আলাপ-আলোচনা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আয়রন স্ট্রাকচারের ওপর গ্লাস টপ টেবিল। সম্ভবত বারো বাই চার। ওভাল শেপ, চারদিকে বারোটা আর্ম চেয়ার। একটু ভালো মানের রেক্সিনে মোড়ানো। ঘরটায় আর কোনো ফার্নিচার নেই। ইন্টেরিয়র বলতে এক পাশে স্লাইডিং গ্লাসসহ বড় দুটো জানালা আর ফ্লোরে গাঢ় বাদামি রঙের কার্পেট, দেয়াল অফ হোয়াইট। একবার নজর বুলিয়ে ফারজানা সবটুকু দেখে নিল। ফারজানার মনে হচ্ছে, এটাকে শুধু বোর্ডরুম হিসেবে ব্যবহার করা হয় না, অফিসের অন্য স্টাফরা তাদের নিত্যদিনের কাজে ঘরটা ব্যবহার করে; যদিও ডোর প্লেটে ‘বোর্ডরুম’ লেখা।

যেকোনো অর্গানাইজেশনের চরিত্র বুঝতে গেলে সব সময় তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং যেসব মানুষ সেটা চালাচ্ছে, তাদের রিড করতে হয়—এটা জহির স্যারের সঙ্গে কাজ করতে করতে ফারজানা শিখে ফেলেছে। কোনো বিজনেস ডিলে সাকসেস তখনই পাওয়া সম্ভব, যে কোম্পানির সঙ্গে ডিল করতে হবে, সেই কোম্পানি এবং তার ড্রাইভিং সিটের ব্যক্তি সম্বন্ধে ইনস অ্যান্ড আউটস ধারণা যদি থাকে—এটাও জহির স্যারের কাছ থেকে শেখা।

‘সীমান্ত অ্যাপারেলস’ বেশ বড় পোশাক কারখানা। বেশ কিছু আউটসোর্সার, সরাসরি এখান থেকে সোর্সিং করে। তারপরও মালিকের অ্যাকাউন্ট বাড়ানোর চেষ্টার কমতি নেই। বাজারে জোর গুজব আছে, অত্যন্ত লো রেটে কাজ করে তারা বাজার নষ্ট করছে।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘শিনোন ইনকর্প’ হংকং বেজড বায়িং হাউস, ঢাকা’তে তাদের ‘শিনোন ইনকর্প (বিডি)’ নামে যে লিয়াজোঁ অফিস, ওখানেই মার্চেন্ডাইজার হিসেবে ফারজানা কাজ করছে।

ফারজানার সুপিরিয়র জহির হাসান, দুজনে টিম হিসেবে কাজ করে। আরেকজন অবশ্য মাঝেমধ্যে যোগ দেয়, যদি প্রয়োজন পড়ে। তার নাম ‘হিওনদে’। হিওনদে একজন ক্লদিং এক্সপার্ট। জহির স্যার প্রয়োজন মনে করলে হেড অফিস থেকে ওকেই পাঠায়। ফারজানার আট বছরের চাকরিজীবনে হিওনদের মতো টেক্সটাইল এক্সপার্ট দুটো দেখেনি। সাধারণত বড় ধরনের বিজনেস ডিল করার সময় হিওনদের এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দরকার লাগে।

‘জেসি-পেনি’, বড় মাপের আমেরিকান রিটেইলার। আমেরিকা তো বটেই, সারা বিশ্বে তাদের আউটলেটগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তারা গার্মেন্টস আউটফিট সোর্স করে। বাংলাদেশে জেসি-পেনির আউটসোর্সিংয়ের সব কাজ সামলায় শিনোন ইনকর্প (বিডি)। জেসি-পেনির লেটেস্ট রিকয়ারমেন্টটা হিউজ...কনসাইনমেন্টটা এত বড় যে একটা জায়গা থেকে সোর্স করা রিস্কি। যখনই কনসাইনমেন্ট বড় হয়, তখন কনসাইনমেন্টকে ভাগ করে কয়েকটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করানো হয়, যাতে লিড টাইম ঠিক রাখা যায়। সে কারণেই জহির স্যার চারটা ফ্যাক্টরিতে একসঙ্গে কাজটা করাতে চাইছে আর সেই নেগোসিয়েশন করতেই আজ সীমান্ত অ্যাপারেলসে আসা। প্রাইমারি ডিসকাশন আগেই হয়েছে। স্যাম্পলও অ্যাপ্রুভড। এখন শুধু সিএমের নেগোশিয়েশনটা হলেই প্রডাকশন শুরু করা যাবে।

টেবিলের এ প্রান্তে মাঝখানে জহির স্যার, ডানে ফারজানা নিজে আর বাঁয়ে হিওনদে। চাকরির এত বছর পরও যেকোনো বিজনেস ডিসকাশনে ফারজানার নার্ভাস লাগে, কিন্তু একমাত্র বস ছাড়া আর কেউ সেটা বুঝতে পারে না। আজও তার নার্ভাস লাগছে! জহির স্যার বরাবরের মতো স্টেডি এবং কুল। হিওনদে একজন কোরিয়ান। ওদের মঙ্গোলয়েড মুখ দেখে কখনোই বোঝা যাবে না মনে কী চলছে। টেবিলের ঠিক অপোজিটে মাঝখানে বসে আছে তাসনিম খান, সীমান্ত অ্যাপারেলসের ডিএমডি, ডানে আনিসুর রহমান আর বাঁয়ে মোক্তাদির আলম। তাদের মধ্যে সবচেয়ে কুল মনে হচ্ছে মোক্তাদির আলমকে। আলম সাহেব এই ফ্যাক্টরির অপারেশনাল ডিরেক্টর।

ফারজানার কাছে যেসব খবর আছে, তাতে সে খুব ভালো করেই জানে, একমাত্র মোক্তাদির আলমকে সামলাতে পারলেই কেল্লাফতে। ডিলিংসে আলম তুখোড়। কাজ খুব ভালো বোঝে আর কোম্পানির চেয়ারম্যান তার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে। বাকি দুজনের একজন চেয়ারম্যানের ভাই, সেই সুবাদে ডিএমডি। অন্যজন ভাগনেজামাই, আনিসুরকে চেয়ারম্যান নিজেই ‘মাকাল ফল’ বলে ডাকে আর ফ্যাক্টরিতে আনিসুর রহমান ‘লাল মুলো’ নামে পরিচিত। ফ্যাক্টরিতে লাল মুলোর কাজ কী? সেটা অস্পষ্ট! এ দুজনকে যে জহির স্যার তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে, এ ব্যাপারে ফারজানার মনে কোনো সন্দেহ নেই। ৩০ মিনিট পার হয়েছে টেকনিক্যাল ও প্রডাকশনের বিষয়গুলো নিয়ে কথাবার্তা শেষ হয়েছে। ওগুলো নিয়ে সমঝোতাও হয়েছে। এখন সবার মধ্যে একটা টান টান ভাব। ‘সিএম’ রেট কত হবে, এটাই দেখার বিষয়। জহির স্যার কুল। হিওনদে ভাবলেশহীন। মোক্তাদির মনে হচ্ছে খানিকটা বিচলিত। বাকি ডিএমডি আর লাল মুলো অস্থির, এটা স্পষ্ট। ফারজানা নিজে অস্থিরতা চাপার চেষ্টা করছে। ফারজানা ভাবছে, জহির স্যার কোনো দিক দিয়ে আক্রমণটা করবে আর ফলাফল নিজের দিকে নিয়ে আসবে!

ফারজানা জহির স্যারের দক্ষতার ওপর কখনোই সন্দেহ পোষণ করে না। ওনার মতো নেগোশিয়েটর যেকোনো অর্গানাইজেশনের জন্য অ্যাসেট। যেকোনো সিচুয়েশনে উনি কাজ করতে পারেন। জহির স্যারের বিরল প্রতিভা। ফারজানা দেখতে চায়, জহির স্যার কাজটা কীভাবে করে, মানে মাছগুলোকে খেলিয়ে কীভাবে ডাঙায় তোলে।

‘১৯ ডলার ১৩ সেন্ট’...জহির স্যার মুখ খুলল। ‘এটাই আমাদের অ্যাসেসমেন্ট এবং সবচেয়ে রিজনেবল প্রাইজ’...সঙ্গে যোগ করল। তারপর জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল। টেনশন শুরু হয়ে গেছে। ফারজানা স্পষ্ট বুঝতে পারছে তাসনিম খান আর আনিসুর রেগে গেছে। বারবার চেয়ারের এপাশ-ওপাশ করছে আর মুক্তাদিরের মুখের দিক তাকিয়ে আছে। দুজনই টাকার পিশাচ। কিন্তু টাকা কীভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে আয় করতে হবে, সেটা জানে না। শুধু এটুকু জানে, অন্যদের ক্ষতি করে কীভাবে আয় করা যায়।

আলম সাহেব এখনো কিছু বলেনি, তবে তার মাথায় যে চিন্তা চলছে এবং মনে মনে হিসাব-নিকাশ করছে, চেহারা দেখে অনুমান করা যায়। ফারজানার কাছে খবর আছে আলম সাহেব অপারেটরদের প্রতি সহানুভূতিশীল। মালিককে লাভবান করে ঠিকই, কিন্তু অপারেটরদের স্বার্থটাও দেখার চেষ্টা করে। তার মনে মনে হিসাব-নিকাশটা সম্ভবত শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। কারণ, ‘শিনোন’ যে প্রাইজ রেট দিয়েছে, সেটা অবশ্যই রিজনেবল, কিন্তু মালিকপক্ষের আকাশছোঁয়া প্রফিট করার মতো নয়।

তাসনিম খানরা নৈতিকতার ধার ধারবে না। এই প্রাইজ রেট থেকেও বড় রকমের লাভ করার চেষ্টা করবে, আর সে ক্ষেত্রে শ্রমিকের মজুরির ওপর প্রথম কোপটা যাবে।
‘জহির সাহেব, আমাদের রেটটা ২৩ ডলার ২০ সেন্ট ছিল। তফাতটা অনেক! আমরা কি আরেকবার অ্যাসেসমেন্টটা নিয়ে বসব? ফারজানা এখানে আছে, আমি তার সঙ্গে একবার বসতে পারি। উইথ ইওর পারমিশন,’ মোক্তাদির আলম কথা শেষ করলেন।

জহির স্যার একটু সময় নিলেন, তারপর কথা বলা শুরু করলেন...
‘দেখেন আলম সাহেব, আপনি দশবার বসতে পারেন, কিন্তু অ্যাসেস করেছে ফারজানা। ওর অ্যাসেসমেন্ট কখনো ভুল হয় না, এটা আপনি যেমন জানেন, সেই সঙ্গে আমিও জানি। বেকার সময় নষ্ট হবে। আমাদের কাছে অত সময় নেই। আপনাকে আমরা অন্য তিন ফ্যাক্টরিতে কী রেটে কাজ করছি, সেটাও জানিয়েছি। এফওবি সুবিধাটা আপনারা পাচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা, সীমান্ত অ্যাপারেলসের প্রোফাইল আমাদের কাজের সঙ্গে যায় না; তবু আমরা কাজ করাতে চাইছি।

আপনাদের কারখানা গ্রিন ক্যাটাগরি তো দূরের কথা, সাধারণ কমপ্লায়েন্স আপনারা মানেন না। সিএসআরের বালাই নেই। এই কারখানা অ্যাকর্ডের পর্যবেক্ষণে ইয়েলো ক্যাটাগরির। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার আপনারা লেবারদের ট্রাবল দেন। লেবার কোর্টে আপনাদের ব্যাপারে একটা ইনকোয়ারি চালু আছে। ব্যবসা করতে হলে মিনিমাম রেসপন্সিবিলিটি দেখাতে হয়। যদি কাজ করতে হয়, আমাদের রেটেই কাজ করতে হবে।’ জহির স্যার ঝড়ের বেগে বলে গেল। শেষ বাক্যটা সম্ভবত তাসনিম খানের উদ্দেশ্যে বলেছেন।

ফারজানা এ রকম আক্রমণাত্মক অ্যাপ্রোচে জহির স্যারকে কখনোই দেখেনি। একসময় ফারজানার মনে হচ্ছিল, স্যার মনে হয় এদের কাজটা দিতে চাইছে না। আলম সাহেবের বিস্মিত মুখটা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, সে কোনোভাবে বুঝতে পারছে না, সমস্ত খবর কীভাবে জহির স্যার পেল। আলম সাহেব জানে, সীমান্ত অ্যাপারেলসের যে প্রোফাইল, সেটা দিয়ে শিনোন ইনকর্প থেকে কাজ পাওয়া কত কঠিন!
রাস্তায় গাড়িতে বসে বিশেষ কোনো কথা হলো না। একবার শুধু জহির স্যার বললেন, ওরা ওই রেটেই কাজ করবে আর করতে ওরা বাধ্য। বলার সময় স্যারকে খুব কনফিডেন্ট মনে হলো।

রাত ১১টা। ফারজানা শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ ফোনে মেসেজ আসার রিংটোন বেজে উঠল। মোক্তাদির আলমের মেসেজ, ‘উই আর রেডি টু মেক আ ডিড, প্লিজ প্রসিড।’

ফারজানা কেন জানি সুখবরটা জেনেও খুশি হতে পারছে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে টাকার পিশাচ মালিক দুজনের আচরণের কথা। মনে হচ্ছে, শ্রমিকদের ঠকানোর ব্যাপারে ও নিজে সাহায্য করল। ‘মাকাল ফল’ আনিসুরের চাহনির কথা ভুলতে পারছে না, যে চাউনির মানে একমাত্র মেয়েরাই বোঝে।
* (কারও জীবনের সঙ্গে ঘটনার মিল থাকলে সেটা নিতান্তই কাকতালীয়।)
* লেখক: জুনাইদ হাসান, মোহাম্মদপুর, ঢাকা