আশাজাগানিয়ায় পথচলা
সকালবেলায় সূর্যের আভা রুমের ভেতর এসে পড়লেও কেমন যেন একটু ফ্যাকাশেই মনে হয়। আগের মতো উড়ু উড়ু মনটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মাঝে আর কোনো বিশেষত্ব খুঁজে পাই না। ভোরের আলো এসে জানালা দিয়ে ঘরময় আলোকিত করে রাখলেও সবই যেন বিলীন হয়ে যায় মহামারির সংক্রমিত দিনগুলোতে। দেখতে পেতাম, ‘নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে পুরো দেশ’। আঁতকে উঠতাম, যখন বদ্ধ ঘরে বন্দী থেকে শ্বাসপ্রশ্বাসটুকু নেওয়ার জন্য বাইরে যেতেও অস্বস্তি বোধ করি।
মাঝেমধ্যে উড়ন্ত নয়নে চেয়ে দেখতাম ভোরের আকাশ। গতিময়তার মধ্যে ডানা মেলে হাঁস দুটি বৃষ্টির পানিতে খেলা করত। দেখে যেন মনে হতো প্রকৃতির বিশাল উদারতার মধ্যে তারা দিন পার করছে। ভাবনায় তাড়িত হয়ে বলি, আমরাই তো প্রকৃতিকে অন্যদিকে ধাবিত করার প্রয়াসে প্রতিদিন বিভিন্ন কাজে লিপ্ত থাকি। এভাবেই প্রতিদিনের আনাগোনায় শুরু হতো অনভ্যস্ত জীবন। কঠিন সময়ের আবর্তনে এসে আমরা অনুভব করি, মহামারির ভয়াবহতা। স্থবিরতার মধ্যেই ধেয়ে আসত কর্মময় ব্যস্ততার জীবন।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ভালো একটি সময় পার করছিলাম বলা চলে না। প্রতিটি মুহূর্ত খারাপ বলে ধ্বনিত হচ্ছিল। তারপরও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ভরা জীবনের মধ্যেই দিনগুলো পার করতে হচ্ছিল। এ সংকটময় মুহূর্তে আতঙ্কের মধ্যেই দিন অতিবাহিত করার প্রহর গুনতে হয়েছিল। কিছু মানুষ টাকার যোজন-বিয়োজন ঘটাতে ঘরের বাইরে জড়ো হতো। কেউ হয়তো ঘরে বন্দী জীবনযাপনে অনভ্যস্ত হয়ে অস্থিরতায় দিন পার করত!
সর্বোপরি প্রাণোচ্ছ্বল ধারার হাসিটুকু বিলীন হয়ে গিয়েছিল কর্মময় জীবনবোধ থেকে। সবই যেন অসৌন্দর্যের অমোঘ বার্তা নিয়ে আসত। চাকরি করি বলে হয়তো আতঙ্কিত সময়টা আরও বেশি তাড়া করে বেড়াত। প্রতিদিনের কর্মক্ষেত্রটি বিষণ্নতায় ঠেকে।
চিন্তিত মনে অনুভব করতাম, কষ্টে মোড়ানো বিষণ্ন দিনগুলোর যাপিত জীবন।
যাপিত জীবনে চিরচেনা সিলেট শহরটাকে অস্ফুট মনে হতো। বিষমতার কোনো সীমানা নেই বলে আতঙ্কিত হয়ে অফিসে ছুটে যেতাম। মনে হয়েছিল, অস্পৃশ্যতার নগ্নরূপ এখানেই সমর্পিত! অগ্রাহ্যবাদের মধ্যে কর্মব্যস্ততার জন্যই অফিসে ছুটে চলা। কোনো দিন অফিস থেকে ছুটি পেলেও পরদিনই আবার অফিসে। মাঝেমধ্যে অবুঝ মনটাকে বুঝানো দায় হয়ে পড়েছিল। তারপরও বিষণ্নতার মধ্যে ছাপিয়ে যায় দিনগুলো। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস কিংবা চোখে চশমা পরে নিজেকে আর বদ্ধ করে রাখতে পারছিলাম না। সবটুকু সামলে নিয়ে অফিসে কোনোভাবে কাজ চালিয়ে যেতাম। অস্বস্থিতে ভরপুর মনটাকে ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে স্তিমিত করে রেখেছিলাম।
তারপরও ভালোবাসার স্পন্দনে খুঁজে পেয়েছিলাম প্রাণের পরশ। বিষণ্ন মনকে সান্ত্বনার আটপৌরে যাতনা থেকে বেরিয়ে আসার বৃথা চেষ্টায় নিমজ্জিত রাখতাম।
পরিস্থিতি বিবেচনায় অফিসে মধ্যাহ্নভোজনটুকু সেরে নেওয়ার সাহস হয়ে উঠত না। মাঝেমধ্যে তৃপ্তির ঢেকুর নেওয়ার জন্য অল্প অল্প পানি পান করে অফিসে নিজের স্থিতিটুকু প্রকাশে পারঙ্গমবোধ করতাম। মহামারির অস্বস্তিতে যাপিত জীবন এভাবেই তাড়া করে বেড়াত।
একরকম অগোছালোভাবেই অফিস থেকে বাসায় ফেরা হতো। যাতনায় ছেয়ে আসত প্রতিটি মুহূর্ত! প্রয়োজনে বাসার কাজটুকু সেরে নেওয়ার তাগাদা অনুভব করলেও পরক্ষণেই আবার পিছু হটে থাকি। কেমন যেন হইহুল্লোড়ের জায়গাটুকু নিস্তব্ধতায় পতিত। রাস্তার পাশে দু–একটা চায়ের দোকান চোখে পড়লেও মানুষের তেমন আনাগোনা পরিলক্ষিত হতো না। তবে দেখে যেন মনে হতো মানুষ আতঙ্কের মধ্যে থাকতে থাকতে একটু বিরাম নিতে চাইছে। তাই হয়তো এত আতঙ্কের ধারা আর তাদের মধ্যে বিরাজ করত না। কখনো–বা চিন্তিত মনে প্রবল ভাবাবেগে নিজেকে আলাদা করে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেত। দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে আমিও একটু এগোতাম। ভাবতাম, অফিসে কাজ করতে পারলে বাইরে চলাফেরায় ক্ষতি কী! এভাবে নিজেই নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে বাসায় ফেরার চেষ্টায় থাকতাম।
অগোছালোভাবে মনের গহিনে তৈরি নেই সান্ত্বনার অভয়বার্তা। ভাবতাম, মনের গহিন আর কয় দিন তাড়া করে নিয়ে যাবে জগৎময়। আবার কখনো ভাবতাম, এ জগৎই নাকি বিচিত্র। ছন্দময় এ জীবন থেকে হারিয়ে গেছে অনেকটি সুন্দর জীবনের প্রতিক্ষণ। যে প্রতিক্ষণের আভা এসে জড়ো হয় প্রতিদিনের গ্লানিতে। আতঙ্ক কিংবা যাতনা আবারও গ্রাস করবে ধূসর পৃথিবীর অসম আঁধারে। তাই মাঝেমধ্যে শুনতে পাই, আঁধারের অতলে হারিয়ে গেছে অসংখ্য ভালোবাসার স্থান। কেউ কেউ রিক্ত হস্তে ধারণ করে আছে ভালোবাসার স্মৃতিময় প্রহর। বেদনাহত হয়ে আসে মহামারিতে ফেলে আসা আতঙ্কিত মুহূর্তগুলো।
মহামারির আতঙ্কে আঁধারের মধ্যে খুঁজে ফিরি আলোকিত রূপ। তাই মাঝেমধ্যে আঁচ করি কাছের মানুষের হৃদ্যতার কথা। আপনজনের হৃদ্যতার স্পর্শে খুঁজে পেতাম প্রাণের স্পন্দন। অনেকটি দিন পার হলেও বাড়িতে যাওয়া হতো না। জীবনের এ ক্রান্তিকালে বারবার পিছু ফিরে ভেসে আসত বাড়ির কাছের মানুষগুলোর কথা। ফোনের মাধ্যমে বাড়ির খবর নিয়ে বুঝতে পারতাম তাদের বিষণ্নতা। অনুভব করতাম, তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা! মাঝেমধ্যে মনে হতো, ফোন নামের বিশেষ যন্ত্রটা না থাকলে আমাদের হয়তো বিষম যন্ত্রণা পোহাতে হতো।
ক্ষণকালের তরে এসে ভাবতাম, ‘হয়তো থেমে আসবে একদিন দুর্যোগের ঘনঘটা। মুখর হয়ে আসবে এ পৃথিবী, আমরা আবারও ফিরে পাবœস্নিগ্ধতায় মোড়ানো ভোরের আলো। যে ভোরের আলোকে নিজেদের দ্বারে রুদ্ধ করে রুখতে যাব না। আবারও শুনতে পাবো পথচলার ডাক। বিহঙ্গগুলো খোলা আকাশের নিচে আপন মনে খেলা করবে। দেখতে পাব, সুন্দর জীবনের প্রতিচ্ছবি, ফিরে পাব সুন্দর ধরণী। তখন হয়তো নিজেদের আবিষ্কার করতে পারব অন্য এক আলোকিত জীবনের বাঁকে...!’
তারপরও আশাজাগানিয়ার দোলাচলে জেগে থাকবে পৃথিবীর চিরচেনা সৌন্দর্যের অবয়বে। ভাবি, আবারও প্রাণের পরশে জেগে উঠবে সুন্দর পৃথিবী যেখানে ধারণ করবে প্রাণের প্রেমাঞ্জলি। কখনো ভাবি, এ পৃথিবী জেগে থাকবে তোমাদের অসীম মমতায়। গদ্যময় রাজ্যের ধূসর পৃথিবীটি আবারও স্থান করে নেবে কাব্যিক ব্যঞ্জনাময় রাজ্যের অবারিত ধারায় সৌন্দর্যের আনন্দলোকে।
লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংক