এমন বন্ধুত্বগুলো বেঁচে থাক পৃথিবীতে
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বড়খিলা গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক আক্কাস আলীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় মেয়ের নাম মালেকা বানু। বাকি চার সন্তান ছেলে। মেয়ের গায়ের রং কালো বলে তার বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল আক্কাস আলীর। মেয়েকে দেখতে এসে চড়া যৌতুক দাবি করায় বেশ কয়েকটি বিয়েও ভেঙে গেছে এর আগে। পরে ৩০ হাজার টাকা যৌতুকের দাবি মিটিয়ে পাশের গ্রামের আলফাজ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে অল্প বয়সে মালেকাকে বিয়ে দেন আক্কাস আলী।
বাবা হিসেবে আক্কাসের সবচেয়ে বড় ভয় ছিল বয়স হলে মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না। তখন আইবুড়ো হয়ে পড়ে থাকতে হবে ঘরেই। স্বামীর বাড়ি গিয়ে মালেকা বুঝতে পারে স্বামী তার পাক্কা জুয়াড়ি। যৌতুকের যে টাকা দিয়েছে, তার চেয়ে আরও বেশি টাকার জন্য মালেকার ওপর চলতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন। এদিকে কৃষক বাবার পক্ষে আর কোনো টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না মেয়ের সুখের জন্য। এমন সময় মালেকার গর্ভে আসে তার প্রথম সন্তান। সন্তান জন্ম দেওয়ার আগপর্যন্ত কোনোমতে স্বামীর সংসার করতে পেরেছিল মালেকা। যখন তার প্রথম সন্তান মাসুম জন্মের পর পোলিও রোগ আক্রান্ত হয়, তখনই আসে বড় বিপদ। মালেকাকে সংসারে বউ হিসেবে রাখতে চাইলেও রাখবে না দুধের শিশু মাসুমকে। প্রতিবন্ধী কোনো ছেলেকে লালন-পালন করতে পারবে না। এমন সন্তান প্রসব করায় নানা কুসংস্কার নিয়ে ঘিরে ধরল শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তখন নানা অপবাদে তালাক দিয়ে বের করে দেয় মালেকাকে তার স্বামী।
স্বামীর সংসার থেকে চলে আসার পর খুব বেশি দিন বাপের বাড়িতে থাকেনি মালেকা। জীবন-জীবিকার তাগিদে, নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এক দূরসম্পর্কের খালা সুফিয়ার কাছে মাসুমকে তুলে দিয়ে মালেকা চলে যায় ঢাকা। ঢাকায় মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে বেশ কয়েক বছর। ঢাকা থেকেই মাসুমের জন্য প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাতেন মালেকা। পরে কিছুদিন পর তাকে ফিরে আসতে হয় নিজ গ্রামে। কারণ, মালেকার বাবা আক্কাস আলী তার জন্য আবার নতুন একটি বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন। এখানেও ঠিক একই শর্ত, তা হলো সে তার প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে স্বামীর বাড়িতে থাকতে পারবে না। অবশেষে পরিবারের সিদ্ধান্ত এবং নানা চাপে পড়ে মালেকা আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসে পার্শ্ববর্তী কৈয়েরচালা গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। মালেকা তার নাড়িছেঁড়া ধন মাসুমকে ফেলে সেই যে স্বামীর সংসার করতে যায়, তাও প্রায় দেখতে দেখতে ১৭ বছর। প্রথম প্রথম মাসুমকে তার মা বছরে এক–আধবার দেখতে এলেও পরে স্বামীর চাপে ছেলের খোঁজ নিতে পারেনি। এদিকে মাসুমের বয়স যখন ছয় কি সাত, তখন তার পালক নানি সুফিয়া অভাব–অনটনে পড়ে যায়। আগে মালেকা লুকিয়ে প্রতি মাসে সন্তানের জন্য কিছু খরচাপাতির ব্যবস্থা করলেও পরে তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে থালা হাতে রাস্তায় বসে পড়ে মাসুম।
মাসুম ছয় বছর থেকে ভিক্ষা করে জীবন–জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এখন মাসুমের বয়স ২০ বছর। এ ২০ বছরে মা তার এই অসহায় সন্তানকে বেশ কয়েকবার দেখতে এলেও নিজের কাছে নিয়ে রাখার সুযোগ হয়নি কখনো।
তাই মাসুমের সঙ্গী হয়ে চলার পথে সাহায্য করে দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই মুন্না। সে সকাল-সন্ধ্যা মাসুমের সঙ্গে থাকে। তার হুইলচেয়ারটা ঠেলে নিয়ে যায় মাইলের পর মাইল। তবে মাঝেমধ্যে মাসুমের আরেক বন্ধু মোশারফ সাহায্য করে মাসুমকে চলতে-ফিরতে। সারা দিন কালেকশন (ভিক্ষা) শেষে মুন্না কিংবা মোশাররফকে কিছু টাকাপয়সা দেয় মাসুম। মালেকার বিয়ের পর আফরোজা, মাহফুজা ও আসগর নামে তিন সন্তান হয়।
তবে গতকাল রোববার মাসুমের জীবনের একটি বিশেষ দিন ছিল। কারণ, প্রায় ১৭ বছর পর মাসুম এক্কেবারের জন্য যাচ্ছে মায়ের কাছে। শেষ কবে মা আদরের পরশ মাসুমের কপালে বুলিয়েছিল, ঠিক মনে করতে পারে না। মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য বারবার ছটফট করে, কিন্তু মায়ের দেখা পায়নি মাসুম। সংসার নামের এক অদৃশ্য দেয়াল বরাবরই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাসুম আর তার মায়ের জীবনের মাঝামাঝি। একটু বুদ্ধিশুদ্ধি হওয়ার পর মাসুম বুঝতে পারে, এই বিশাল পৃথিবীতে সে আসলে বড্ড একা।
একা একাই পাড়ি দিতে হবে তাকে জীবনের বাকিটা পথ। মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ মনে করতে পারে না সে। জ্বর কিংবা রোগশোকে বিছানায় পড়ে বিড়বিড় করে এখনো ডাকে মাকে। একটিবারের জন্য দেখতে চাইলেও মাকে আর কাছে পায় না মাসুম।
কিন্তু জীবন যেমন বেদনার অতলে নিমজ্জিত থাকে, ঠিক তেমনি জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে হাজারো চমক। তাই তো প্রায় ১৭ বছর পর মাসুম সকালে ঘুম ভেঙে দেখে ছোট বোন মাহফুজা আর ভাই মোশাররফ তার নতুন বাবার বাড়ি থেকে মাসুমকে নিতে এসেছে। ঘটনা হলো মাসুমের নতুন বাবা আবদুর রাজ্জাক এবার মাসুমকে তার পরিবারের রাখার অনুমতি দিয়েছে মালেকাকে। তাই মালেকা বানু মাসুমকে সঙ্গে রাখতে ছেলেমেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছে মাসুমকে আনার জন্য।
বিষয়টি মানুষের কাছে কল্পনার মতো মনে হলেও বাস্তবতা প্রায় এমনই। ১৭ বছর পর মাসুম তার মায়ের বাড়ি যাচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা মাসুমের সঙ্গে যাচ্ছে তার সঙ্গে সারা দিন গ্রামের হাটবাজারে হুইলচেয়ার ঠেলে নিতে সাহায্য করা দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই মুন্না।
সারা দিন ভিক্ষা করা শেষে মায়ের কাছে ফিরতে পারবে মাসুম, মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খাবে। কিছু পয়সা হলে জমিয়ে মাকে শাড়ি কিনে দেওয়াসহ ছোট ভাইবোনদের কাপড়চোপড় কিনে দিতে পারবে—এমনটাই চাওয়া মাসুমের।
এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে যে মাসুম পায়নি তার মায়ের স্নেহ–ভালোবাসা, কেবলই করুণায় বেঁচে আছে একটি জীবন, তাই এ জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ কিংবা খুব একটা চাওয়া–পাওয়া নেই মাসুমের। তারপরও এত বছর পর সে যাচ্ছে মায়ের বাড়ি। মায়ের কাছে ফেরার অনুভূতিটুকু তার কাছে জানতে চাইলে মাসুম একটা মুচকি হেসে দিয়ে জবাব দেয়, ‘মামা, এইটা কি কোনো জীবন? এইটারে কি বাঁইচা থাকা বলে? সারা দিন মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করি। মানুষ আমারে দেইখা ভিক্ষা দেয়, সে টাকা দিয়া ভাত খাই, বাঁইচা থাকি। যেদিন মানুষ আর করুণা করব না, যেদিন আর ভিক্ষা দেবে না, সেদিন থেকে খাওন নাই। আমার কোনো ঘর–সংসার নাই।
এই জীবনে তো কেউ সাথিও হইব না। জীবনে কোনো দিন ভাবি নাই মায় আমারে সঙ্গে নিয়া রাখব, আমি মায়ের কাছে থাকতে পারমু। তবে কত দিন মায়ের সংসার আমি থাকতে পারমু জানি না। আসলে ভিক্ষা কইরা মানুষের করুণায় বাঁইচা থাকার এ জীবনের চাইতে মইরা যাওয়া অনেক ভালা। আমি এই করুণার জীবন আর চাই না। খুব ইচ্ছা হয় বাজারে ছোট্ট একটা টং দোকান দিতে, নিজে স্বাবলম্বী হমু। থাকার একটা ঘর থাকব। কিন্তু সেই সামর্থ্য আমার আল্লায় দেয় নাই। আমার কোনো টাকাপয়সা নাই, তবুও খুব ইচ্ছা করে একবার যদি নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পারতাম...প্রতিবন্ধী ভাতার কয়টা টেকা ছাড়া আর কোনো সহযোগিতা পাই না সরকার থেইকা। কেউ তো আমারে সহযোগিতা করল না। সবাই ২ টেকা, ৫ টেকা ভিক্ষা দিল খালি।’
এই বলেই মাসুম চুপ হয়ে যায়। মুন্না মাসুমকে ঠেলতে ঠেলতে পিচগলা রাস্তা দিয়ে তার মায়ের বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে থাকে। সঙ্গে মাসুমের বোন আর ভাইও। মাসুমের শেষ কথাটা খুব মনে পড়ছিল—নিজের পায়ে দাঁড়ানো। তখন আচমকাই কেন যেন নিজের পায়ের দিকে আরেকবার তাকাই...
মুহূর্তে মিলিয়ে যায় মাসুম। দূর থেকে শুধু ভেসে আসছিল ওদের কথাগুলো...