ট্রেনে সময়োপযোগী খাবারের ব্যবস্থা করা কি এতটাই কঠিন

ট্রেনপ্রতীকী ছবি

‘আ জার্নি বাই ট্রেন’ শীর্ষক রচনা না পড়ে কেউ এসএসসি পাস করেছে, এমনটা শুনিনি আমাদের সময়ে। ‘আমাদের সময়’ মানে, বেশ একটু আগে—২০০০ সালের আশপাশে। আমার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া মেয়েকে কিছুদিন আগে ‘আ জার্নি বাই বোট’ পড়তে শুনেছি। তার মানে, তাকেও এই ‘আ জার্নি বাই ট্রেন’ রচনা পড়তে হবে।

আমরা সেখানে পড়েছিলাম ট্রেন ভ্রমণ খুব রোমাঞ্চকর, আনন্দের; জানালা দিয়ে দেখা সবুজ প্রকৃতি আর ছন্দময় ‘কু ঝিক ঝিক’ শব্দ ভ্রমণকে আরও আনন্দময় করে তোলে ইত্যাদি। যাঁরা ঢাকা–সিলেট রুটে ভ্রমণ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই শ্রীমঙ্গলের আশপাশে চলার সময় বা লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় এমনটা উপভোগ করেছেন। শহরের অংশ বাদ দিলে ট্রেনে করে এলেই প্রকৃতি দেখতে দেখতেই গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পেটে খিদে নিয়ে এই সৌন্দর্য কতটা উপভোগ করা যায়?
কাজের প্রয়োজনে অধিকাংশ মাসে আমি দুই থেকে পাঁচটি জেলায় যাই। কখনো বাসে, আবার কখনো ট্রেনে যাই। বাসে যাওয়ার কিছু সুবিধা আছে, যেমন সময়টা নিজের মতো করে বেছে নেওয়া যায়। একটু ভালো বা মোটামুটি মানের বাসে উঠতে পারলে এক বোতল পানি আর কমপক্ষে একটা রিফ্রেশিং ব্রেক পাওয়া যায়, যেখানে আপনি ব্যবহার করার জন্য মোটামুটি পরিষ্কার ওয়াশরুম পাবেন। সময় ও প্রয়োজন অনুযায়ী হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে বক্স বা খাবার পাবেন, সঙ্গে চা–কফিও পাবেন। নন–এসি বাসে ভ্রমণ করলে ব্রেক পাওয়া গেলেও পরিষ্কার ওয়াশরুম বা ভালো খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

ট্রেনে যেহেতু সব শ্রেণির লোক ওঠেন, সেহেতু সবকিছু ঠিকঠাক ম্যানেজ করা কঠিন। ট্রেনযাত্রার কিছুক্ষণের মধ্যে টয়লেট আর ব্যবহার উপযোগী থাকে না। হাই কমোডওয়ালা টয়লেটে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। ট্রেনে প্রচুর অ্যাটেনডেন্টকে ঘোরাঘুরি করতে দেখি, কিন্তু তাঁদের দৃশ্যমান কোনো কাজ চোখে পড়ে না।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]

সবচেয়ে মুশকিল হলো ট্রেনের খাবার নিয়ে। সিলেটগামী ট্রেনের কথায় ফিরে আসি। পারাবত এক্সপ্রেস কমলাপুর স্টেশন থেকে ছাড়ে সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে। বাসা থেকে স্টেশন একটু দূরে হলে বের হতে হয় বেশ একটু আগে। কারও পক্ষে কি এই ভোরে বাসা থেকে নাশতা সেরে আসা সম্ভব? খেয়ে গেলেও তো আবার সকাল ৮টা–৯টার দিকে ক্ষুধা লাগবেই। যদি পরের ট্রেন অর্থাৎ জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে যাওয়া হয়, সেটা বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে ছাড়ে আর সন্ধ্যা ৭টায় পৌঁছায়। কিছু ট্রেনের রানিং টাইম আরও লম্বা। যেমন চিলাহাটি অভিমুখী নীলসাগর এক্সপ্রেস বা খুলনা অভিমুখী চিত্রা এক্সপ্রেস। হ্যাঁ, ট্রেনে অবশ্যই সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা কতটা খাওয়ার উপযোগী বা যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে খায়?

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ধনীদের বাসায় আমার যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তাঁরা কী দিয়ে সকালের নাশতা সারেন, আমি জানি না। সিনেমায় দেখান, ‘চৌধুরী সাহেবরা’ যে নাশতা করেন, তা যদি সত্যি ও আপার ক্লাসের হয়, তাহলে জ্যাম, জেলি বা মাখন লাগানো ব্রেড বা টোস্টের সঙ্গে ফ্রুটস, জুস, ডিম, মিষ্টান্ন ইত্যাদি তাঁরা খেয়ে থাকেন। দেশের ৫৮টি জেলায় কমপক্ষে একটি পূর্ণ দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, আমাদের মতো সাধারণ পরিবারে স্থান, কাল ও অর্থনৈতিক অবস্থাভেদে ভাত, রুটি, পরোটার সঙ্গে ডাল, আলুভর্তা বা ভাজি, সবজি, ডিম ইত্যাদি খেয়ে থাকি। তাহলে ট্রেনে বার্গার, কাটলেট আর চিকেনফ্রাই বেজড সকালের নাশতা কোথা থেকে এল? দুপুরে যে অখাদ্যটা দেওয়া হয়, সেটাও কি কেউ স্বাচ্ছন্দ্যে খায়?

আমার অনেক পরিচিতজন কোনো অবস্থাতেই লম্বা দূরত্বে ট্রেনে ভ্রমণ করতে চান না। তার অন্যতম প্রধান কারণ, প্রয়োজনীয় খাবারের মান ও ধরন। ট্রেনের যাত্রা স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে অন্য সেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি দিনের বা রাতের সময় অনুযায়ী প্রথাগত খাবার সরবরাহ থাকা জরুরি। যেমন সকালে রুটি বা পরোটার সঙ্গে ভাজি বা জেলি মাখানো ব্রেড আর ডিম; দুপুরে বা রাতে ভাত বা খিচুড়ির সঙ্গে একটু তরকারি। আমার কোনোভাবেই মনে হয় না যে এগুলো ব্যবস্থা করা কঠিন। রেল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এ বিষয়ে নজর দেবেন বলে আশা রাখি।

  • কাজী আজাদ–উজ–জামান: উন্নয়নকর্মী, শ্যামলী, ঢাকা।