অনলাইন পরীক্ষা ও আমাদের সক্ষমতা
করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে যে স্থবিরতা নেমে এসেছে, তার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে শিক্ষাঙ্গনে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার চেষ্টা করা হলেও এতে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি অনেক শিক্ষার্থীকে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অ্যাসাইনমেন্ট এবং জেএসসি ও এসএসসির ফলের মূল্যায়নের মাধ্যমে উতরে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইনে পরীক্ষার কথা ভাবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার সক্ষমতা অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অনলাইন পরীক্ষা নেওয়ার সক্ষমতা কতটুকু, সেটাও আমাদের আলোচনায় রাখতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিমধ্যে অনলাইনে বেশ কিছু পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পরামর্শে করোনার বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ও সেশন জটের শঙ্কায় এবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাঁটছে একই পথে। ইতিমধ্যে ৬ মে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ১ জুলাই থেকে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। অনলাইন ক্লাস কিংবা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বেশ কিছু বিভাগের জরিপে দেখা গেছে, অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত হতে পারছেন না ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, গণমাধ্যমে উঠে আসা বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো না কোনো কারণে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারছেন না। তাহলে অনলাইনে পরীক্ষার মতো বড় একটি সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বৈষম্যের শিকার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
আরেকটি বিষয় হলো, অনলাইন ক্লাসের বিষয়েও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের আহ্বানে প্রথমে ‘না’ জানিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাসে যাচ্ছে না। প্রশ্ন আসতেই পারে, অনলাইনে পরীক্ষার বিষয়ে এবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবার প্রথমে কেন সম্মতি জানাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের থমকে যাওয়া শিক্ষাজীবন, সেশন জটের শঙ্কা কাটাতে এই সিদ্ধান্ত না নিয়েও উপায় নেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
আমাদের দেশে অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষা পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত ডিজিটাল অবকাঠামো এখনো তৈরি হয়নি। আকাঙ্ক্ষার ফোর–জি নেটওয়ার্ক মূলত বাস্তবতার টু–জি নেটওয়ার্কের একটু বেশি। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই নাজুক। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের একটা প্রধান অংশ আসে গ্রামাঞ্চল থেকে, যাদের বেশির ভাগই নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের দুর্বল আর্থসামাজিক অবস্থাকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। কোনো শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত করতে না চাইলে প্রযুক্তির উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, গ্রাম পর্যায়ে ইন্টারনেটের মান বৃদ্ধি, অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের সহযোগিতাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু সমস্যার কথা ভেবেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎকে স্থবির করে রাখাও যৌক্তিক নয়। আবার বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় রাতারাতি এর পরিবর্তনও সম্ভব নয়। তা ছাড়া সাধারণত আমরা অনলাইন প্রযুক্তির সঙ্গে অভ্যস্তও নই, অনাকাঙ্ক্ষিত একটি মহামারির কারণে সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রক্রিয়ায় আমরা যুক্ত হয়েছি। তবুও সমাধানের পথে আমাদের হাঁটতে হবে। বাঁচাতে হবে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্র, বাঁচাতে হবে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ।
*শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়