অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে ‘আরতি খালা’র

সিলেটের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজের ১২০ একরজুড়ে প্রতিদিন আরতি খালার আনাগোনা
ছবি: লেখক

দেড় বছর বন্ধ থাকার পর খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থী না থাকায় প্রাকৃতিকভাবে সজীবতার হাতছানিতেও প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছিল প্রাণহীনতা। স্মৃতি আর আবেগজড়ানো নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরেছেন লাখো শিক্ষার্থী। অপেক্ষা ঘুচেছে আরতি খালারও।
সিলেটের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজের ১২০ একরজুড়ে প্রতিদিন আরতি খালার আনাগোনা। ‘বাবা ১০টা টেখা দেও না, ও আম্মা ১০টা টেখা দেও’ শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে, পাশে বসে কিংবা গায়ে হাত বুলিয়ে নিত্যদিন তাঁর কাকুতি-মিনতি এমনই আদরজড়ানো বাক্যের আবরণে। জীর্ণ দেহ, পুরোনো শাড়ি আর খালি পায়ে গুটি-গুটি করে হেঁটে বেড়ানো আরতি খালাকে দূর থেকে একপলকেই চেনা সম্ভব।

এমসি কলেজ প্রতিদিন মুখরিত হয় হাজারো শিক্ষার্থীর পদভারে। ক্যাম্পাসের সঙ্গে তাঁদের সবার সম্পর্ক আকাশছোঁয়া স্বপ্নকে বাস্তবে রুপায়নের, তবে আরতি খালার সম্পর্কটা জীবিকা নির্বাহের। কখনো পুকুরঘাট, কখনো শহীদ মিনার, আবার কখনো অডিটোরিয়ামে দিনভর ভিক্ষা করে যে টাকা উপার্জন হয়—তা নিয়েই ফেরেন। এভাবেই কেটে যায় দিন। আরতি খালা ক্যাম্পাসে ঢুকেন রোজ সকালে। একটানা ভিক্ষা করেন। মাঝেমধ্যে ক্লান্ত হলে বসে পড়েন পুকুরঘাটে। সুবিশাল জলরাশির শ্বেতপদ্ম পুকুরটিতে পা ভিজিয়ে বসে থাকতে তাঁর ভীষণ পছন্দ।

এসব চিত্র ছিল স্বাভাবিক সময়ের। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর থেকেই কমে গেছে আয়। টিলাগড় পয়েন্টসহ আশপাশ এলাকায় এখন ভিক্ষা করেন তিনি। তবে প্রাপ্ত টাকায় খাবার কিনতে পারেন না। তাঁর মতে ‘পথ-ঘাটো মানুষ এখন টেখা দেয় না, কলেজর ছাত্রছাত্রী অখলে আমারে মায়া খরি বেশি টেখা দিতো।’

সত্তরোর্ধ্ব আরতি খালা জীবনের শেষ সময়ে এসেও কেন ভিক্ষাবৃত্তিতে? বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে তাঁর অনাগ্রহ চেহারায় স্পষ্ট। তবু একাধিক চেষ্টা ও কথার ছলে জানা গেল সাতকাহন। বারবার গলা ধরে আসছিল তাঁর, চোখের কোণে জলরাশিও ছিল দৃশ্যমান।
‘বাবা, বাঁ পা টা ফুলি গেছে, আটতে খুব কষ্ট হয়। তাও কিতা সাধ খরিয়া ভিক্ষা খরিনি?’ উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে কথার শুরু আরতি খালার। শরতের এক রোদজড়ানো দুপুরে ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসে আসন পেতে তিনি শোনালেন জীবনের উপাখ্যান।

‘সব খতা আমার মনো নাই বাবা, বিয়া তাকি খই’? মা-বাবার পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল তাঁর। নতুন সংসার নিয়ে স্বপ্নও ছিল আকাশসমান। তবে সব স্বপ্নে গুড়েবালি হলো স্বামীর অন্যত্র বিয়ের পর। তাঁর ভাষ্যমতে ‘ইন্ডিয়ার আমলো আমার বিয়া অইছিল। খয় বছর যাওয়া বাদে বেটায় আমারে মারিয়া খাদাইয়া দিছে। আমার কোনো হুরুতাও নাই।’ সংসারজীবনের ইতি ঘটার পর আরতি খালা ফিরে এসে পান মা-বাবা কেউই বেঁচে নেই। তাঁর ভাষ্যমতে, যদিও নির্দিষ্ট থাকার জায়গা ছিল না তবে রায়নগর এলাকায় মা–বাবা থাকতেন।

সব হারানো আরতি খালা প্রথম দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু একটা সময়ে এসে নামেন ভিক্ষাবৃত্তিতে। টিলাগড়ের গোপালটিলা এলাকায় বড় বোনের বসবাস অনুপযোগী ঝুপড়ি ঘরে থেকেছেন কয়েক বছর। তবে এখন শাহপরান মাজার এলাকায় থাকেন। জীবনের এই পরিণতি নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই আরতি খালার। তাঁর ভাষ্য এমন ‘এখনো মনো অয় অউ হিদিন কলেজো আইলাম, কুনবায় যে ১০-১২ বছর গেলোগি। বুঝতামউ পারছি না’। তবু অভিমানের অশ্রুæআঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমার তো খেউ নাই। আমার আর যাইবার জাগাও নাই।’

এমসি কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে আরতি খালা বেশ পরিচিত নাম। দিনভর ক্যাম্পাসে থাকেন বলে তিনি অনেকেরই প্রিয়। কলেজের সাংস্কৃতিক সংগঠন মোহনার সভাপতি ইমরান ইমন বলেন, ‘ক্যাম্পাসজীবন শুরুর দিকে আরতি খালাকে দেখে আসছি। তাঁর জন্য আমাদের আলাদা এক টান কাজ করে।’ এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি আজহার উদ্দীন শিমুল জানান, ‘আমাদের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা যৌথভাবে সহযোগিতার হাত বাড়ালে আরতি খালার শেষ জীবনের কষ্ট কিছুটা হলেও ঘুচানো যেত।’

‘অত দিন ফরে হুরুতাইন কলেজো আইবা, হুনিয়াউ আমার যে খুশি লাগের। বাটছাইতাম পারিয়ার না আার।’ আরতি খালার সঙ্গে আধা ঘণ্টার আলাপন শেষ হলো এভাবেই।


*লেখক: শিক্ষার্থী, এমসি কলেজ