আইডেনটিটি ইনক্লুশন: মনোসামাজিক সমস্যায় সবার অন্তর্ভুক্তি

‘আইডেনটিটি ইনক্লুশন’
ছবি: সংগৃহীত

গড়পড়তা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ‘আইডেনটিটি ইনক্লুশন’–এর যাত্রা একটু ভিন্ন ধাঁচে শুরু হয়। শুধু কাউন্সেলিং সেবা নয়, ব্যক্তির প্রতিবন্ধকতাকে চিহ্নিত করে তার প্রতি অসম আচরণকে প্রতিহত করা এবং সবাইকে নিয়ে একটি সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা তৈরি করা—এটিই আইডেন্টিটি ইনক্লুশনের লক্ষ্য। প্রতিষ্ঠানটির নামের মধ্যেই এর উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে।

‘প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে সমাজ সব সময় কিছু সামাজিক গণ্ডির মধ্যে ফেলতে চায়। একজন প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন ব্যক্তি নানাভাবে সামাজিক বঞ্চনার শিকার হয়। সেটি হতে পারে আর্থসামাজিক, কাজ করার সুযোগ, চিকিৎসাসেবা ও সমাজে অন্যদের সঙ্গে মিলিয়ে চলার সামর্থ্য—এ সবকিছুই। তাই আমি এমন একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চেয়েছি, যেটি শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতার শিকড়কে উপড়ে ফেলবে।’ কথাগুলো বলছিলেন শামসিন আহমেদ, যাঁর হাত ধরে ২০১৫ সাল থেকে আইডেনটিটি ইনক্লুশনের যাত্রা অব্যাহত রয়েছে।

আইডেনটিটি ইনক্লুশন মূলত চারটি ধারায় কাজ করে। প্রথমটি হচ্ছে মনোসামাজিক সেবা দান করা। এ সেবাদানের প্রক্রিয়ায় শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন ব্যক্তির আশপাশের মানুষের মধ্যেও সচেতনতা তৈরির তাগিদ থাকে। এই ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন ব্যক্তির মা-বাবা এবং পরিবারের অন্যদের মধ্যেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচলিত কুসংস্কারের বলয় ধীরে ধীরে ভেঙে দেওয়া হয়। যেমন প্রায়ই একজন শারীরিক প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ প্রদান করা হয় না। এতে ক্রমে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে। তখন শিক্ষার্থীর মা-বাবা, এমনকি স্কুলশিক্ষকদেরও মনোসামাজিক ট্রেনিং দেওয়া হয়, যাতে শিশুটি মানসিক ও সামাজিকভাবে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে না করে। আর দশটি মানুষের মতোই তার সামাজিক অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে। কষ্টসাধ্য এ কাজ করে চলেছেন প্রতিষ্ঠানটির একঝাঁক তরুণ নিবেদিতপ্রাণ কর্মী।

ছবি: ‘আইডেনটিটি ইনক্লুশন’

প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে অ্যাডভোকেসির একটি ক্ষেত্র তৈরি করা। যেহেতু বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ হচ্ছেন তরুণ প্রজন্ম, যাঁদের বয়স ১৫-২৪–এর ভেতর (সূত্র: ইউএনএফপিএ), এই প্রজন্মের ভাবনা থেকেই উদ্ভূত বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট নিয়ে বর্তমানে কাজ চলছে। সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে “মেন’স স্পিক” প্রজেক্ট। ইএমকে সেন্টারের অনুদানপ্রাপ্ত এ প্রজেক্টের কাজ হচ্ছে পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা। একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরা সহজে আবেগ প্রকাশ করতে পারেন না। ছোটবেলা থেকে সামাজিকীকরণের এ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিকর এসব সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে আইডেনটিটি ইনক্লুশন।

এ ছাড়া আত্মহত্যা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের সঙ্গে আইডেনটিটি ইনক্লুশনের তরুণেরাও তৈরি করেছেন জনসচেতনতামূলক ভিডিও। এর পাশাপাশি করোনাকালে বেকারত্বের হাত থেকে মুক্তির জন্য পাঁচজন প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য আয়োজন করা হয়েছে ওয়েবিনারের, যেখানে তাঁদের শেখানো হয়েছে সিভি, কভার লেটার লেখার খুঁটিনাটি।

ছবি: ‘আইডেনটিটি ইনক্লুশন’

প্রতিষ্ঠানটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে সাপোর্ট গ্রুপ মিটিংয়ের আয়োজন করা। সাত-আট সদস্যবিশিষ্ট এ মিটিংয়ে একজন মেন্টাল হেলথ প্রফেশনালের উপস্থিতিতে, সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রয়োজন সাপেক্ষে পরবর্তী সময়ে দক্ষ সাইকোলজিস্ট অথবা সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে যোগাযোগও করিয়ে দেওয়া হয়। করোনাকালীন সাপোর্ট গ্রুপ মিটিংয়ের প্রচার এবং আয়োজন সবটাই অনলাইনে করা হচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, ঘরবন্দী এই সময়ে বাংলাদেশে আত্মহত্যা ও নারী নির্যাতনের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এসব চলমান সামাজিক ইস্যু নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সক্রিয় ফেসবুক গ্রুপে নিয়মিত আলোচনা করা হয় এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য তরুণদের উৎসাহ দেওয়া হয়।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতেও আইডেনটিটি ইনক্লুশন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বরগুনা ও সিলেটে পুলিশ ইনস্টিটিউশনে আয়োজন করেছে দিনব্যাপী ট্রেনিং সেশনের। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে কীভাবে সৌহার্দ্যমূলক আচরণের মাধ্যমে সেবা প্রদান করা যায়, তা–ই ছিল এই সেশনের উদ্দেশ্য। সম্প্রতি মেরিকো বাংলাদেশের ২৬০ সদস্যকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর ট্রেনিং প্রদান করা হয়েছে। দক্ষ ট্রেনার তৈরি করার জন্য ‘বাংলাদেশ মেন্টাল হেলথ নেটওয়ার্ক’–এর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ট্রেনিং দেওয়া হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন ও কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সাহায্যে নতুন সেচ্ছাসেবকদের ট্রেনিং প্রদান করা হয়ে থাকে। এতে করে তরুণ প্রজন্ম একদিকে যেমন হয়ে ওঠে মানসিক স্বাস্থ্যসচেতন, অন্যদিকে সমাজের প্রান্তিক মানুষের মধ্যেও বিনা মূল্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া হয়।

ছবি: ‘আইডেনটিটি ইনক্লুশন’

এ ছয় বছরে আইডেনটিটি ইনক্লুশন কাজ করেছে প্রায় দুই হাজার তরুণ সেচ্ছাসেবীর সঙ্গে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলে যাওয়া কষ্টসাধ্য। এই নিরলস কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে ব্র্যাক আয়োজিত ‘আরবান ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ’–এ ৬১৫টি প্রজেক্টের ভেতর ‘স্পেশাল মেনশন অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া ২০২০ সালে সমাজে অবদানের জন্য শামসিন আহমেদ জিতে নেন ‘স্বপ্ন ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’।

একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে শামসিন আহমেদ স্বপ্ন দেখেন এমন একটি সমাজব্যবস্থার, যেখানে এপিলেপসি, অটিজম বা সিজোফ্রেনিয়ার মতো শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার জন্য কারও সামাজিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে না। প্রত্যেকে হয়ে উঠবেন একজন আত্মপ্রত্যয়ী, স্বতন্ত্র মানুষ।

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক যে কারও জন্য প্রতিষ্ঠানটির দরজা উন্মুক্ত। আগ্রহী কেউ যোগাযোগ করতে পারেন এই ই–মেইলে: [email protected]

লেখক: স্বেচ্ছাসেবী, আইডেনটিটি ইনক্লুশন