অনলাইন গেম আসক্তি: বেরিয়ে আসা কি কঠিন
বর্তমান যুগে গেমিং অ্যাডিকশন, অনলাইন মোবাইল বা ভিডিও গেমে আসক্তিকে মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অন্যান্য নেশার মতো ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করা বা অধিক সময় ধরে অনলাইনে গেম খেলাও একটি আসক্তি। মানুষের মধ্যে এ ধরনের আসক্তিকে বলা হয় আচারণগত আসক্তি। কেবল স্মার্টফোনের সহায়তায় নতুন প্রজন্ম আজ আসক্ত হয়ে পড়েছে অনলাইন গেম নামের এক করুণ নেশায়। ঘরে–বাইরে, রাস্তা–ঘাটে, স্কুল–কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেককে দেখা যায়, পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে গেম খেলছে। মাদকাসক্তির মতোই অনলাইন গেম বর্তমান তরুণদের গ্রাস করে ফেলছে।
একসময় তরুণেরা অবসর কাটাত বই পড়ে, মাঠে খেলে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমান সংস্কৃতি–সভ্যতার চর্চাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগুলোর জায়গা দখল করে আছে অনলাইনভিত্তিক গেমগুলো। আজকাল লক্ষ করা যায়, প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, এমনকি অনার্সপড়ুয়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের তরুণেরাও অনলাইন গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন; যা এখন শুধু একটি নেশা নয়, মানসিক সমস্যায়ও পরিণত হয়েছে। এই নেশা বা আসক্তির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ ১১তম সংশোধিত সংস্করণে (আইসিডি-১১) ‘গেমিং অ্যাডিকশন’কে এক মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে ২০১৮ সালের জুনে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে প্রকাশিতব্য আইসিডি-১১ শীর্ষক রোগনির্ণয় গাইড বুকে এটি সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ বলা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অনলাইন গেম, মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় গেম বলতে গেলে ‘ফ্রি ফায়ার এবং পাবজি’ নামের দুটি গেম, যা আজকাল মাত্রাতিরিক্তভাবে খেলতে দেখা যায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ফ্রি ফায়ারের ৫০০ মিলিয়নের বেশি নিবন্ধিত ব্যবহারকারী রয়েছে। অন্যদিকে পাবজি গেমটিরও মোবাইল ডাউনলোড প্রায় ২৩৬ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের জন্য এভাবে মুঠোফোন, ল্যাপটপ–কম্পিউটারে গেমের প্রতি আসক্তি একটি হুমকির কারণ। ইন্টারনেটের যুগে গেম–আসক্তির বিষয়টি অন্যান্য আসক্তির চেয়ে গুরুতর। আমাদের চারদিকে একটু নজর দিলে দেখা যায়, কেউ অনলাইনে গেমের প্রতি আসক্ত, কেউ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, কেউ মুভি দেখায়, আবার কেউবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু ব্যয় করে ফেলছে।
বিশ্বজুড়ে একটি জরিপে দেখা গেছে, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ইন্টারনেট গেমিংয়ে আসক্তিতে ভুগছেন। যাঁদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হচ্ছে কিশোর আর ১ দশমিক ৩ শতাংশ কিশোরী। (জেওয়াউ ফ্যাম, ২০১৮)
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসির তথ্যমতে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত হয়। ২০১৬ সালের এক তথ্যমতে, ৩৫ শতাংশ হচ্ছে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী, অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর–কিশোরী। এরাই কিন্তু বর্তমান গেমিংয়ে বেশি আসক্ত হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
যে তরুণ-তরুণীরা স্বপ্ন দেখবেন বিশ্বজয়ের, যাঁরা দেশকে একসময় নেতৃত্ব দেবেন, তাঁরাই আজ অনলাইন গেমে আসক্তির কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এ বয়সে অতিরিক্ত পরিমাণে গেম খেলার বিষয়টি সর্বদা চিন্তাচেতনা ও আচারণের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, যা সামাজিক দক্ষতাকে কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া দৈনন্দিন জীবনযাপনের মান খারাপ করে দেয়। এ ক্ষেত্রে মা–বাবার ভূমিকাও প্রভাব ফেলে। দেখা যায়, মা–বাবা তাঁদের ব্যস্ত সময়ে সন্তানের সঠিক খেয়াল রাখতে পারেন না। সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। ব্যস্ততার অজুহাতে সন্তানের হাতে তুলে দেন মুঠোফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার। মা–বাবা তাঁদের সন্তানের হাতে এ ধরনের ডিভাইস তুলে দিয়ে নিজেরা স্বস্তি অনুভব করেন। অথচ খোঁজখবর রাখেন না, তাঁর সন্তান এগুলোর সঠিক ব্যবহার করছে কি না। এদিকে সন্তানেরা স্বাধীনতা পেয়ে যায় ইন্টারনেট দুনিয়ায়। পড়াশোনা বাদ দিয়ে নিজের খেয়ালখুশিমতো দিনরাত ইন্টারনেটের বিভিন্ন গেমিং সাইট বা অনলাইন গেমে মেতে ওঠে, যা একসময় আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়। ঘরে আবদ্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেম খেলায় মগ্ন হয়ে থাকে। খাওয়াদাওয়ার কথা ভুলে সব চিন্তাচেতনা গেমের প্রতি দিয়ে দেয়। সব আনন্দ যেন অনলাইন গেমজুড়ে। এদিকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই ডেটা অন করে গেম খেলা শুরু করে চলতে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। গেমের প্রতি আসক্তির ফলে পড়াশোনা বা স্বাস্থের প্রতি কোনো খেয়াল থাকে না। মেজাজ থাকে সর্বদা খিটখিটে। পরিবারের কেউ ডাকলে সারা না দিয়ে রাগারাগির পর্যায়েও চলে যায়। এ ধরনের আচারণগত সমস্যাগুলো সামাজিক জীবন ও তরুণ প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এসব গেম খেলতে প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত ডেটার। ডেটা প্যাক কিনতে অনেকে মিথ্যা বলে, বাজারের টাকা মেরে বা না খেয়ে ডেটা প্যাক কিনে গেম খেলায় মগ্ন থাকে। মস্তিষ্কজুড়ে শুধুই গেমের প্রতি আসক্তি জন্মায়। ফলে ব্যক্তিগত জীবন বাধাগ্রস্ত হয়। যেকোনো কাজের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ হ্রাস পায় এবং নানা ধরনের পারিবারিক সমস্যা দেখা দেয়। আর এসব সমস্যার মূল কারণ এখন অনলাইন গেমের প্রতি আসক্তি।
আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেভাবে এসব অনলাইন গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে, চাইলে এর থেকে বেরিয়ে আসাও সম্ভব। শুধু দরকার একটু পারিবারিক ও নিজস্ব সচেতনতা। নিজের মধ্যে থাকতে হবে তীব্র ইচ্ছাশক্তি। জীবন নতুনভাবে সাজাতে নতুন রুটিন করে চলতে পারলে এ ধরনের আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হবে। ইন্টারনেটে একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সময় দেওয়া যাবে না, নিজের কাজগুলোর প্রতি বেশি সময় দিতে হবে, খেলাধুলা, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প–আড্ডায় সময় দিতে হবে। আর বইকে সবচেয়ে বেশি আপন করে নিতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে গেমের প্রতি আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। তাই তরুণ প্রজন্মকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এবং বিশ্বদরবারে তাঁদের সফলতার শিখরে পৌঁছাতে মাদকাসক্তিকে না বলার মতো অনলাইন গেমের প্রতি তরুণদের আসক্তিকেও না বলতে হবে।
*লেখক: মো. সুমন সরকার, শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর