নিয়ে এগিয়ে চলে। স্নিগ্ধ আবেশে যাঁদের মূল জগৎটাই হয়ে উঠে ভালোবাসার সঞ্জীবনী শক্তি।
*লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক
*নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]-এ