আম্র রাজধানীর আম: শঙ্কা-সম্ভাবনা

বহু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট পেরিয়ে ছোট সোনামসজিদ। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে তৎকালীন সেন বংশের রাজা লক্ষ্মণ সেনের পেছনের দরজা দিয়ে পলায়নের ঐতিহাসিক যে কাহিনি রচিত, সে কাহিনির চিত্রভূমি এ অঞ্চল। এই গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী (লখনৌতিও বলা হয়) ছিল ওই সময়ে দিল্লির সুলতানদের অধীনে বাংলার রাজধানী। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাংলাদেশের আমের রাজধানী হিসেবে খ্যাত। বৈচিত্র্যময় আমের জন্য খ্যাতি রয়েছে এ জেলার। বাংলাদেশে যেসব স্থানে আম চাষ হয়, তার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম জাত, স্বাদ, সুগন্ধ ও আকৃতিতে অনন্য। এ এলাকাতেই তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ জাতের আম উৎপাদিত হয়। দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে বেশি আমগাছ এখানে। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৩০ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়ই উৎপাদিত হয় প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন। আম উৎপাদনে সব সময় শীর্ষে এ জেলা। এসব দিক বিবেচনা করেই চাঁপাইনবাবগঞ্জকে আমের রাজধানী বলা হয়। ফলের রাজা আম আর এই আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আম অর্থকরী ফল। আম অর্থনীতি নিয়ে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। অন্যদিকে আমগাছ, আম উৎপাদন, বিপণন ও ভোক্তাদের আচরণ নিয়ে বিভিন্ন সংকট-শঙ্কার পরিবেশও লক্ষ করা যাচ্ছে। এসবেরই বয়ান-বিবরণী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এখানে।

আম্রকাননের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম্রকাননের ইতিহাস জানতে হলে জেলার ইতিহাস জানা প্রয়োজন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছিল প্রাচীন গৌড়ের অংশ। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী জেলা। প্রাক ব্রিটিশ যুগ পর্যন্ত নবাবদের বিহারভূমি। ১৮১৩ সালে পূর্ণিয়া ও দিনাজপুর জেলা ভেঙে মালদাহ জেলা গঠিত হয়। তবে ১৮৫৯ সালের আগপর্যন্ত মালদাহ জেলাকে কোনো কালেক্টরের অধীনে দেওয়া হয়নি। শিবগঞ্জ থানার অধীনে নবাবগঞ্জের জন্য বারোঘেরিয়ায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। ১৮৭৩ সালে মুনসেফ চৌকি শিবগঞ্জ থেকে নবাবগঞ্জে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৯৯ সালে নবাবগঞ্জকে থানায় উন্নীত করা হয়। ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চল রাজশাহী জেলার অন্তর্গত ছিল এবং বিহারের ভগলপুর বিভাগের অধীনে ছিল ১৯০৫ সাল পর্যন্ত। ১৯০৩ সালে নবাবগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হয়। আবার ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা, আসাম প্রদেশসহ এ অঞ্চল রাজশাহী বিভাগের অধীনে করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর শিবগঞ্জ, নাচোল, ভোলাহাট ও গোমস্তাপুর থানা মালদহ জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪৮ সালের ১ নভেম্বর রাজশাহী জেলার একটি থানা এবং দিনাজপুরের ‘পোরশা’ থানাসহ নবাবগঞ্জ মহকুমা গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই নবাবগঞ্জকে পৃথক জেলা করার দাবি ওঠে। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ নবাবগঞ্জ মহকুমা বর্তমান পাঁচটি থানা নিয়ে জেলায় উন্নীত হয়। ২০০১ সালের ১ আগস্ট নবাবগঞ্জ নাম পরিবর্তন করে জেলার নাম রাখা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ (বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ২০১৪, বাংলা একাডেমি, ঢাকা)।

আমের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, নবাব আলিবর্দি খাঁর (১৭৪০-১৭৫৬) আমলে নবাব ও তাঁর কর্মচারীরা পদ্মা নদী দিয়ে শাখানদী মহানন্দা হয়ে আমোদ-প্রমোদের জন্য এ এলাকায় আসতেন। নবাবেরা প্রায়ই এখানে যাতায়াত করতেন বলে এ জেলার নাম নবাবগঞ্জ হয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। আম নবাবদের অত্যন্ত প্রিয় হওয়ায় এখানে আমবাগান গড়ে ওঠে। এ জেলায় আমবাগান ও আমনির্ভর সংস্কৃতি গড়ে ওঠার পেছনে বর্তমান ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলের প্রভাবও রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অতি প্রাচীনকাল থেকেই আম চাষ হয়ে আসছে। প্রখ্যাত সাধক কবি আমীর খসরুর কাছে আম হিন্দুস্থানের সেরা ফল। আম শুধু এ উপমহাদেশে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও সুমিষ্ট নয়, তা আজ বিশ্বসেরা।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে আলেক্সান্ডার একের পর রাজ্য দখল করে সিন্ধু উপত্যকায় এসে আমবাগান দেখে মুগ্ধ হন অর্থাৎ ওই সময়ও আমবাগানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ভারতে পাল রাজাদের আমলেও আম চাষ হতো। তবে মোগল আমলে আম চাষের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। আম চাষ প্রাচীনকাল থেকে হলেও মুঘল সম্রাট আকবর প্রথম ভারতের ডারভাঙ্গা নামক স্থানে বিভিন্ন জাতের এক লাখ আমের চারা লাগিয়ে আমবাগান করেছিলেন। আজও যা ‘লাখবাগ’ বা ‘লাখবাগান’ নামে পরিচিত। একসময় অবিভক্ত ভারতের প্রদেশ/বিভাগ/জেলা/অঞ্চলের অধীনে ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সেহেতু ওই সব অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে অবাধ যাতায়াত এবং হৃদিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল। এর ফলে এ জেলার মানুষ আম চাষে পরিচিত ও উৎসাহী হয়ে ওঠে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে গাছে ঝুলছে মিয়াজাকি আম।
ছবি: আনোয়ার হোসেন

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের বৈচিত্র্যময় জাত!

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩০০-৩৫০ জাতের আম উৎপাদিত হয়। সংখ্যাগত বিচারে নয়, স্বাদেও অন্যান্য জেলার চেয়ে উৎকৃষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম। সব আম বাজারজাত হয় না। ‘রানিপছন্দ’ আম বাজারে পাওয়া যায় না, কদাচিৎ দু–একটা গাছ দেখা যায়। কোনো এক রানি ওই সুমিষ্ট আম পছন্দ করতেন বলে ‘রানিপছন্দ’ নাম হয়েছে বলে ধারণা প্রচলিত আছে। এ রকম নানা ধরনের বাহারি নাম ও জাতের আম আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে হিমসাগর (ক্ষীরশাপাতি), গোপালভোগ, লক্ষ্মণা, ল্যাংড়া, ফজলি, আশ্বিনা আমের চাষ হয় বেশি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে অন্যান্য প্রধান সুমিষ্ট জাতের আম হচ্ছে ক্ষীরভোগ, মোহনভোগ, রাজভোগ, রানিভোগ, সিন্দুরা, সুবর্ণরেখা, কুয়াপাহাড়ি, নাকফজলি, ফজলি, চিনি ফজলি, সুরমাই ফজলি, চিনি মিসরি, জগৎমোহিনী, রাখালভোগ, রাঙাগুড়ি, গোবিন্দভোগ, তোতাপুরি, মিশ্রিকান্ত, জালিবান্ধা, বোম্বাই, ভুতো বোম্বাই, পাহাড়িয়া, কাকাতুয়া, দাদভোগ, চম্পা, সূর্যপুরী, কাঁচামিঠা, কলামোচা, শীতলপাটি, লক্ষ্মণভোগ, গোলাপবাস, কিষাণভোগ বান্দিগুড়ি, রাংগোয়াই, আশ্বিনা, ভাদুরিগুটি, বনখাসা, বউ ফুসলানি, ক্ষীরমণ, দুধসর, রঙভিলা, পারিজা, আনোয়ারা, দিলশাদ, আম্রপালি, মল্লিকা, বেগমবাহার, পূজারিভোগ, পলকপুরী, রাজলক্ষ্মী, দুধকুমারী ইত্যাদি।

হাইব্রিড প্রকৃতির আম প্রবেশ করছে দেশে। এক যুগ আগে আম্রপালি আমের উদ্ভাবন আম চাষে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এখন দেশের মোট উৎপাদিত আমের ৪০ শতাংশ এই জাতের। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে আম্রপালির ব্যাপক হারে চাষ বেড়েছে।

সারা বছর আম!

ব্যক্তি উদ্যোগে ২০০৮ সাল থেকেই বরোমাসি জাতের আমও চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিভাগ উচ্চফলনশীল ও প্রতিবছর ফল প্রদানে সক্ষম ১২টি জাত উদ্ভাবন করেছে। বারি উদ্ভাবিত আমের উচ্চফলনশীল জাতগুলো হলো বারি আম-১, ২ ও বারি আম-৩ (আম্রপালি), ৪ (হাইব্রিড); ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০ ও বারি আম-১১ (বারোমাসি) এবং বারি আম-১২ (নাবি জাত)। বারি-১১ বারোমাসি আম। বছরে তিনবারের বেশি ফলন আসে বারি-১১ জাত থেকে। থাই বারোমাসি আমও হচ্ছে মেহেরপুরের জীবননগরে।

ভিয়েতনামি ‘গোল্ডেন ম্যাঙ্গো’ বারোমাসি আম হচ্ছে শিবগঞ্জের বালুটুঙ্গি গ্রামে। চারা লাগানোর তিন থেকে চার বছরের মধ্যে প্রায় প্রতিদিন এ আম সংগ্রহ করা যায়।

লোকায়ত জ্ঞান ও লোকায়ত বিশ্বাস

আম উৎপাদন, আমবাগান, আম সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণন নিয়ে আমের রাজধানীতে প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও লোকায়ত জ্ঞান। ‘আমের আনা, মাছের পাই থাকলে কে কত পাই’—আম মৌসুমে এ বচনটি চাঁপাইবাসীর মুখে মুখে। আমগাছে যত মুকুল আসে, তার ষোলো ভাগের এক ভাগ পরিমাণ আম টিকে থাকে। আর এক ভাগ পরিমাণ আম টিকলেই বাম্পার ফলনের তুষ্টি বাগানের মালিক ও ব্যবসায়ীদের। ‘আমে ধান, তেঁতুলে বান’ অর্থাৎ আম রাজধানীর বাসিন্দাদের বিশ্বাস হচ্ছে, যে বছর আমের ফলন বেশি, সে বছর ধানের ফলনও ভালো হয়। অন্যদিকে তেঁতুল উৎপাদন বেশি হলে, সে বছর ‘বান’ অর্থাৎ বন্যা হয় বেশি। আম নিয়ে ওই অঞ্চলে প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া-কৌতুক ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এসব সেখানকার মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক সঙ্গে আন্তসম্পর্কিত। যেমন দুরন্ত শিশুরা আম্রকাননের শীতল ছায়ায় দুরন্ত খেলায় মেতে ওঠে। কিন্তু কোনো আম তারা সাধারণত গাছ থেকে পাড়ে না। কোনো প্রতিরোধক ব্যবস্থা তাদের নিবৃত্ত করেছে আম পাড়া থেকে? প্রতিরোধক হচ্ছে তাদের লোকায়ত বিশ্বাস। একজন আম পাড়তে উদ্যত হলে অন্যজন উচ্চারণ করে সতর্কবাণী জেল খাটতে হবে। যে আকৃতির আম পাড়া হবে পরবর্তী বছরগুলোতে, সে আকৃতির আম না হওয়া পর্যন্ত জেল খাটাতে হবে—এটাই তাদের বিশ্বাস। বাস্তবে এমন আইন বাংলাদেশে কি আছে? নেই, অথচ শিশুদের লোকায়ত এ বিশ্বাস যুগ যুগ ধরে আমের পাহারাদার হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করছে। আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের সংস্কৃতির অঙ্গ ও অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কাঁচা ও পাকা আম দিয়ে তৈরি করা হয় নানা রকম সুস্বাদু খাবার। কাঁচা আমের বিভিন্ন রকম আচার দেশব্যাপী খুবই জনপ্রিয়। গোটা আচার, কুচি আচার, সিরকা আচারসহ আরও কত ধরনের আমের আচার আছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। কাঁচা আমের রান্না ও কলাইয়ের ডাল কে না খেতে চায়! ‘ড্যাইলে হামচুর’ অর্থাৎ ডাল আমচুর দিয়ে রান্নার বিষয়টিকে প্রকাশ করতেই এ কথা বলা হয়। কাঁচা আম চিরে তা রোদে শুকিয়ে ‘আমচুর’ বানানো হয় এবং তা সারা বছর সংরক্ষণ করা যায়। আমকেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও লোকায়ত বিশ্বাস আমবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এসব লোকায়ত বিশ্বাস ও সংস্কৃতি আজ হুমকির মুখে পড়েছে। কেননা ব্যবসায়ীরা রাসায়নিক দিয়ে আম পাকাচ্ছে। এর ফলে আমের প্রকৃত রং, স্বাদ নষ্ট হচ্ছে, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। মিশ্রণকারীদের যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ করতে হবে। তাহলেই আমের উৎপাদন, স্বাদ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় থাকবে।

বাগানমালিকেরা হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত

সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগানের মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিভিন্নভাবে। আমের দাম পাচ্ছেন না তাঁরা। কিছু জেলার আম আগেই বাজারে আসছে। অন্যান্য জেলার অপরিপক্ব আমেও ঢাকাসহ আম বাগানহীন অঞ্চলের বাজার সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। দামের দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে জেলার বাগানমালিকেরা। সাধারণত মৌসুমের শুরুর দিকে আমের চাহিদা এবং দাম বেশি থাকে। দাম বেশি থাকে মৌসুমের শেষের দিকেও। অথচ শুরুর দিকে সাতক্ষীরাসহ ওই অঞ্চলের আম বাজারে আসছে আগে এবং শেষের দিকে আম বাজারে আসে দিনাজপুর ও নওগাঁ জেলার আম। ফলে রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানসম্পন্ন আম উৎপাদন করেও আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারছেন না বাগানমালিকেরা।

আমগাছ মরে যাচ্ছে

ভারত থেকে চোরাই পথে আসা ‘কালটার’ নামক হরমোন প্রয়োগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাতা ও আগা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে শত শত আমগাছ (ইত্তেফাক, ১৩ জানুয়ারি ২০১৩)। কালটার বা প্যাকলোবিউট্রাজল উদ্ভিদের একধরনের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক রাসায়নিক। এটি তরল বা পাউডার উভয় অবস্থাতেই পাওয়া যায় (প্রথম আলো, ১ জুন ২০১৬)। এই রাসায়নিক দেশে উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। অথচ এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ৫০ শতাংশ বাগানে, গোমস্তাপুরে ৩০ শতাংশ, সদরে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ এবং নাচোলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আমগাছে এই কালটার ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বাগানমালিকেরা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। অর্থলোভী আমবাগান ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় গাছের গোড়ায় এ হরমোন প্রয়োগ করছেন। বাগানমালিকদের আর্থিক সংকটের সুযোগ নিয়ে সাধারণত কয়েক বছরের জন্য আমবাগান লিজ নিয়ে থাকেন। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী আমবাগানে এক বছর ফল ধরলে পরের বছর ধরে না। আর এ জন্যই আমবাগানের ক্ষেত্রে ‘অফ ইয়ার’ ও ‘অন ইয়ার’ কথাটি প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর ফল ধরানোর জন্য ভারত থেকে চোরাইপথে আসা ‘কালটার’ আমগাছের গোড়ায় প্রয়োগ করছেন। এটি ব্যবহারে স্বল্প মেয়াদে ফলের উৎপাদন বাড়লেও দীর্ঘ মেয়াদে কমে যায়। গাছের পাতা ধীরে ধীরে শুকিয়ে ঝরে যায়, ডাল মরে যায়। আমের আকৃতিও আস্তে আস্তে ছোট হয়ে ওঠে। গাছে নতুন পাতা গজানো বন্ধ হয়ে যায়। কালটার পরিণতিতে পাতা ও আগা শুকিয়ে এক বছরের মধ্যে মরে যাচ্ছে আমগাছ। আমবাগানে এমন মরা আমগাছ এখন দেখা যায়। যদিও এক শ বছরেও আমগাছ মরে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমসম্পদ হুমকির মুখে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে চাঁপাইবাসীর জীবন-জীবিকা।

এ ছাড়া আইন ভঙ্গ করে যত্রতত্র ইটভাটা নির্মাণ আমবাগানের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। আমবাগানের পাশে একটার পর একটা ইটভাটা নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রশাসন রয়েছেন নির্বিকার। ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া আমের ফলন কমিয়ে দিচ্ছে, গাছের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।

আম সংগ্রহ ও বিপণন

আমের মৌসুম প্রায় পাঁচ মাস। এর মধ্যে জুন ও জুলাই মাস আমের ভরা মৌসুম। ১৫ মে থেকে ভালো জাতের আম বাজারে আসে, চলে আগস্ট পর্যন্ত। আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোতে সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন বাগান থেকে আম সংগ্রহ ও বিপণনের দিনক্ষণ ঠিক করে দিচ্ছে। এসব দিনক্ষণ নির্ধারণ করা ঠিক নয়। কারণ প্রতিবছর আমের মুকুল আসে এবং সেই অনুযায়ী পরিপক্ব হয়। আবহাওয়া ও জলবায়ুর অর্থাৎ শীত, গরম বা বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে আমের প্রজনন ও পরিপক্বতা। স্বাভাবিক সময়ে গোপালভোগ পরিপক্ব হয় ২৫ মে থেকে। ক্ষীরশাপাতি ৭ জুনের আগে পরিপক্ব হয় না। ল্যাংড়া ১৫ জুনের আগে বাজারে আসা উচিত নয় হয়তো কিন্তু এটা নির্ভর করে এলাকা, আবহাওয়া-জলবায়ু ও আমগাছভেদে। সরকারি প্রশাসন থেকে নির্ধারণ করা হলো একটা তারিখ আম নামানোর কিন্তু এমন গরম পড়ল যে ওই তারিখের আগেই আম পাকা শুরু হয়ে গেছে বা পাকা আম ঝরে যাচ্ছে। কী হয় তখন? আমবাগানিরা সঠিক সময়ে আম নামাতে না পারায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ রকম অবস্থা কিন্তু ঘটেছে অনেকের ক্ষেত্রে। একসময় যখন যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মিত হয়নি, তখন ফেরি পারাপারে দীর্ঘ জট থাকায় ফেরিঘাটে ট্রাকভর্তি আম নিয়ে অপেক্ষা করতে হতো, আম ঢাকায় আসার অগেই পচন ধরত। এখন রাস্তায় আম পচে না কিন্তু বাগানে আম ঝরে বা নষ্ট হয় সঠিক দাম না থাকায় বিক্রি না হওয়ায়।

ঢাকাসহ দেশের শহরগুলোতে ফলের দোকানে আধিপত্য এখন আমের। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন আম বিক্রিকে

আম্র রাজধানী ছাড়িয়ে সারা দেশে আমবাগান

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে গত ১৮ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হারে আমের চাষ বেড়েছে বাংলাদেশে। বছরে ১৬ শতাংশ হারে আমের উৎপাদন বাড়ায় এর মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। ১০ বছর আগে বিশ্বের আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দশম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে ভিয়েতনাম আর ফিলিপাইনকে ছাড়িয়ে অষ্টম থেকে ষষ্ঠ স্থানে উঠে এসেছে।

আম উৎপাদনে সব সময়ই শীর্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। শুধু ২০২০ সালে আম উৎপাদনের শীর্ষে নওগাঁ জেলা স্থান পায় (কালের কণ্ঠ, ৬ জুন ২০২০)। প্রাকৃতিক কারণে আমের উৎপাদন ভালো হয়নি গত বছর। এক সময় আমবাগান ছিল শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জে। এরপর রাজশাহী থেকে উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলায় আম চাষ শুরু হয়। বর্তমানে ৩০টির বেশি জেলায় আমের চাষ হচ্ছে। ছাদবাগানেও টবে আমগাছ লাগানো হচ্ছে, যদিও তা বাণিজ্যিকভাবে চাষ নয়।

আম অর্থনীতির সম্ভাবনা

ক. আম রপ্তানি: চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আম রপ্তানি শুরু হওয়াই আম এখন গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফল। বিশ্বে আম উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ হলেও এখানে আধুনিক পদ্ধতিতে আম চাষ ও উন্নত বিপণনব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় পর্যাপ্ত আম রপ্তানি হচ্ছে না। আমকে রপ্তানিযোগ্য করে এসব সমস্যার সমাধান করা হলে উৎপাদিত আম বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৩ সালে নাচোলের বাগান থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সুইডেনে সীমিত আম প্রথম রপ্তানি করা হয়। পরের বছর থেকে ইউরোপের বৃহৎ বাজারে দেশ থেকে আম রপ্তানি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে (উত্তরের বাতায়ন: চাঁপাই নবাবগঞ্জ, ২০১৮, জাহাঙ্গীর সেলিম)। আম রপ্তানি সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে। আম রপ্তানি বৃদ্ধিতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা, যা চাঁপাইবাসীর স্বপ্নের দ্বার খুলে দেবে।


খ. আমের খাবার ও আচার: সারা দেশে আমের আচার, আমসত্ত্ব, জুস, জ্যাম-জেলি এবং আম দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের বড় চাহিদা রয়েছে সারা দেশে সারা বছর। এসবের বড় বাজার তৈরি হয়েছে। বড় কোম্পানিগুলো এসব তৈরি করছে। বিদেশে রপ্তানিও করছে। বিদেশেও আম দ্বারা তৈরি খাদ্যপণ্যের বাজার তৈরি ও ব্যাপকভাবে রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেসব আম দ্বারা তৈরি খাদ্যপণ্যের মান নিয়ে শঙ্কাও আছে। কাঁচা ও অপরিপক্ব আম সংগ্রহ ও সংরক্ষণে রাসায়নিক ব্যবহৃত হচ্ছে।


গ. আম ট্যুরিজম: চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমবাগান ও আমকেন্দ্রিক পর্যটন আরেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। গাছপাকা আম খাওয়ার সাধ, সাধ্য ও সৌভাগ্য অন্য আমবাগানহীন জেলার বাসিন্দাদের কয়জনেরই–বা আছে! এলাকার বিভিন্ন জাতের আমের মধ্যে ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরশাপাতি, হিমসাগর ও রাজভোগ কতই না সুমধুর! খাবার আগেই জিবে পানি আসে। যেন কবি ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্তের কবিতায় বর্ণিত ‘তপসে মাছ’। খেতে বসে চোখ বুজে আসে। আর যদি আমটি হয় গাছপাকা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে প্রবেশ করতে গেলে আমগাছ পর্যটকদের বরণ করে নেয়। শহরের মধ্যেও সম্ভাষণ জানায় সারি সারি আমগাছ। শহর ছাড়িয়ে যেদিকে যাবে, সেদিকেই দৃষ্টিনন্দন আম্রকানন। রাস্তার দুই ধারে আমগাছগুলো ডালপালা মেলে আছে। গাছের সর্বাঙ্গে মাটির দিকে মিতালির অপেক্ষায় অপরূপ ভঙ্গিতে ঝুলে থাকে আম। কোনো কোনো গাছের আম ঝুলে মাটি চুম্বনও করে। আম্রকাননের সৌন্দর্য পুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জকে প্রকৃতির অনন্য পার্কে পরিণত করেছে। তাই আমবাগানকেন্দ্রিক ট্যুরিজমকে জনপ্রিয় করতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন রিসোর্ট বা হোটেল-মোটেল স্থাপন জরুরি। সোনামসজিদের পর্যটন মোটেল আম ট্যুরিজমের দ্বার খুলে দিয়েছে। প্রয়োজন উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।

ঘ. অনলাইনে আম: অনলাইনে আম বিক্রি দেশের আম অর্থনীতিতে আরেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। রাসায়নিকমুক্ত আম খেতে অনলাইনে ভোক্তার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আম অত্যন্ত ‘সেনসিটিভ’ ফল। আম ওঠানো–নামানোর সময় আঘাত পেলে তার স্বাদ নষ্ট হয়, টক হয়ে যায় বা পাকার সময় পচে যায়। কুরিয়ার সার্ভিসে আম পরিবহনে বস্তা বা কার্টনে আঘাত হরহামেশাই লাগে। কারণ, আম ওঠানো-নামানো করা শ্রমিকেরা আমের ‘সেনসিভিটি’ সম্পর্কে সচেতন নন।

সতর্কতা ও সুপারিশ

ক. আমে রাসায়নিক বন্ধে প্রয়োজন পদ্ধতিগত রসায়ন! আম নিয়ে চলছে বাণিজ্যিক প্রতারণা! আম পাকানো হচ্ছে রাসায়নিক দিয়ে। স্বাদ ও খাঁটিত্বের চেয়ে রং ও সৌন্দর্য প্রাধান্য পাচ্ছে। কারণ, ক্রেতা দেখতে সুন্দর আম চান। এ জন্য ব্যবসায়ীরা আমগাছ থেকে নামিয়েই রাসায়নিক ছিটান। এতে আমবাগান থেকে নামিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোমাত্রই রাসায়নিক মিশ্রিত পাকা আম বিক্রি করা যায়। কারণ, ক্রেতা কাঁচা আম কিনতে চান না। তাঁরা জানেন না যে বাগানের পাকা আম দূরদূরান্তে পরিবহন করা যায় না, পরিপক্ব হয়ে উঠলেই কাঁচা আম পাঠাতে হয়। কিন্তু ক্রেতা কেনার সঙ্গে সঙ্গেই আম খেতে চান। ব্যবসায়ীরা সে জন্য রাসায়নিক দিয়ে ট্রাকে ভরে দেন আম। ঢাকা বা দূরের জেলায় যাওয়ার পরপরই পাকতে থাকে ওই রাসায়নিক ছিটানো আম। কিন্তু ঢাকা বা অন্যান্য জেলার আমবাগানহীন বাসিন্দারা বিষয়টি না জানার কারণে তাঁরা আম খাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন পরিপক্ব হওয়ার আগেই। বিশেষ করে ঢাকাবাসীরা আম কেনার পরপরই খেতে চান। আমে রাসায়নিক দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ধ্যায় পাঠানো আম সকালে ট্রাক থেকে নামানো হয়, তখন সব আম পেকে যায় প্রায় একসঙ্গে। গাছ থেকে কাঁচা আম নামানোর পর রাসায়নিক দিলে আমের রং আরও সুন্দর হয়, আর একসঙ্গে পাকে। ঢাকার আড়তদারররা ট্রাক থেকে আম নামিয়েই খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে দেন। আবার কোনো কোনো আড়তদার কাঁচা আম আড়তে পাকান। পাকা আম ছাড়া খুচরা ব্যবসায়ীরাও নিতে চান না। এ জন্যই এভাবে রাসায়নিক যুক্তকরণ! আমি আম ব্যবসায়ীদের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে এমন জবাব পাই। তাহলে কী বলবেন? চাহিদাও দায়ী নয় কি? অবশ্যই এটাও কারণ।

আমি আমের রাজধানীতে থেকেও যখন আম খেতে শুরু করিনি, তখন দেখি ঢাকার বন্ধুরা দেদার আম খাচ্ছেন! হ্যাঁ, না জানার কারণে এমন চাহিদা তৈরি হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ নিচ্ছেন। তাঁরা জানেন না যে প্রাকৃতিকভাবে কোন আম কখন পাকে, কীভাবে পাকে এবং পরিপক্ব আম ঘরে রেখে কীভাবে পাকাতে হয়। রাসায়নিক ছিটালে পরিপক্ব আমের স্থায়িত্ব পাঁচ–ছয় দিন থাকে। এরপরই পচন ধরে। কিন্তু পরিপক্ব আম রাসায়নিক ছাড়া পাকতে কয়েক দিন লাগে এবং দশ–বারো দিন ধরে খাওয়া যায়। কারণ, একই গাছের সব আম একসঙ্গে পাকে না। কিন্তু রাসায়নিক মিশ্রিত আম একসঙ্গে পাকে, রং ও সৌন্দর্যে আকর্ষণীয় হয়। তবে এসব আম দেখতে ভালো মনে হলেও খেতে মোটেও সুস্বাদু, রসাল ও সুগন্ধিযুক্ত হয় না। ক্রেতার চাহিদার কারণেই অসাধু আম ব্যবসায়ীরা গাছ থেকে অপরিপক্ব আম নামিয়ে কারবাইড বা ওই জাতীয় রাসায়নিক প্রয়োগ করে থাকে। মৌসুমের শুরুতেই অপরিপক্ব আমও রাসায়নিক দিয়ে পাকা আমের নামে অপুষ্ট আম তুলে দেন ব্যবসায়ীরা। সব জাতের আম একই সময়ে পরিপক্ব হয় না। আবার এক এলাকার চেয়ে আরেক এলাকার আমের পরিপক্বতার সময়ের মধ্যেও পার্থক্য থাকে। যেমন সাতক্ষীরা জেলার আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের আগে পরিপক্ব হয়। বান্দরবান এলাকায় উৎপাদিত আম্রপালি আম দেশের অন্যান্য অঞ্চলে উৎপাদিত আম্রপালি আমের চেয়ে অন্তত দুই সপ্তাহ আগে পরিপক্ব হয়ে বাজারে আসে।

আমের মৌসুমে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাটগুলো জমজমাট হয়ে ওঠে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফড়িয়ারা গিয়ে সেখান থেকে আম কেনেন

আমের বৈশিষ্ট্য হলো আম গাছে থাকা অবস্থায় বা কাঁচা সবুজ আম নামানোর পর একসঙ্গে পাকে না। আম পরিপক্ব হলে বা গাছে একটি-দুটি পাকতে শুরু করলেই (চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষায় ‘দ্যাখা দেওয়া’ বলে) আম গাছ থেকে নামানোর নিয়ম। এসব বন্ধে সারা দেশে আমসম্পদকে নিয়ে ভাবতে হবে। আমের পরিপক্বতাই হবে প্রধান মাপকাঠি। ক্রেতাদের পাকা আম নয়, পরিপক্ব আম কিনতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন আম নিয়ে সরকারের পদ্ধতিগত পরিকল্পনার রসায়ন।

খ. হরমোন প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে: ‘কালটার’ হরমোন ব্যবহার সম্পূর্ণ অবৈধ এবং এর ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে এ জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। হরমোন প্রয়োগের পরিবর্তে জৈব সার ও গোবর প্রয়োগের মাধ্যমে আমগাছকে রক্ষা করতে হবে। বাগানমালিকদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে ব্যবসায়ীরা হরমোন প্রয়োগ করতে না পারে। আম চাষের জেলায় প্রচার চালিয়ে সচেতন করতে হবে।

গ. সব জাত সংরক্ষণ: বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ হওয়ার ফলে দেশি ও গুটি জাতের আম হারিয়ে যাচ্ছে। হাইব্রিড জাতের আমের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সাব্বির হোসেন তাঁর ‘জাতীয় বৃক্ষ আমগাছ’ গ্রন্থে ইতিমধ্যেই প্রায় ২০০ জাতের আম বিলুপ্তি ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বলে উল্লেখ করেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের সব জাত সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে।

ঘ. ট্যুরিজম: চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমকেন্দ্রিক ট্যুরিজম বিস্তারের পরিকল্পনা নিতে হবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম জাদুঘরও স্থাপন করা যেতে পারে। আমের ঐতিহ্য, আমের জাত সংরক্ষণ ও প্রদর্শন, আম উৎপাদনের পদ্ধতি, আম সংস্কৃতি ও আম দ্বারা তৈরি খাদ্যপণ্য প্রভৃতি বিষয় প্রদর্শন করা যেতে পারে।

গাছ থেকে অপরিপক্ব আম নামানো বন্ধ করতে হবে। দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা আমকেন্দ্রিক লোকায়ত জ্ঞান ও বিশ্বাসকে কাজে লাগাতে হবে। আমে রাসায়নিক ছিটানোর অবৈধ কর্ম কঠোরভাবে দমন করতে হবে সরকারি প্রশাসনকে।

ফরমালিনমুক্ত মাছের চাহিদা তৈরি হওয়ায় আজ আমরা বিষমুক্ত মাছ পাই বা জীবন্ত মাছ পাই। বিষমুক্ত আম খেতে কাঁচা পরিপক্ব ছাড়া আম কেনা যাবে না—এমন প্রতিজ্ঞা করতে হবে সবাইকে। বাগানমালিক, ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সচেতন করতে হবে, নিজে সচেতন হতে হবে। সর্বোপরি আম্র রাজধানীর বাসিন্দাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রয়োজনে আমবাগান মালিক অধিকার সুরক্ষা সমিতি/ফোরাম গঠন করতে হবে। তবেই রাসায়নিক মেশানোর অপসংস্কৃতি মুছে যাবে। রক্ষা করা যাবে আমনির্ভর অর্থনীতিকে।


লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।