ইন্টার‌নেট ও অনলাইন গেমস আস‌ক্তির প্রভাব

ফাইল ছবি

৬ বছ‌রের হাসান। গৃহ‌শিক্ষক যতক্ষণ থা‌কেন, ততক্ষণ পড়াশোনা নি‌য়ে ব্যস্ত থা‌কে।‌ কিন্তু গৃহ‌শিক্ষক চ‌লে যাওয়ার প‌রে বাবার অথবা মা‌য়ের মু‌ঠো‌ফোন নি‌য়ে গেমসে ব্যস্ত হ‌য়ে পড়ে। বাবা একটু বকা দিয়ে মু‌ঠো‌ফোন কে‌ড়ে নেন।‌

একই চিত্র ১২ বছ‌রের সোহা‌নের। সারা‌ দিন গেমস নি‌য়ে ব্যস্ত। বাসার বা‌ইরে বের হয় না, বন্ধু‌দের সঙ্গে মিশ‌তে চায় না, গ‌ল্পে‌র বই পড়‌তে চায় না।

ওপ‌রের দু‌টি ঘ‌টনা নিয়ে বাংলা‌দেশের সব অভিভাবক সংক‌টে থা‌কেন। শুধু দে‌শেই নয়, বিশ্বজু‌ড়ে অনলাইন গেমস ম‌নোস্বাস্থ্য হি‌সে‌বে সমস্যা দেখা দিয়ে‌ছে। শুধু শিশু কিংবা কি‌শোর নয়, ক‌ম্পিউটার বা মোবাইলে গেমস খে‌লে না, এমন লোক পাওয়া দুষ্কর।‌ কিন্তু গেমস যখন নেশায় প‌রিণত হয়, তখন জীবন হ‌য়ে যায় এমন ঝুঁকিপূর্ণ ও অসহ্য।

পু‌রো বি‌শ্বে প্রায় ১২০ কো‌টি গেমার র‌য়ে‌ছে, যার বে‌শির ভাগ অংশ শিশু ও কম বয়সী।‌ বি‌শেষ ক‌রে ১৮ বছ‌রের নি‌চে। কিন্তু এই কম বয়সী‌দের গেমসের প্রতি আসক্ত প‌রিবার, তথা সমা‌জের জন্য ব‌য়ে আন‌তে পা‌রে ক্ষ‌তিকর প্রভাব। অনলাইন গেমসকে তারা জীব‌নের একটা অংশ ম‌নে ক‌রে। প‌রিবার থে‌কে নি‌জে‌কে দূ‌রে রাখার চেষ্টা ক‌রে।‌

বি‌শেষজ্ঞরা ম‌নে ক‌রেন, মাদকাসক্তির মতো ইন্টারনেটে মাত্রাতিরিক্ত থাকা বা গেমস খেলাও আসক্তি। উভয়ই কম বয়সী‌দের শা‌রী‌রিক ও মান‌সিক ক্ষ‌তি সাধন ক‌রে।

স্বাভা‌বিক কর্মক্ষমতা থে‌কে নি‌জে‌কে দূ‌রে রাখে। এক জ‌রি‌পে জানা গে‌ছে, গেমাররা এরই মধ্যে এসব খেলায় ২০ থেকে ৩০ হাজার ঘণ্টা বিনিয়োগ করেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন অব ডিজিজ ১১তম সংশোধিত সংস্করণে (আইসিডি-১১), ‘গেমিং অ্যাডিকশন’ হিসেবে ২০১৮ সা‌লে একে মনোস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে প্রকাশিতব্য আইসিডি-১১ শীর্ষক রোগনির্ণয়ে গাইডবুকে এটি সংযুক্ত করা হয়েছে। ২০১৩ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত মানসিক রোগনির্ণয়বিষয়ক গাইডলাইনে (ডিএসএম-৫-) বিষয়টিকে ‘ইন্টারনেট গেমিং ডিজঅর্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করে গবেষণার ভিত্তিতে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছিল।

ইন্টার‌নেট ও গেমস আস‌ক্তি এক নয়

ক‌রোনাকালে ইন্টার‌নেট ব্যবহার ও গেম‌সের আস‌ক্তি বে‌ড়ে‌ছে দ্বিগুণ। ত‌বে ইন্টার‌নেট ব্যবহার ও গেমসে আস‌ক্তি—দুটি আলাদা। ক‌রোনাকালে অনেকে ইন্টার‌নেট ব্যবহার করে ফেসবুক, ইউটিউবে সময় ব্যয় কর‌ছে,‌ কেউ পর্নোগ্রা‌ফিতে আসক্ত,‌ কেউবা নানান সফটওয়্যার ব্যবহা‌র ক‌রে সময় ব্যয় কর‌ছে। কেউবা গেমসে ব্যয় কর‌ছে ‌দি‌নের বে‌শির ভাগ সময়। বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন—বিটিআরসির ২০১৬ তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৩৫ শতাংশ হচ্ছে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী, অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর–কিশোরী। তাই এদের আস‌ক্তি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ বিষ‌য়ে বি‌শেষজ্ঞরা ইন্টার‌নেট ও গে‌মসে আস‌ক্তি হওয়ার একাধিক কা‌রণ ও সমস্যা প‌রিত্রা‌ণের উপায় উল্লেখ করে‌ছেন।

গেমসে ও ইন্টার‌নে‌টে যেভা‌বে আসক্তি হ‌চ্ছে—

* অবসর সময় কাটা‌তে বাচ্চাদের গেমসের প্রতি আগ্রহ বাড়‌ছে। এ আগ্রহ থে‌কে ধী‌রে ধী‌রে গেমসে আসক্তি বে‌ড়ে যায়। যখনই সময় পায়, তখনই মু‌ঠো‌ফোন নি‌য়ে গেমিং ক‌রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় ক‌রেছে। প্রথম দিন এক ঘণ্টা,‌ দ্বিতীয় দিন দেড় ঘণ্টা। এভা‌বে আস্তে আস্তে সময় বাড়িয়ে গে‌মসে আসক্ত হ‌চ্ছে।
* মা–বাবা সন্তান‌দের চো‌খের সাম‌নে রাখ‌তে তা‌দের হা‌তে ফোন তু‌লে দেন, যা শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেট ও গে‌মসে আসক্ত করে ফে‌লে।
* মা–বাবা নি‌জেরাও অনেক সময় ধ‌রে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মগ্ন থাকেন, যা সন্তানের অনু‌প্রেরণা জোগায়।
* অতিরিক্ত কার্টুন দেখা‌নোর অভ্যাস কর‌লে শিশুরা ইন্টার‌নে‌টের প্রতি আসক্ত হয়।
* বা‌সে কিংবা রাস্তাঘা‌টে হাঁটার সম‌য়ে ইন্টার‌নেট ব্যবহার করার ফ‌লে অভ্যাসে প‌রিণত হয়।
ত‌বে ইন্টার‌নেট ব্যবহার কর‌লেই নে‌তিবাচক ধারণা তৈরি করা যা‌বে না। সন্তান‌কে আধু‌নিক প্রযু‌ক্তির সঙ্গে প‌রিচয় করা‌নোর জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার শেখা‌নো বাবা–মা‌য়ের দা‌য়িত্ব।

গেমস এবং ইন্টার‌নে‌টে আস‌ক্তি প্রকাশ কখন পায়—

* ‌শিশুরা পড়‌তে বস‌লে ‌দ্রুত পড়া শেষ ক‌রা কিংবা খাবার খে‌তে বস‌লে দ্রুত খাবার শেষ করার প্রবণতা দেখা দেয়।
* বাইরে বের হ‌তে চায় না। কোথাও বেড়া‌তে যে‌তে অ‌নীহা প্রকাশ ক‌রে।
* কার্টুন কিংবা গান দেখা‌নো ছাড়া শিশু‌দের খাবার খে‌তে না চাওয়া।
* আসক্ত হওয়ার ফ‌লে স্কুল, ক‌লেজ, বিশ্ববিদ্যাল‌য়ে কিংবা অফি‌সে দে‌রি ক‌রে যা‌বে।
* অনেক সময়‌ গে‌মসে হে‌রে গে‌লে মান‌সিক চাপ বৃ‌দ্ধি পায়। যার কার‌ণে মেজাজ খিট‌খি‌টে হয় এবং যেকো‌নো বিষ‌য়ে জো‌রে কথা ব‌লবে।
* প‌রিবা‌রের সদ‌স্যের প্রতি শ্রদ্ধা‌বোধ হ্রাস পে‌লে বুঝ‌তে হ‌বে গে‌মসে আসক্ত হ‌য়ে‌ছে।
* ইন্টার‌নে‌টে কাজ ব্যতীত বে‌শি রাত জাগা এবং দে‌রি ক‌রে ঘুম থে‌কে ওঠা।
* বাথরুমে মু‌ঠো‌ফোন নি‌য়ে বেশি সময় কাটাবে।

যেসব প্রভাব ফেল‌তে পা‌রে

‌বি‌শেষজ্ঞরা ম‌নে ক‌রেন, ইন্টার‌নেট ও গেমসে আস‌ক্তি মাদকাস‌ক্তির মতোই। মাদকাস‌ক্ত ব্যক্তি যেমন শারী‌রিক ও মান‌সিকভা‌বে বিকারগ্রস্ত হ‌য়,‌ তেম‌নি গেমসে আসক্ত ব্যক্তিও শারীরিক ও মান‌সিকভা‌বে ‌বিকারগ্রস্ত হ‌য়ে যায়।
* প‌রিবা‌রের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হ‌তে থা‌কে এবং বাবা–মা‌য়ের প্রতি শ্রদ্ধা‌বোধ ক‌মে যায়।
* স্বামী-স্ত্রীর সম্প‌র্কে অবিশ্বাস সৃ‌ষ্টি হয়।
* সামা‌জিকভা‌বে পি‌ছি‌য়ে যা‌বে। ‌বি‌ভিন্ন অনুষ্ঠা‌নে অনুপ‌স্থি‌তির কার‌ণে নেতৃত্বের গুণাবলি ক‌মে যা‌বে। ফ‌লে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা হ্রাস পা‌বে।
* কম খাবার গ্রহ‌ণের ফ‌লে শারীরিকভা‌বে দুর্বল হ‌য়ে পড়‌বে।
* বন্ধু‌ যাচাই‌ কর‌তে ভুল কর‌বে।
* মান‌সিক রোগ সৃ‌ষ্টি হ‌বে।
* সাইবার অপরা‌ধে জ‌ড়ি‌য়ে পড়ার সম্ভাবনা র‌য়ে‌ছে।

সমস্যা সমাধানে করণীয়

*‌ শিশু‌দের বয়সসীমা নির্ধারণ ক‌রে ইন্টার‌নেট ব্যবহা‌রে সু‌যোগ দেওয়া।
*‌ গেমসে আস‌ক্তির লক্ষণ দেখা দি‌লে গেমস রিমুভ ক‌রে দেওয়া।
* প্রয়োজন ছাড়া মু‌ঠো‌ফোন বা ক‌ম্পিউটার শিশু‌দের নাগা‌লের বাইরে রাখা।
* ধর্মীয় শিক্ষায় জোর দেওয়া।‌ শিশু‌দের গল্প‌, ক‌বিতার বই পড়‌তে উৎসাহ দেওয়া।
* মা–বাবা যা‌তে অপ্রয়োজনীয় ইন্টার‌নেট ব্যবহার না ক‌রে, সে বিষ‌য়ে নি‌জে‌দের স‌চেতন হওয়া।
* অবসর সম‌য়ে ব্যায়াম করা এবং মা‌ঠের খেলাধুলায় মন‌োযোগ দেওয়া।
* ছু‌টির দি‌নে কোথাও ঘুর‌তে যাওয়া।
* নিরাপত্তামূলক অনেক সফটওয়্যার আছে, সেগু‌লো ব্যবহার নি‌শ্চিত করা।

গেমস ও ইন্টার‌নেট ব্যবহার নি‌ষিদ্ধ নয়

অনেক অনলাইন গে‌মিং ক‌রে অর্থ উপার্জন ক‌রে থা‌কে। দেশ–বি‌দে‌শের বি‌ভিন্ন কোম্পা‌নি মোটা অঙ্কের অর্থ বি‌নি‌য়োগ ক‌রে থা‌কে অনলাই‌ন গে‌মস ও ইন্টার‌নে‌টের ওপর। এ থে‌কে প্রচুর অর্থ আয় করার পাশাপা‌শি কর্মসংস্থা‌নের সু‌যোগ সৃ‌ষ্টি হ‌য়ে‌ছে। তাই অনলাইন গেমস নি‌ষিদ্ধ নয়, বরং একটা নি‌র্দিষ্ট বয়সসীমা নির্ধারণ ক‌রে দেওয়া উচিত, যা‌তে প্রাপ্তবয়স্করা গে‌মিং ক‌রে অর্থ উপার্জন কর‌তে পা‌রে। এতে অর্থ উপার্জনকারীর পাশাপা‌শি শিশুরাও গেমসে আস‌ক্তি থে‌কে দূ‌রে থাক‌বে। এ ছাড়া অভিভাব‌কদের দা‌য়িত্বশীল ভূমিকা পালন কর‌তে হ‌বে। সন্তান‌কে সময় দিতে হ‌বে এবং তা‌দের প্রতি যত্নশীল হ‌তে হ‌বে।
আর ভাবুন সন্তান ভুল প‌থে যা‌চ্ছে না তো?
লেখা: এ বি আরিফ, রসায়ন বিভাগ, সরকা‌রি বাঙলা ক‌লেজ