আছ অনুভবে অনুক্ষণ
একসময় লজেন্স নিয়ে ওদের বাসায় যেতাম। রিপা তখন খুব ছোট ছিল। এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। লজেন্স, চিপস, চানাচুর—কী নেওয়া উচিত, ঠিক বুঝতে পারি না। পৃথিবীর নানা বিষয়ের খবর রাখে। আমার উপস্থিতি প্রত্যাশা করে। বাসায় গেলে খুশি হয়। শফিক প্রায়ই বাসায় থাকে না। অনেকটা সময় রিপার সঙ্গে গল্প করার পর তার দেখা পাই। অনেক ধরনের গল্প শোনে রিপা। কিন্তু ভাষার কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা ওর বেশি প্রিয়। ওকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ সব সংগ্রামের কথা বলেছি।
বিভিন্ন বইপত্র, আলোচনা–সমালোচনা শুনে ওর মনে অনেক প্রশ্ন। আমার মতো করে বোঝাতে চেষ্টা করি। মন দিয়ে শোনে।
সেদিন রিপাকে বললাম, ‘আমাদের দুটি প্রিয় সংখ্যার নাম বল তো।’
—এক শর্তে বলতে পারি।
—কী শর্ত?
—যদি ঠিক হয়, তাহলে একাত্তরের যুদ্ধদিনের কথা শোনাতে হবে।
—মানে?
—মানে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের মৃত্যু, বেঁচে থাকা, কষ্ট, আত্মত্যাগ ইত্যাদি।
—এত কিছু বলতে হবে না।
—কেন?
—কারণ, তুমি সংখ্যা দুটি বলতে পারবে না।
—আচ্ছা দুই মিনিট চাখ বন্ধ করুন।
—সংখ্যা বলতে চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?
—আহা করুন না? তবে দুই মিনিটসহ এক মিনিট বোনাস।
—আচ্ছা করলাম।
—এবার খুলুন।
জীবনের কিছু স্মৃতি খুব স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয়। কিন্তু তা অসাধারণ। এক মা গুলিবিদ্ধ শিশুর বুকে হাত রেখে কাঁদছেন। রক্তে ভিজে গেছে মায়ের হাত। শিশুর শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে নিচে। রিপা সেখানে লাল কালি দিয়ে লিখেছে ১৯৭১। আর একজন তরুণ ‘অ’, ‘ঙ’, ‘ক’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে লিখেছে ১৯৫২। এমন একখানা এ–ফোর সাইজের কাগজ মেলে ধরল চোখের সামনে। অপার বিস্ময়ে রিপার চোখে চোখ রাখলাম। ওর চোখ ভারী হয়ে আসছে। জল পড়ার সুযোগ না দিয়ে ওর একটি হাত চেপে ধরলাম। ‘রিপা, তুমি জিতে গেছ। এবার শোনো...।’
বউ শব্দ কইরো না—
বাংলাদেশের আকাশে তখনো ভোরের সূর্য ওঠেনি। ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর। একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে অস্ত্র পরিষ্কার করছে। হঠাৎ একটি বিকট শব্দ। গুলিটি গেল একমাত্র সন্তানের বুকের ভেতর দিয়ে। ফিনকি দিয়ে বের হলো রক্ত। বাঁচানোর শত চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না শিশুটিকে। মায়ের কোলে চোখ বন্ধ করল বিল্লাল। আকাশ–বাতাস কেঁপে উঠল মায়ের বুকফাটা চিৎকারে। হাতচাপা দিয়ে স্ত্রীর মুখ বন্ধ করলেন স্বামী।
১৯৭১ সালে আশরাফুল আলম ছিলেন শব্দসৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গেলেই তিনি অন্য রকম হয়ে যান। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। শিল্পকলা একাডেমিতে একদিন কথায় কথায় বলছিলেন, তখন সারা দেশে তুমুল যুদ্ধ চলছে। একদল মুক্তিযোদ্ধা একটি যুদ্ধে জয়ী হলো। ক্লান্তি দূর করার জন্য নরসিংদীর ভৈরবের একটি গ্রামে এমন একজন মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিল, চুরি ছিল যে মানুষটির বেঁচে থাকার অবলম্বন। অন্যের বাড়িতে থেকে চুরি করে তিনজনের সংসার চালাতেন। যেদিন চুরি করতে পারতেন না, সেদিন চুলা জ্বলত না। নিজেরা না খেয়ে ঘরে থাকা সবটুকু খাবার খাইয়ে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
নতুন আরেকটি যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিন ভোরে অস্ত্র ধোয়া-মোছার সময় গুলিতে ঝাঁজরা হলো তাঁদের একমাত্র সন্তানের পুষ্টিহীন বুক। মায়ের কান্নার শব্দে আকাশ–বাতাস ভেঙে পড়ছিল। বুক চাপড়াচ্ছিলেন একমাত্র সন্তানের জন্য। ফজলু মিয়া স্ত্রীর মুখ চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘এরাই তোমার পুত। এরা দ্যাশ স্বাধীন করতে পারলে মেলা পুত পাইবা। তুমি চেঁচামেচি করলে রাজাকার আর পাকিস্তানি মেলেটারি আইবে। এদের ধইরা নিব। দ্যাশ স্বাধীন হইবে না।’ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘বউ, শব্দ কইরো না। আমারও বড় কষ্ট ওইতাছে। বুকডা ছিঁড়া যাইতেছে। মনে করো, আমাগো পুত দ্যাশ স্বাধীন করতে গেছে। আর ফিরা আহে নাই।’
তোরা আমাকে ছুঁয়ে বল—
কাঁধের এ পাশ থেকে ও পাশ দিয়ে গুলিটা বের হয়ে গেছে। তিরের মতো রক্ত বের হচ্ছে। যুদ্ধের প্রচণ্ডতা বেড়েই চলেছে। সহযোদ্ধারা বুঝতে পারছেন না, কী করবেন। চার–পাঁচজন ধরাধরি করে পেছন দিকে যেতে শুরু করলেন। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে কোথাও যেতে হলে নৌকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। খোঁজাখুজির পর একটা নৌকা পাওয়া গেল। তখনো বিড়বিড় করে কথা বলছেন বকর ভাই। তখনো শহীদ হননি। ছোটবেলায় মনে করতাম, ওনার নাম ‘শহীদ বকর ভাই’। কারণ, বড় ভাইয়েরা সবাই বলতেন শহীদ বকর ভাই। একটু বড় হয়ে জানলাম, মাতৃভূমির জন্য যাঁরা জীবন দেন, তাঁদের নামের আগে শহীদ বলতে হয়। একই সঙ্গে বুঝলাম, ভাইও তাঁর নামের আগের বা পরের কোনো অংশ নয়। তাঁর নাম আবু বকর। পরে যিনি হয়েছিলেন শহীদ আবু বকর। যুদ্ধে আরও অনেক বন্ধু আছে। তাঁদের সবার জন্য মন খারাপ হচ্ছে বকর ভাইয়ের। কে কখন আহত-নিহত হয়, কিছুই বলা যাচ্ছে না। বকর ভাই বারবার বলছেন, ‘আমার জন্য তোদের ভাবতে হবে না। তোরা যুদ্ধে যা। এ দেশটাকে বাঁচাতে হবে। আমি দেশের জন্য জীবন দিলাম। আমার আর কোনো দুঃখ রইল না। তোরা আমাকে ছুঁয়ে বল, দেশটাকে দেখে রাখবি। জয় বাংলা।’ চোখ বুঝলেন শহীদ বকর ভাই। পরাধীন বাংলাদেশে বকর ভাইয়ের শেষ কথা ছিল, জয় বাংলা।
গুলি লাগার পর কালিয়ার যে মাটি কিছুক্ষণ বকর ভাইয়ের রক্তে ভিজে ছিল, ঠিক সেখানে একটি কৃষ্ণচূড়ার গাছ হয়েছিল। বছরের একটি সময় গাছের ডালপালা, পাতা কিছুই দেখা যায় না। শুধু ফুল আর ফুল। কৃষ্ণচূড়া ফুল হয়ে বকর ভাই বারবার ফিরে আসেন এই বাংলায়। আর বলতে থাকেন, ‘তোরা আমাকে ছুঁয়ে বল, দেশটাকে দেখে রাখবি। জয় বাংলা।’
*আশফাকুজ্জামান: লেখক, সাংবাদিক ও সংগঠক। উপদেষ্টা, প্রথম আলো মহানগর বন্ধুসভা