উত্তর-দক্ষিণের কেউ ভালো নেই

উন্নয়নে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশ। এ কথা বলে গর্ববোধ করি। উন্নয়ন হয়েছে দেশের দুটি বড় শহরকে ঘিরে। দেশের রাজধানী ঢাকা আর বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। বড় এ দুই শহরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, এই দুই শহরকে দিয়েই আমরা দেশের উন্নয়নকে মাপি! যদিও এ দুই শহরে সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার করুণ চিত্র আমাদের বারবারই সামনে আসে।

বাংলাদেশের উত্তরে ও দক্ষিণে বসবাসকারী বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে যুগান্তকারী কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা মিলছে না। উত্তরের হাওর ও ছোট নদীতীরবর্তী জনপদের মানুষ এবং দক্ষিণে সমুদ্রতীরবর্তী এলাকার মানুষ। উত্তরের মানুষের ভয় ভারত, দক্ষিণে ঘূর্ণিঝড়। দেখা গেছে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হলেও উত্তরের মানুষের জীবনে এর প্রভাব তেমন একটা পড়ে না। কিন্তু ভারত বারবার তিস্তা ব্যারাজের ও ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেওয়াতে উত্তরের জনপদে প্রতিবছরই বন্যার কবলে মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। নষ্ট হয় রাষ্ট্রীয় সম্পদেরও। ভারত থেকে নেমে আসা এ পানি প্রভাব ফেলে দেশের উপকূলেও।

প্রতিবছর দেশে জলোচ্ছ্বাসগুলোর কারণ খুঁজে বের করলে দেখা যায়, উজান থেকে নেমে আসা পানির একটা বিশাল প্রভাব থাকছেই। একদিকে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়েছে, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অতিবৃষ্টি এবং ভারতের পানির চাপ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে হওয়ায় নদীতীরের মানুষের জীবনমানে বিবর্ণ রূপ দেখা মিলছে।

দুই বছর ধরে বাংলাদেশের উপকূলে অস্বাভাবিকভাবে বন্যা হচ্ছে। বয়স্ক ব্যক্তিরা বলছেন, এমন পানি তাঁরা বিগত ৩০ বছরেও দেখেননি, ১৯৭০ সালের বন্যা বা ১৯৯৮ সালের বন্যা। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর যে বন্যা বাংলাদেশে হয়েছে, সেটির নাম ছিল ভোলা সাইক্লোন। এতে মারা যায় উপকূল অঞ্চলের ১০ লাখ মানুষ। ১৯৯৮-এর বন্যা ছিল বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুই মাসের অধিককালজুড়ে সংঘটিত এ বন্যায় দেশের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যায়। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে উপকূলীয় এলাকার মানুষ বন্যার মুখোমুখি তেমন একটা না পড়লেও কয়েক বছর ধরে বন্যার পানি বেশ ভোগাচ্ছে তাদেরকে।

সাতক্ষীরার পরিবেশে এক বিবর্ণরূপ বারবারই চোখে ভেসে আসছে। আকাশ থেকে বন্যার সময় নেওয়া ছবিতে দেখা যায়, পুরো এলাকা পানির নিচে তলিয়ে আছে। টেকনাফের শাহপরী দ্বীপের এক সহকর্মী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি শেয়ারের পর দেখলাম, জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে সব।

অন্যদিকে এসব জলোচ্ছ্বাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেড়েছে নদীভাঙন। লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগর, নোয়াখালীর সুবর্ণচর, হাতিয়া কিংবা শরীয়তপুরের পদ্মাপাড়ের মানুষের জীবন কাটছে নদীভাঙন আতঙ্কে৷

বন্যার প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ের পানি বেড়েছে ৫-৬ ফুট। নদীতীরবর্তী এলাকা থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরেও বন্যার পানি উঠে। মানুষের ঘরবাড়ি সবই তলিয়ে যায়। দুই বেলা রান্না করার চুলোটাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকে পানির নিচে। অনাহারে–অর্ধাহারে জীবন কাটায় লাখ লাখ মানুষ। এমন দুর্বিষহ জীবন দেখেছি সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে।

দেশের উত্তরের জনপদ সুনামগঞ্জে গত বছর বন্যার পর যাওয়া হয়েছে। গণমাধ্যম মারফতে বন্যার চিত্র দেখেছি। মানুষের হাহাকারের চিত্র দেখেছে বিশ্ব। সুনামগঞ্জ একটি পর্যটন এলাকা সত্ত্বেও এখনকার রাস্তাঘাটগুলো সুবিধার মনে হয়নি। আর এই রাস্তাগুলো নষ্ট হয়েছে বন্যার কারণে। যদি ভারত বারবার তাদের গেটগুলো খুলে না দিত, তবে পানিতে মানুষ দুর্ভোগে পড়ত না, নষ্ট হতো না রাষ্ট্রীয় সম্পদও।

সবশেষ ভারত তিস্তা ব্যারাজের সবগুলো গেট খুলে দিয়েছে৷ লালমনিরহাটের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে, জলবায়ুর পরিবর্তন আবার ভারতের পানির চাপ। এত দিক বিবেচনা করেও বাংলাদেশের উপকূলের মানুষের কথা কে শোনে? বেড়িবাঁধ নেই, বেড়িবাঁধ নেই বলে উপকূলে কত হাহাকার। উত্তরবঙ্গের মানুষের দুঃখ তিস্তা, ফারাক্কা! তবে কবে এই দুঃখ ঘুচবে!