একটি পাসপোর্ট পেতে ‘রুদ্ধশ্বাস অভিযান’
আপনার কি ভারতের ভিসা আছে?
অফিস থেকে ফোন করে এক সহকর্মী প্রশ্নটা করলেন।
বললাম, পাসপোর্টেরই মেয়াদ নেই। ভিসা! কেন?
দিল্লিতে একটা কনফারেন্সে যেতে হবে। অফিস থেকে আপনিসহ চারজন যাবেন।
তাহলে ই-পাসপোর্ট করি।
করে ফেলেন। সামনের মাসে ১৩-১৪ তারিখ কনফারেন্স। হাতে আছে ২০/২২ দিন। এর মধ্যে পাসপোর্ট, ভিসা পেতে হবে। সময় কম। ‘জরুরি আবেদন’ করেন। তাহলে দ্রুত পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন।
ঠিক আছে।
কথাবার্তা শেষে ফোন রেখেই শুরু হলো পাসপোর্ট পেতে আমার ‘রুদ্ধশ্বাস অভিযান’।
শুরুতেই অনলাইনে আবেদন
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বিরক্তি চলে এল। ধীরগতি। আমার ইন্টারনেটের সমস্যা নাকি ওদের সার্ভার ডাউন? ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করে ক্ষান্ত দিলাম।
না, এভাবে হবে না। বরং গলির মোড়ের দোকানে গিয়ে পাসপোর্টের আবেদনটা করে আসি। এই ভেবে এনআইডি নিয়ে ছুটলাম দোকানে। সেখানে দোকানের এক কর্মী আমার ফরম পূরণ করা শুরু করলেন। বেশ চটপটে। দ্রুত কাজ করতে থাকলেন। পাসপোর্টের আবেদন ফরম নিয়মিতই পূরণ করেন বোঝা গেল। ফরম পূরণের একপর্যায়ে বাবা-মায়ের নাম-ঠিকানা এনআইডি নম্বর পূরণ করতে হলো। এনআইডি অনুযায়ী স্ত্রীর নাম-ঠিকানাও পূরণ করতে হলো।
অবশেষে ফরম পূরণ শেষ। এবার পাসপোর্ট ফি জমা দেওয়ার পালা।
অনলাইনেই পাসপোর্ট ফি জমা
ব্যাংকে গিয়েও পাসপোর্ট ফি জমা দিতে পারেন, আবার অনলাইনেও দিতে পারেন, ফরম পূরণ শেষ করে আমাকে বললেন দোকানের সেই কর্মী। ব্যাংকে দিলে সার্ভিস চার্জ কম লাগে, সেটাও জানিয়ে দিলেন।
বললাম, পাসপোর্ট আমার জরুরিভাবে দরকার। এখনই কাজ যত দূর করা সম্ভব, তত দূর শেষ করব।
বিকাশ নম্বর আছে? আমরা বিকাশ থেকে দিতে পারি। আপনার খরচ একটু বেশি হবে।
আমার বিকাশ নম্বর থেকে যদি সরাসরি দিয়ে দিই। তাহলেও কি বেশি খরচ হবে?
না। দেন তাহলে।
বিকাশের মাধ্যমে পাসপোর্ট ফি জমা দিলাম।
এরপর আবেদনের প্রিন্ট কপি আমার হাতে দিয়ে আপাতত কাজ শেষ জানিয়ে দোকানের সেই কর্মী বললেন, ‘শুক্র-শনি তো বন্ধ। আপনি রোববার সকাল সাড়ে নয়টায় পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ফরম জমা দেবেন।’
আবেদন ফরমের সঙ্গে কী কাগজপত্র জমা দিতে হবে তারও ফিরিস্তি দিলেন তিনি।
দেখলাম, আবেদন ফরমেও উল্লেখ আছে, কী কাগজপত্র জমা দিতে হবে।
১. আবেদন সামারি (অনলাইনে আবেদন করলে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন আইডি ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট আইডি–সংবলিত ফরম)
২. আবেদন ফরম
৩. জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্মনিবন্ধন সনদ
৪. পাসপোর্ট ফি জমা দেওয়ার স্লিপ বা চালান ফরম
৫. আগের পাসপোর্ট (যদি থাকে)
৬. সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য জিও/এনওসি (যদি থাকে)
৭. আবেদনের ধরনের ওপর নির্ভর করে অতিরিক্ত কাগজপত্র
আমি আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো ফটোকপি করাতে করাতে দোকানের সেই কর্মীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এক্সপ্রেস’ ক্যাটাগরিতে আবেদন তো করলাম। কবে নাগাদ পাসপোর্ট পেতে পারি? তিনি ‘সবজান্তার’ ভাব নিয়ে বললেন, ‘এটা তো কেবল অনলাইনে আবেদন করলেন। এরপর পাসপোর্ট অফিসে যাবেন, ফরম জমা দেবেন, তারা তারিখ দেবে, তারপর পাবেন।’ আমি আর কথা বাড়ালাম না।
পাসপোর্ট অফিসে ফরম জমা
রোববার সকাল সকাল ছুটলাম মোহাম্মদপুরের বছিলায় পাসপোর্ট অফিসে। দুটি কাউন্টারে নারী ও পুরুষ আলাদা সারি করে ফরম জমা নেওয়া হবে। আমি লাইনে দাঁড়ালাম। সামনে ১৫ জনের মতো। আবেদন ফরম জমা নেওয়া শুরু হয়নি তখনো। সাড়ে নয়টায় শুরু হবে। অপেক্ষা করছি। একটু পর হ্যান্ডমাইকে একজন আনসার সদস্য ঘোষণা করতে থাকলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের মূল কপি ছাড়া আবেদন ফরম জমা নেওয়া হবে না। শিশুদের ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধনের মূল কপি জমা দিতে হবে।
শুনে নিজের পকেট হাতড়ানো শুরু করলাম! ফরম জমা দেওয়ার সময় মূল এনআইডির আনতে হবে, এ কথা তো আবেদন সামারি বা পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে লেখা নেই! আমি মানিব্যাগ বের করলাম। আমার মূল এনআইডি সঙ্গে আছে তো? পেয়ে গেলাম। আহ! এনআইডি আছে!
এর মধ্যে ফরম জমা নেওয়া শুরু হয়েছে। লাইন এগোচ্ছে। আমার সামনে একজন আছেন। তাঁর এনআইডিতে ঠিকানা চাঁদপুর। চাকরিসূত্রে ঢাকায় থাকেন, কিন্তু অফিসের আইডি কার্ড নেই। তাই তাঁর আবেদন ফরম জমা নেওয়া হলো না। ওই ব্যক্তি যখন এসব নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন আমি আমার অফিসের আইডি কার্ড খুঁজছিলাম! আইডি কার্ড সঙ্গে না থাকলে তো আমারও একই দশা হবে! অফিস আইডি অবশ্য আমি সব সময় সঙ্গে রাখার চেষ্টা করি। সেদিনও পকেটেই ছিল। সেটার ফটোকপি জমা দিতে হলো।
ছবি, হাতের ছাপ
আবেদন ফরম জমা নিয়ে সব দেখে সিল মেরে আমাকে ছবি তোলা, হাতের ছাপ নিতে একটি কক্ষে পাঠানো হলো। ১৫–২০ মিনিটের মধ্যে আমার সেই কাজ শেষ হলো। আমাকে পাসপোর্ট দেওয়ার সম্ভাব্য তারিখ দেওয়া ‘ডেলিভারি স্লিপ’ দিয়ে বলা হলো, কাজ শেষ। স্লিপে উল্লেখ করা তারিখে যোগাযোগ করে পাসপোর্ট নিতে আসবেন।
দেখলাম তারিখ দিয়েছে ১০ দিন পর। কিন্তু আমার তো আরও আগে পাসপোর্ট দরকার! ১০ দিন পর পাসপোর্ট পেলে কনফারেন্স শুরুর আগে হাতে থাকবে মাত্র ১২ দিন! কী করা যায়! সহকর্মী, পরিচিত বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। পাসপোর্টটা কোনোভাবে দ্রুত পাওয়া যায় কি না।
পুলিশ ভেরিফিকেশন
আমার পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে দুই দফা। গ্রামের বাড়িতে এক দফা, ঢাকায় এক দফা। সহকর্মী-বন্ধুদের পরামর্শে ঢাকায় ডিবিতে, স্থায়ী ঠিকানার থানায় ও ডিবিতে যোগাযোগ করলাম, যাতে দ্রুত ভেরিফিকেশন হয়। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা সবাই বেশ ইতিবাচকভাবেই কথা বললেন। দ্রুত রিপোর্ট দেবেন, সেই আশ্বাসও দিলেন। তিন–চার দিনের মধ্যে ভেরিফিকেশনও হয়ে গেল।
এবার আবেদন আইডি ধরে নিয়মিত ট্র্যাক করা শুরু করলাম। এক সহকর্মীর সূত্রে পাসপোর্ট অফিসের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসেছিলাম। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকলাম।
আর এদিকে যে চারজন কনফারেন্সে যাব, তাঁদের একজন সমন্বয়কারী হিসেবে আমাকে প্রতিদিন ফোন করতে থাকলেন। ফোনের মূল কথা, ‘ভাই, পাসপোর্ট পেলেন! সবার সব কাগজপত্র রেডি। ভিসাও হয়ে যাচ্ছে। শুধু আপনারটা বাকি।’
আমিও পাসপোর্ট অফিসের সেই কর্মকর্তাকে প্রতিদিন একবার করে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠাই, ‘ভাই, আমার পাসপোর্টটা হলো?’ অবশেষে একদিন তিনি জানালেন, ‘আপনার পাসপোর্ট এসেছে। আজ নিতে পারেন।’
সেই দিনটা ছিল ডেলিভারি স্লিপে উল্লেখ করা তারিখ। অর্থাৎ ১০ দিন পর (এর মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটি ও সরকারি ছুটি ছিল তিন দিন) নির্ধারিত তারিখেই আমার পাসপোর্ট হাতে পেলাম। ‘আমি পাইলাম। আমি ইহাকে পাইলাম’ টাইপের অনুভূতি নিয়ে শেষ হলো আমার পাসপোর্ট পাওয়ার ‘রুদ্ধশ্বাস অভিযান’।
আর পাসপোর্ট পাওয়ার পর ভাবলাম, পাসপোর্ট অফিসের দেওয়া নির্ধারিত তারিখেই তো পাসপোর্ট পেলাম। তাহলে এত ফোন, এত যোগাযোগ করার কী দরকার ছিল! আবার এটাও ভাবলাম, হয়তো এত ফোন, এত যোগাযোগ করার কারণে নির্ধারিত সময়েই পাসপোর্ট পেয়েছি। তা না হলে আরও দেরি হতো! কী জানি, কোনটা ঠিক!
এরপর শুরু হলো আমার ভিসা পাওয়ার অভিযান!