একটা সুখের পৃথিবী
বড় করে নিশ্বাস ফেলার ছোট্ট একটা জানালা। জানালার ওপাশে শিউলি ফুলের গাছ। গাছের ডালে বসে থেমে থেমে ডাকছে একটি কোকিল। কোকিলের কুহু কুহু ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে তাকাই। পর্দাটা সরিয়ে দিই। সূর্যের আলো চোখে লাগে। কপালে হাত দিয়ে সূর্য দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করি। বারবার হেরে যাই। তবু ফিরে ফিরে তাকাই।
ফুলের গন্ধে ম–ম করছে ঘরটা। বিছানা অগোছালো। বালিশের পাশে বারো শ পাতার মস্ত বড় একটা বাংলা অভিধান, কয়েকটা গল্পের বই, ভৌতিক উপন্যাস, হাতঘড়ি, মোটা ফ্রেমের কালো চশমা, আসমানির দেওয়া নীল ডায়েরি ও লাল বলপিন শুয়ে আছে আমার সঙ্গে।
কিছুদিন আগেও বইগুলোর জায়গায় আসমানির জায়গা ছিল। আমার ঘরে দ্বিতীয় কোনো বালিশ নেই। দুজন এক বালিশে শুয়ে শুয়ে রাজ্যের কথা বলতাম। ওর পেটে এত কথা থাকত! মাঝেমধ্যে আমি অবাক হতাম! ওর চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতাম। পলকহীন মাছের দৃষ্টিতে। সেই চোখে আমি আমাকে আবিষ্কার করতাম। সম্পূর্ণ আমি। অন্য কেউ নয়। শুধু আমি!
ওই চোখ কখনো ধোঁকা দেবে। আমার চোখ কেঁদে কেঁদে অশ্রু বিসর্জন করবে। উঁহু, কখনো ভাবিনি।
ঘরে আসমানি নেই। ওর স্মৃতিগুলোও নেই। সব নিয়ে গেছে। যেন আমার কষ্ট না হয়। তার শূন্যতা কখনো অনুভব না করি। তার বিরহে হৃদয়ে কখনো আগুন না জ্বালি। অথচ আমি প্রতিনিয়ত জ্বলছি। জ্বলে জ্বলে তিলে তিলে শেষ হচ্ছি!
জানালার বাঁ পাশের কপাট খানিকটা ভেঙে গেছে। বই পড়ার সময় কাঠপোকা অদ্ভুত শব্দ করে গান গায়। আমি চুপটি করে শুনি। ওদের গানের গলা খুব বাজে। তবু আমার ভালো লাগে। হয়তো ওদেরও পড়তে ইচ্ছা করে।
কাল ঈদ। আম্মু, বড় আপু পিঠা বানাচ্ছে রান্নাঘরে। নতুন নতুন আইটেমের পিঠা৷ আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। শুয়ে ছিলাম ঘণ্টাখানেক। পিঠার ঘ্রাণ নাকে আসছে। নাহ্, আর ঘুমোতে পারছি না।
দরজায় বসে ছোট বোন মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে। গ্রামের চাচাতো–জ্যাঠাতো বোনদের। সবাই খুশি হয়ে অপেক্ষা করছে। একজন শেষ হলে আরেকজন দেবে। সবার চেহারায় খুশির আমেজ। ঈদের আমেজ।
আমি মায়ের পাশে পিঁড়ি নিয়ে বসলাম। পিঠা কড়াই থেকে পাতিলে রাখতে না রাখতেই আমার হাতে উঠে এল।
অনেক গরম। মনে হচ্ছে, আগুন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। আমি দুই হাতে পিঠা নিয়ে এপিঠ-ওপিঠ করছি আর ফুঁ দিচ্ছি। অনেক কষ্ট করে দু–একটা পিঠা মুখে পুরলাম। জিহ্বা হালকা পুড়ে গেল। জিহ্বায় ডান হাতের আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে বললাম,
যাক বাবা, তবু গরম–গরম খেতে পারলাম তো!
রাতদুপুর। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে না কিছু। কয়েকবার ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলাম না। শোয়া থেকে উঠে বসলাম। শীতও লাগছে হালকা। মৃদু কুয়াশা ভেসে আসছে রুমের খোলা জানালাপথে। ঘুম বুঝি আর আসবে না। ডায়েরি হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়ালাম।
বাহ্! এদিকটা বেশ নীরব। একদম কোলাহলমুক্ত। মাঝেমধ্যে বাতাসের হিমস্পর্শে গা শিউরে উঠছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে ডায়েরির পাতাগুলো। শহরটা বেশ ফাঁকা। দীর্ঘ সময় পরপর দু–একটা গাড়ি নিঃশব্দে ছুটে চলছে। আকাশটা বেশ স্বচ্ছ। চাঁদের আলো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে। ডায়েরির পাতাগুলো তাকিয়ে আছে আমার দিকে, সারা দিন না খেয়ে থাকা পথশিশুর ন্যায়। কিছু চাইছে হয়তো। কলমটা হাতে নিলাম আগ্রহভরে। কী লিখব কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল ফাঁকা শহরের নির্ঘুম রাস্তার প্রতি।
এক রিকশাওয়ালা রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে। কাল ঈদ আর আজ সে রিকশা চালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। একটু পরপর ডান হাতে বাঁধা গামছা দিয়ে মুখ মুছছে। বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। আমার খুব ইচ্ছা করছে তাকে কাছে ডাকতে। সুখ-দুঃখের দু–একটা কথা বলতে। মানুষের জীবন পড়তে আমার ভালো লাগে। দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল। দূরে কোথাও চলে গেল।
এত রাতেও সে চালিয়ে যাচ্ছে জীবনসংগ্রাম। শহরবাসী যখন সুখনিদ্রায় অচেতন, তখন তার শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। মনটা বিষণ্নতায় ভরে উঠল। চাঁদটা এখন ঠিক মাথার ওপরে। চাঁদের মিষ্টি আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুরো পৃথিবী। তখন মনে হলো, চাঁদের আলোকে যেমন সবাই উপভোগ করছে, এভাবে যদি সবার দুঃখগুলোকে ভাগ করে নিত! তাহলে কারও দুঃখ–কষ্ট থাকত না। চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা সুন্দর সুখের পৃথিবী!
*লেখক: মনজুর সা’দ, কসবা, শেরপুর