একটি ফুলের মৃত্যু
রেলক্রসিং। এ পাশ-ও পাশের গাড়িগুলো অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্য। যেকোনো মুহূর্তে আসবে দ্রুতগামী ট্রেন। লেভেল ক্রসিংয়ের দুই দিকেই লাইনম্যান প্রতিবন্ধক নামিয়ে রেখেছেন। কিন্তু কারও ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই যে যার মতো পার হচ্ছে। রাজধানীর প্রায় সব রেলক্রসিংয়েই এ দৃশ্য হরহামেশা চোখে পড়ে।
আনিস সাহেব গাড়িতে বসে আছেন। ভ্যাপসা গরম পড়েছে। এই গরমে আবার তিনি কুট স্যুট পরেছেন। ড্রাইভার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে সিগারেট ধরাল। সিগারেটের গন্ধে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আনিস সাহেবের ইচ্ছা করছে ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে কলার ধরে নামিয়ে কষে একটা চড় মারতে৷ হয়তো একটু হলেও শান্তি পাওয়া যেত। কিন্তু সমস্যা হলো, ড্রাইভারদের এখন কড়া করে দুটো কথাও বলা যায় না। বললেই চাকরি ছেড়ে চলে যায়। যারা যেতে পারে না, তারা দুই দিন পরপর বলে, স্যার, গাড়ির এটা নষ্ট, ওটা নষ্ট। এটা সারতে কমসে কম দশ হাজার টেকা লাগতে পারে।
অসহ্য গরম! নাহ, আর সহ্য হচ্ছে না।
গাছপালা কম থাকায় শহরাঞ্চলে ভ্যাপসা গরমের মাত্রা বেশি থাকে। আনিস সাহেব মাঝেমধ্যে ভাবেন, যদি কখনো দেশের মন্ত্রী-টন্ত্রী হন, তাহলে শহরে গাছপালা লাগিয়ে ভরে ফেলবেন। দুই হাত পরপর গাছ৷ গাছের ছায়ার লোকজন বাসের জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। কী সুন্দর দৃশ্য! এসব ভাবতেই ভালো লাগে।
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। দশ মিনিট হয়ে গেছে। ট্রেন আসার খবর নেই। একটা মেয়ে হেঁটে আসছে। হাতে গোলাপ ফুলের ঝুড়ি। গোলাপের পাপড়িতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। ফুলগুলো যেন হাসছে। ধীরে ধীরে সজীব হয়ে উঠছে। মেয়েটি গাড়িগুলোর জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন বলছে। কেউ তার ফুল কিনছে না।
চেহারায় বিষণ্ণ মায়ার গোধূলির ছায়া নিয়ে এগিয়ে আসছে মেয়েটি। এলোমেলোভাবে হাঁটছে। এক পায়ের সঙ্গে আরেক পা লেগে গেলেই হয়তো মাটিতে পড়ে যাবে। মেয়েটি যে গতিতে হাঁটছে, তার কোনো পরিবর্তন হলো না। ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। একদম কাকভেজা হয়ে গেছে।
‘সাহেব একটা ফুল নেন। মাত্র দশ টেহা।’ ‘কী নাম তোমার?’ ‘ফুল।’ ‘তোমার নামও ফুল?’ ‘হ, সাহেব। ভালা নাম হইল গিয়া মোছাম্মত ফুলফুলিয়া। তয় আম্মা আদর কইরে ফুল ডাহে।’ ‘সারা দিনে কয়টা ফুল বিক্রি করেছ?’ ‘আইজ দিন ভালা না। ঝড়–বৃষ্টির দিন। বেচাকেনা হয় না। গতকাল রাত থেইকা মেলা জ্বর-ঠান্ডা। এহন একটু কম কম লাগতাছে, তাই ফুল নিয়ে বাইর হইলাম।’ ‘এই বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর বেড়ে যাবে না?’ ‘জ্বর বাড়লেও তো ভালা। ঘরে হুয়া থাকমু৷ কিচ্ছু খাইতে মন চাইব না। এহন আরাম লাগতাছে, তাই খিদা চাপ দিতাছে। এই কইটা ফুল বেইচ্যা এক পেলেট খিচুড়ি খামু।
হারা দিন আর খাওয়ান লাগত না।’ ‘তোমার ঝুড়িতে কয়টা ফুল আছে?’ ‘১২টা ফুল। ১২০ টেহা। তয় আপনে সবগুলা নিলে দুইডা ফ্রি দিমু।’ ‘এই ৫০০ রাখো, কেমন?’ ফুলফুলিয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। পলকহীন মাছের দৃষ্টি। এ রকম ঘটনা কখনো দেখেনি সে। ৫০০ টাকার নোটও এই প্রথম দেখল। ‘তুমি থাক কোথায়?’ ‘সাহেব, মালিবাগ রেলগেইটের কাছেই বড় একটা বস্তি আছে না? ওহানেই থাহি।’ বৃষ্টি নেই। দূরের ভেজা ভেজা হাওয়া আসছে। ফুলফুলিয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেছে। মেয়েটার কী মিষ্টি চেহারা! দীর্ঘ পল্লব, ছায়াময় চোখ। সেই চোখ সব সময় হাসছে। বাতাসে তার কোঁকড়া চুলও উড়ছে। ট্রেন লম্বা হুইসেল বাজিয়ে এগিয়ে আসছে। ফুলফুলিয়া ৫০০ টাকার নোট উল্টেপাল্টে দেখছে। দেখে দেখে ট্রেন লাইন পার হচ্ছে। লাইনম্যানের বাঁশির সুর, ট্রেনের ভয়ংকর হুইসেল সে শুনতে পাচ্ছে না। হয়তো আর কখনো শুনতেও পারবে না।
*লেখক: মনজুর সা’দ, কসবা, শেরপুর