ঐন্দ্রিলা এবং খাসি বাহিনীর কল্পকথা
বহুদিন আগের কথা। ভারতবর্ষে তখনো মধ্য এশিয়ার আর্যরা আসেনি। সমাজে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ তখনো চালু হয়নি। জাতিভেদ ও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কিংবা রাজায় রাজায় যুদ্ধ ইত্যাদি তখনো মানুষের সমাজে কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি। ঠিক সেই সময় সমগ্র ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেগুলোর মধ্যে মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা সভ্যতার কথা তামাম দুনিয়ায় মশহুর হয়ে আছে। ধারণা করা হয়, সেই যুগে ভারতবর্ষে মূলত মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল। সমাজ-সংসার-রাষ্ট্র সর্বত্রই নারীদের প্রাধান্য ছিল। তারা ইচ্ছেমতো বহু পুরুষকে একসঙ্গে বিয়ে করত এবং মেজাজ গরম হলে স্বামীদের নির্মম কায়দায় নির্যাতন করত; ক্ষেত্রবিশেষে মেরে ফেলত। এ কাজের জন্য তাদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হতো না কিংবা নিন্দিত হতে হতো না। বরং নারীদের পুরুষ নির্যাতনের ক্ষমতার ওপরই তাঁদের প্রভাব, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা ও বৈভব নির্ভর করত।
নারীযুগের উল্লিখিত কাহিনি নিয়ে দেশ-বিদেশে বহু বইপত্র রচিত হয়েছে। এসব বইয়ের মধ্যে পাক–ভারতে একটি বই খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বইটির নাম ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’। রাহুল সাংকৃত্যায়ন রচিত ২০টি ছোটগল্পের সংকলন যখন ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ নামে প্রকাশিত হলো, তখন কেবল ভারত নয়, পুরো দুনিয়াতেই বিতর্কের ঝড় উঠল। দশমুখে রাহুলের সমালোচনা শুরু হলেও তাঁর বইয়ে উল্লিখিত বিষয়বস্তুর সত্যতা নিয়ে কেউ পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেননি। ফলে আলোচ্য বইয়ের কাহিনিগুলো নেহাত গল্প হলেও সেসব গল্পের ইতিকথা অনেকটা ঐতিহাসিক মর্যাদা পেয়ে গেছে। আমার আজকের শিরোনামের নায়িকা ঐন্দ্রিলা এবং খাসি বাহিনীর গল্প লেখার জন্য ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ বইটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি।
আজকের দিনে আমরা যেটিকে ভারতের বিহার রাজ্য বলে জানি, সেটিকে এককালে বলা হতো ‘লালুয়াদারু’। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানেও মাতৃতান্ত্রিক সমাজের দাপট ছিল প্রবল। তবে অন্যান্য এলাকা থেকে লালুয়াদারু আলাদা ছিল কতগুলো বৈশিষ্ট্যের কারণে। সারা ভারতে যখন পঞ্চায়েতব্যবস্থা চালু ছিল এবং গণতান্ত্রিকভাবে নারীরা পঞ্চায়েতের প্রধান হতেন, তখন লালুয়াদারুতে এক দুর্ধর্ষ নারীর আবির্ভাব ঘটল; যাঁর নাম ঐন্দ্রিলা। তিনি অত্যন্ত সুকৌশলে প্রথমে চিরাচরিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পঞ্চায়েতপ্রধান নিযুক্ত হলেন। তখনকার রীতি অনুযায়ী কেবল নারীরাই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারতেন। পুরুষেরা সেকালে নারীদের বিনোদন সঙ্গী, ভারবাহী এবং সংসারের ফুটফরমাশ খাটা ছাড়া তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেন না। তারা ভোট দেওয়া তো দূরের কথা, ভোটসংক্রান্ত কোনো আলোচনার ধারেকাছেও ভিড়তে পারতেন না।
যে সময়ের কথা বলছি, সেটি যে কত হাজার বছর আগের ঘটনা, তা বলতে পারব না। তবে ঘটনাটি মহাভারত যুগের বহু আগের, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ, মহাভারতের যুদ্ধের কয়েক শত বছর আগেই ভারতবর্ষে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল এবং শাসনকার্যে পুরুষেরা প্রাধান্য লাভ করেছিলেন। যুদ্ধ, পশু শিকার, সমুদ্রযাত্রা এবং বৈদেশিক বাণিজ্য চালু হওয়ার কয়েক শত বছর আগে কীভাবে নারীদের কর্তৃত্ব থেকে বের হয়ে পুরুষেরা সব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা লালুয়াদারুর ঐন্দ্রিলার গল্পের মাধ্যমে আপনারা আন্দাজ করতে পারবেন।
ঐন্দ্রিলা যখন সমাজপত্নী নির্বাচিত হলেন, তখন অন্যান্য নেত্রীর মতো তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। কারণ, তাঁর বোন চন্দ্রিলার অপরূপ সৌন্দর্য এবং তাঁকে কেন্দ্র করে পুরুষদের আকর্ষণ ঐন্দ্রিলার মনে সর্বদা ঈর্ষার আগুন জ্বালিয়ে রাখত। ফলে তিনি যেকোনো মূল্যে চন্দ্রিলাকে সরিয়ে দিতে চাইলেন এবং সুযোগ বুঝে এক রাতে চন্দ্রিলাকে হত্যা করে ফেললেন। ঘটনাটি সমাজে নিদারুণ অস্থিরতা সৃষ্টি করল। ঐন্দ্রিলার গোত্রের নারীরা বিদ্রোহ করল এবং আশপাশের অন্যান্য পঞ্চায়েতও ঐন্দ্রিলার বিচার দাবি করল। এ অবস্থায় ঐন্দ্রিলা তাঁর কয়েক শত স্বামী-সন্তান এবং পুরুষ সেবক নিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন।
জঙ্গলে থেকে ঐন্দ্রিলার মধ্যে জঙ্গি স্বভাবগুলো প্রকট হয়ে উঠল। পশুদের যৌনাচার, শিকারপদ্ধতি এবং নিষ্ঠুরতা দেখতে দেখতে তাঁর মধ্যে অদ্ভুত সব পরিকল্পনা বাসা বাঁধতে আরম্ভ করল। তিনি তাঁর দলের লোকদের পশুর মতো জোর করে অন্যের জীবন-সম্পত্তি হরণ এবং নারী ধর্ষণের ব্যাপারে মগজ ধোলাই শুরু করলেন। তাঁর অনুগত পুরুষেরা নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনতা কিংবা নারীর অমতে তার দিকে তাকানোর কথা তখনো কল্পনা করতে শেখেনি। অন্য দিকে, অন্যের সম্পদ হরণ, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি মনুষ্য সমাজে তখনো চালু হয়নি। নারী-পুরুষ কেউই সেকালে এমন চিন্তা করতে শেখেনি; কিন্তু ঐন্দ্রিলার প্ররোচনায় তাঁর দলের পুরুষেরা জঙ্গি পশুদের অনুকরণে যখন লোকালয়ে রাতের আঁধারে হানা দিতে আরম্ভ করেন, তখন পুরো লালুয়াদারু অঞ্চল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।
ঐন্দ্রিলা তাঁর দলের পুরুষদের ধর্ষণ করা শেখান এবং ধর্ষণের পাশবিক আনন্দের খবর অত্যন্ত সুকৌশলে লোকালয়ে অবস্থিত পুরুষদের কর্ণকুহরে পৌঁছে দেন। ফলে দলে দলে লোভী এবং ধর্ষণকামী পুরুষেরা লোকালয় ত্যাগ করে জঙ্গলে এসে ঐন্দ্রিলার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ঐন্দ্রিলা বিশাল এক ধর্ষকবাহিনী গড়ে তুললেন এবং পুরো লোকালয়ের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে জঙ্গল থেকে বের হয়ে মানুষের ওপর জঙ্গি আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। তিনি প্রথমে তাঁর নিজ পঞ্চায়েত কবজা করলেন এবং আস্তে আস্তে পুরো লালুয়াদারুতে ধর্ষকদের রাজত্ব কায়েম করে ফেললেন। ফলে কয়েক শত পঞ্চায়েতের সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার নারী নেত্রী ক্ষমতা হারিয়ে ধর্ষকদের প্রমোদসঙ্গী অথবা দাসীতে পরিণত হলো এবং সারা দেশে একমাত্র সম্রাজ্ঞীরূপে অভিষেক হলো ঐন্দ্রিলার।
নতুন সাম্রাজ্যে ঐন্দ্রিলার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, প্রাচীন পঞ্চায়েতপ্রথার মতো ন্যায়বিচার, সুশাসন এবং সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে পড়ল। পুরো লালুয়াদারু অঞ্চলটি হয়ে গেল অস্ত্রধারী ডাকাত এবং ধর্ষকদের রাজ্য। তারা সাধারণ নর–নারীকে দাস–দাসি বানিয়ে ফেলে এবং নিজেদের পাশবিক আচরণ ও লালসা দ্বারা পুরো অঞ্চলকে জঙ্গলের চেয়ে ভয়ংকর বানিয়ে ফেলে। সাধারণ মানুষ ধন-সম্পদ হারাল, ইজ্জত হারাল এবং বাকস্বাধীনতা হারিয়ে একটি বোবা, অনুভূতিহীন বেকুব জাতিতে পরিণত হলো। ধর্ষিত হওয়া, নির্যাতিত হওয়া এবং বেঘোরে প্রাণ হারানো এতটা স্বাভাবিক ও নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়াল যে ঐন্দ্রিলার রাজত্বে কোনো নির্মমতা, কোনো হত্যাকাণ্ড কিংবা কোনো ধর্ষণ বা ডাকাতির দৃশ্য দেখে ‘উহ্’ শব্দটি উচ্চারণ করার মতো প্রাণী পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যেত না। অধিকন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে, ঐন্দ্রিলা বাহিনীর কুকর্ম দেখে তালি বাজানো, উল্লাস প্রকাশ করা এবং প্রশংসাসূচক কবিতা রচনার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।
এ অবস্থায় ঐন্দ্রিলা প্রথম প্রথম বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর সুখ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। কারণ, ডাকাত-লুটেরা এবং ধর্ষকেরা নিজেদের মধ্যে প্রচণ্ড মারদাঙ্গা শুরু করল লুটের মালের ভাগ–বাটোয়ারা এবং ভোগবিলাস নিয়ে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো, ধর্ষকবাহিনী নিয়ে। ডাকাতেরা কেবল ধনসম্পদ নিয়েই ব্যস্ত থাকত। কিন্তু ধর্ষকেরা নারীভোগ এবং বিত্তসহ সবকিছু নিয়েই দ্বন্দ্ব-সংঘাত আরম্ভ করত। এ অবস্থায় ঐন্দ্রিলার মাথায় অদ্ভুত এক বুদ্ধি এল, যা সম্ভবত ভারতবর্ষে প্রথম কারও মাথায় এসেছিল। তিনি তাঁর গোয়েন্দা বাহিনী দ্বারা জরিপ করিয়ে দুর্ধর্ষ ধর্ষকদের একটি তালিকা তৈরি করলেন এবং সবাইকে এক রাতে নপুংসক অর্থাৎ খাসি বানিয়ে ফেললেন, যারা ঐতিহাসিকভাবে ‘খোজা’ নামে পরিচিত। ঐন্দ্রিলা ‘খাসি’দের তাঁর প্রাসাদ এবং রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োগ দিলেন এবং সবচেয়ে মেধাবী খাসিটিকে নিজের দেহরক্ষী দলের প্রধান বানালেন। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে ঐন্দ্রিলা একরাতে তাঁর সেই নপুংসক দেহরক্ষীর হাতেই নিহত হয়েছিলেন।
ঐন্দ্রিলার মৃত্যুর পর লালুয়াদারু রাজ্যের অবস্থা কী হয়েছিল, তা আমরা জানি না। সেখানে কি প্রাচীন নারীশাসিত পঞ্চায়েতপ্রথা চালু হয়েছিল, নাকি পুরো অঞ্চলের মানুষ পারস্পরিক হানাহানিতে মত্ত হয়ে পুরো জাতিগোষ্ঠীর কবর রচনা করেছিল, তা বিহার রাজ্যের প্রত্নতত্ত্ববিদেরা বলতে পারবেন। কিন্তু আমাদের পাশের একটি রাজ্যে কয়েক হাজার বছর আগের একটি সময়ে এক নারী এবং তাঁর সহযোগীরা অমানবিকতার যে ইতিহাস রচনা করে গেছেন, তা কেবল ভারতবর্ষ নয়, পুরো দুনিয়ার অসভ্যতা-নিষ্ঠুরতা-নির্মমতা এবং জনপদকে জঙ্গল বানানোর পথ দেখিয়ে গেছে। সেই পথ অনুসরণ করে ২০২১ সালের পৃথিবীতে যে কত কিছু হচ্ছে, তার খবরই–বা আমরা কতটুকু রাখি?
আমরা অতীতকালের ঐন্দ্রিলা-চেঙ্গিস-হালাকু অথবা আইয়ামে জাহেলিয়াতের কাহিনি পড়ে হাপিত্যেশ করি। মধ্যযুগের রাজনীতির বর্বরতা নিয়ে সভা-সমিতি-সেমিনারে গলাবাজি করি। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, মগ প্রভৃতি জলদস্যুর নির্মমতার কাহিনি বলি এবং বর্তমান জমানাকে সভ্যতার পাদপীঠ বলে বর্ণনা করি। আমরা বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ, আমির ওমরাহর হেরেমে বন্দী নারীদের আর্তচিৎকার নিয়ে মহাকাব্য রচনা করি এবং চলমান জমানাকে নারীস্বাধীনতার স্বর্ণক্ষেত্র বলে বর্ণনা করি। আমরা হাল্লা রাজা, হীরক রাজা প্রভৃতি পাগল রাজার চরিত্র অঙ্কন করে গান রচনা করি, চলচ্চিত্র নির্মাণ করি, গল্পের বই লিখে শিশুদের ভয় দেখাই এবং প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদন দিই। কিন্তু আমরা যদি বিবেকের দরজা খুলে দিয়ে বর্তমানকে পর্যবেক্ষণ করি, তবে অতীতের কুকর্মের ইতিহাস হয়তো অনেক ক্ষেত্রে ম্লান হয়ে পড়বে এবং কিছু ক্ষেত্রে বর্তমানের কাছে লজ্জাতুর হয়ে অতীতকাল আত্মহত্যা করতে চাইবে।
আমরা যদি চলমান সময়ের রথে চড়ে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি ভ্রমণ করি, তবে দেখতে পাব যে, গল্পের ঐন্দ্রিলার মানসকন্যা এবং পুত্ররা এখন কী ভয়ংকর দাপটের সঙ্গে লোকালয়গুলো আফ্রিকা অথবা আমাজনের জঙ্গলে পরিণত করার কর্মে কত বেশি পারঙ্গম হয়ে উঠেছে। অন্য দিকে ঐন্দ্রিলার ‘খাসি’দের উত্তরসূরিরা সংখ্যাধিক্যে কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং কীভাবে লম্ফ-ঝম্ফ দিয়ে অগ্ন্যুৎপাত ঘটাচ্ছে, সেই দৃশ্য বর্ণনা করার মতো আমাদের কাব্যপ্রতিভা আর কলমের কালি দুটোই শেষ হয়ে গেছে। অথচ আমরা সময়ের উল্টো রথে সওয়ার হয়ে সফলতা ও উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ক্রমেই লোকালয় থেকে এমন এক গন্তব্যের পানে ফিরে চলেছি যা হয়তো আগামী দিনের ইতিহাসবিদ–প্রত্নতত্ত্ববিদ, গল্পকার, কবি এবং চিত্রকরদের জন্য বিরাট এক কর্মক্ষেত্র তৈরি করবে।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট।