অনিশ্চিত জীবন নিয়ে দরিদ্র স্বকর্মজীবী মানুষ
‘বাঁশের বাঁশিতে ফুঁ দিই,
সুর ভাসাই বাতাসে।
কেউ খুশি হয়ে বলে,
এদিকে আয়, একটু শুনি।
কেউবা কিনে নেয় বাঁশি।’
বলছিলেন বংশীবাদক ভবেশ চন্দ্র রায়।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে আসেন দুই টাকা রোজগারের জন্য। ৫০ বছর পথে পথে, বাজারে, রেলস্টেশনে, পার্কে, বাঁশি বেচেন। বাঁশি বাজান। কীভাবে বাঁশি বাজাতে হয়, তা আবার ক্রেতাকে শিখিয়ে দেন। এদিয়ে যা আয় হয়। তাই দিয়ে সংসার চালান।
এক মেয়ে, এক ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে ভবেশ চন্দ্র রায়ের সংসার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুদিন যাতায়াত ছিল। দারিদ্র্যের কারণে পড়ালেখা হয়নি। অল্প বয়স থেকেই আয়রোজগারের দিকে ঝুঁকতে হয়েছে। বয়স চলছে ৬৭। এখনো তাই বেশি আয়ের আশায় ঘোরেন এক শহর থেকে আরেক শহরের পথে পথে।
চিরিরবন্দর উপজেলার কাউনিয়া ভবেশ চন্দ্র রায়ের বাড়ি। ভুষিরবন্দর হাট থেকে বাঁশি কিনে আনেন। ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও বীরগঞ্জ কিংবা ২৮ মাইলে তাঁকে দেখা যায়। পথে পথে ঘুরে বাঁশিতে সুর তোলা আর মানুষকে আকৃষ্ট করাই তাঁর ব্যবসা। কেউ বাঁশি শুনে খুশি হয়ে এক কাপ চা খেতে বলে। কেউবা বাঁশি কিনে নেয়।
ভবেশ চন্দ্র রায় আকারভেদে প্রতিটি বাঁশি বেচেন ২০ থেকে ১০০ টাকায়। ২০০–৩০০ টাকাও হয় না কোনো দিন। তাই অস্থিরতা তাকে ঘিরে ধরেছে। ইদানীং অসুস্থতাও পেয়ে বসেছে। মেরুদণ্ডে ব্যথা। অর্থাভাবে চিকিত্সা করতেও পারেন না তিনি। সন্তানদের কী হবে—সে কথা ভাবতেই চোখ জলে ছলছল।
গুরু কমল কান্তি রায়ের হাত ধরে ভবেশ চন্দ্র রায়ের বাঁশি বাজানো শেখা। সেই থেকে সুরও আয়ত্ত করেছেন কয়েক হাজার গানের। পল্লিগীতি, ভাওয়াইয়া, লালনগীতি, বিচ্ছেদ ও পুরোনো বাংলা সিনেমার গানের সুরও তুলতে পারেন তিনি। মেরুদণ্ডে ব্যথা নিয়ে দুর্বলভাবে হেঁটে চলা এই বংশীবাদকের সুর নিভে গেলে কী হবে তাঁর সংসারের? এমন অনিশ্চিত জীবন নিয়েই ভবেশ রায়ের মতো দেশের দরিদ্র মানুষেরা বেঁচে আছেন। জন্মই যেন তাঁদের আজন্ম পাপ, তবু প্রাণ থাকা পর্যন্ত লড়তে হবে। তাই কখনো নীরবে বসে বসে বেদনার সুর তোলেন এই বংশীবাদক। তার এই সুর নীতিনির্ধারকদের কান পর্যন্ত যায় না, যাঁরা ওপরতলায় বসে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর ছক আঁকেন।
ভবেশ চন্দ্র রায়ের মতোই নানান কিছু করে দুই বেলা দুই মুঠো খেয়ে বাঁচার সংগ্রামে লিপ্ত তরিকুল ইসলাম। ঠাকুরগাঁও সদরের রুহিয়া বাজারে কেনাকাটা করতে আসা এমন অনেকের চোখ এড়ায় না তরিকুলসহ এখানকার অন্য ক্ষুদ্র বিক্রেতাদের। তরিকুল মৌসুমভেদে আম-আমড়া-পেয়ারার ভর্তা বিক্রি করেন। কাসুন্দি আর সামান্য মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে ৫ কিংবা ১০ টাকায় বিক্রি করেন। কাঁচা আম-আমড়া-পেয়ারা বানিয়ে খেতে তরুণ-তরুণীদের অনেকেই তাঁর কাছে খানিক দাঁড়ান। একটু একটু করে বিক্রি হলেও মাস শেষে সংসারের ব্যয়ভার মিটিয়ে ফেলেন তরিকুল। এ ব্যবসার পাশাপাশি ভ্যান চালান তিনি। থাকেন রেলপথঘেঁষা, রেলওয়ের সরকারি জমিতে।
তরিকুল ইসলামের মতোই আরেকজন সমারু উদ্দিন। ঠাকুরগাঁও টু পঞ্চগড় ট্রেনে উঠে বাদাম বিক্রি করেন। বাড়ি পঞ্চগড়। বিক্রি–বাট্টায় যা পান, তা দিয়ে চলে সংসার। বউ, পোলাপান নিয়ে সদরের রুহিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিত্যক্ত কোয়ার্টারে থাকেন। তিনি বললেন, ‘রোজ যা বিক্রি করি, তাতে খুব লাভ থাকে না। তবু কিছু একটা করে তো খেতে হবে। শুধু ঠাকুরগাঁওয়ে নয়, সারা দেশে এভাবে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে এ ধরনের স্বকর্মজীবী মানুষ। ফেরি করে দিন কাটে তাঁদের। সব দিনে সমান আয় হয় না।’
ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. শামীম হোসেন বলেন, এ ধরনের ভাসমান বিক্রেতাদের জরিপ চালানো যেতে পারে। তাঁদের মধ্যে গ্রুপ করে সেবাধর্মী বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োজিত করলে ভালো ফল আসতে পারত। কিংবা তাঁদের সরকারিভাবে কারিগরি কোনো প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে তাঁরাও ভালো থাকতেন। দেশও লাভবান হতো।