বাল্যবিবাহ নিরসনে চর ও হাওরাঞ্চলে ভিন্ন দৃষ্টি প্রয়োজন

দেশব্যাপী বাল্যবিবাহের ঊর্ধ্বগতি জাতীয় জীবনের একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট আর বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি একটি আরেকটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একেকটি ভৌগোলিক অবস্থানে তাই বাল্যবিবাহের চিত্রটিও একক রকম।

বাংলাদেশের জেলা শহরগুলোতে বা রাজধানীতে স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা আপামর কিশোরীদের প্রকৃত চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে না। দেশের পিছিয়ে পড়া, বিশেষ করে চর ও হাওরাঞ্চলগুলোতে বাল্যবিবাহের চিত্রটি আরও নাজুক। চর ও হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ গ্রামেই অপ্রতুল অবকাঠামোগত অসুবিধার কারণে অভিভাবকেরা অল্প বয়সেই কন্যাসন্তানের বিয়ের পরিকল্পনা করছেন।  

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, বাংলাদেশ সরকার বাল্যবিবাহের প্রসারকে হ্রাস করতে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯’ বাতিল করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন–২০১৭ পাস করে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং কঠোর শাস্তির প্রতি মনোনিবেশের জন্য এ আইনকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। সরকার ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনো বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ বাল্যবিবাহের হার রয়েছে।

২০১৪ সালের ইউএনএফপিএর জনসংখ্যা প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ে (যাদের বয়স ১৮ বছরের কম) বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এর হার সর্বোচ্চ। জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত কিছু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী কোভিড অতিমারি চলাকালে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য বিয়ের আইনগত বয়স মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর। উল্লেখিত বৈধ বয়সের কম বয়সী কোনো ছেলে ও মেয়েকে যদি বিয়ে দেওয়া হয়, তখন তাকে বলা হবে বাল্যবিবাহ। রাষ্ট্র ছেলে ও মেয়ের ক্ষেত্রে বয়সসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৮ তো অনেক দূর, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিয়ে হচ্ছে ১২–১৪ বছরের মধ্যেই। চর ও হাওরাঞ্চলের দুর্গম এলাকাসমূহে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছানো, আইনের বিশেষ বিধান, জাল জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট প্রদান, অনিবন্ধিত বিবাহ এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকায় বাল্যবিবাহ বন্ধ করা রীতিমতো অসাধ্য।

সামাজিক রীতিনীতি ভেঙে ফেলাটা এখনো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অভিভাবকেরাই তাঁদের কন্যাসন্তানের বিয়ে–সম্পর্কিত প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। কিন্তু তাঁরা প্রায়ই আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের দ্বারা তাদের মেয়েদের জন্য একটি ‘ভালো বর’ ধারণার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে থাকেন।

বিয়ে, সম্ভাব্য ভালো বর এবং বিয়ের বয়স সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মায়ের থেকে বাবার বেশি জোরালো ভূমিকা রয়েছে বলে মনে হয়েছে। সব ক্ষেত্রে ভালো বিয়ে দেওয়া, ভালো বর ভালো ঘর, যেখানে মেয়েটা ভাত-কাপড়ে কতটুকু ভালো থাকবে, সেটি মুখ্য নয়। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, সিলেট ও হবিগঞ্জ জেলায় লন্ডনি পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়াটা তথাকথিত সোশ্যাল স্ট্যাটাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমনকি ‘মৃত্যুর পূর্বে নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চাওয়ার ইচ্ছার কাছে হাজারো কিশোরীর স্কুলজীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া, পিতৃমাতৃহীন কিশোরীদের স্কুলে না পাঠিয়ে দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করে দাদা-দাদি, নানা-নানি বা মামা-চাচারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন। এ পরিস্থিতি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে, বয়োপ্রাপ্ত হলেই মেয়েকে আর ঘরে না রাখার উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে। স্থানীয় ক্ষমতাকাঠামোর চাপে ধর্মীয় নেতা আর কাজিরা বাল্যবিবাহ পড়াতে বাধ্য হন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য একটি অজুহাত মাত্র। এ দারিদ্র্যের বা অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার দোহাই দিয়ে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকেরা। অপরদিকে সুন্দর ভবিষ্যতের লক্ষ্যে ছেলেসন্তানের শিক্ষায় বিনিয়োগ করছেন ভবিষ্যতে সে মা–বাবাকে দেখবে বলে। মেয়েসন্তানের জন্য বিনিয়োগটা যেন শুধু যৌতুকের জন্যই! কারণ, বয়স যত কম, যৌতুকের পরিমাণও তত কম।

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিদ্যালয় ছুটি থাকার ফলে বাল্যবিবাহ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। মহিলাবিষয়ক ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রণোদনা প্রকল্প বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করছে। দরিদ্র পরিবারগুলোতে এ সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতা বাড়ানো দরকার।  

বিয়ে নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের সম–অধিকার ও ক্ষমতায়নের বিষয়টি উপেক্ষিত ও অনুপস্থিত। বিয়েতে কিশোরী মেয়েদের অংশগ্রহণ বা মতামত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই, যেখানে সে নিজের শিক্ষা, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন, উপার্জন—এসব বিষয়ে কথা বলতে পারে। তারা শুধু পারে মুখ বুজে মা-বাবার চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে বিয়ের পিড়িঁতে বসতে, যার মাশুল দিতে হয় সারা জীবন ধরে।

তাই তো জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া বাল্যবিবাহকে একধরনের সহিংসতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিশোরীর অধিকার মানবাধিকার—এ বিষয় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ডিসকোর্সে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। যে কারণে বাল্যবিবাহর ক্ষতির প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ হলো এর ফলে মেয়েদের শারীরিক ক্ষতি হয়, অল্প বয়সে সন্তান হলে, স্বাস্থ্য নষ্ট হলে সংসার ভেঙে যায়।

যেন মেয়েরা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রবিশেষ। দ্বিতীয়ত, মানবাধিকারের বিষয়টি একেবারেই আসে না। একজন মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হলে সে মা-বাবার স্নেহ–ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। তার শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে উন্নয়নের মূলধারা থেকে সে ছিটকে পড়ে।

অথচ উপযুক্ত বয়সে বিয়ে হলে মেয়েটির শিক্ষা ও সুস্থভাবে বড় হওয়ার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়, মেয়েটি বড় হয়ে আত্মনির্ভর হতে পারে, পরিবারে ও সমাজে সক্রিয়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, পরিবারের যেকোনো সমস্যায় এগিয়ে আসতে পারে, পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে পারে ইত্যাদি।

পিতৃতান্ত্রিকতা সমাজে ঘরের মেয়ে ঘরেই বোঝা হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিতে পারিবারিক অসম ক্ষমতার কাঠামোতে ঘরের বোঝা মেয়ে বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে পায় আরেক মাত্রা। অল্প বয়সী বউ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ, ‘সাত চড়ে রা নেই’ টাইপ আদর্শ বউ হয়ে ওঠে। শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামী নিজের মতো করে গড়েপিটে নিতে পারে, যা পারিবারিক সহিংসতা, বিশেষত যৌন সহিংসতার একটি বড় অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত।

বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংগঠনের (কেয়ার, সেভ দ্য চিলড্রেন, ওয়ার্ল্ডভিশন) প্রকল্প এলাকায় দেখা গেছে যে ১৮ বছরের কম বয়সী অনেক মেয়েই নিজেদের বাল্যবিবাহের হাত থেকে বাঁচাতে বিয়ে স্থগিত বা বিলম্বিত করতে সক্ষম হয়েছে।

তাদের প্রায় সবাই সামাজিক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে (যেমন প্রতিবেশী কর্তৃক মাতা–পিতা হেয় হওয়া, নেতিবাচক মন্তব্য), শোষণমূলক সামাজিক নিয়ম-প্রথার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাদের কেউ কেউ পড়াশোনা চলমান রেখেছে, কেউ দক্ষতাভিত্তিক কাজে নিযুক্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্কুলশিক্ষক (শ্রেণিকক্ষে সচেতনতা অধিবেশন), ইউপি সদস্য (কমিউনিটির লোকদের সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধি অধিবেশন), এনজিও কার্যক্রম (কিশোর-কিশোরী ক্লাব, কমিউনিটি গ্রুপ), বিভিন্ন সরকারি বিভাগ (হটলাইন, স্কুলের সঙ্গে সমন্বয়, বিশেষ কমিটি, কর্মশালা), বিবাহ নিবন্ধনকারী এবং বিশ্বস্ত নেতা (নৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং একজনের সঙ্গে আরেকজনের আলাপচারিতা)। উন্নয়ন সহযোগীরা সরকারের সঙ্গে মিলে এই সামাজিক ব্যাধিটিকে প্রতিরোধ করতে একত্রে বসছে, গোলটেবিল বৈঠক করছে।

১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে যেসব সুপারিশ উঠে এসেছে:
—জন্ম ও বিয়ে নিবন্ধনের ডিজিটাল সনদ প্রক্রিয়া চালু করা (জন্মনিবন্ধন সনদ যাচাই এবং বিয়ের সময় বর–কনের জন্মনিবন্ধন সনদ যাচাই)।
—দ্বিস্তরবিশিষ্ট বয়স যাচাইপ্রক্রিয়া (স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে বয়স যাচাই ও স্কুল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বয়স নিশ্চিত করা) চালু করা।

—বিয়ে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের নিবন্ধন বা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।

—চর ও হাওরাঞ্চলের পরিবারগুলোতে কন্যাশিশুদের স্কুলে পাঠানো এবং বিয়ে না দেওয়ার শর্তে সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতা বাড়ানো যেতে পারে।

—চর ও হাওরাঞ্চলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অবকাঠামো সুবিধা বৃদ্ধি করা জরুরি (স্কুল, কলেজ ইত্যাদি)।

—বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে একটি কমন ডেটাবেজ বা তথ্যভান্ডার তৈরি করতে হবে।

—বিয়ে নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন যাচাইয়ে কাজিদের প্রশিক্ষণ প্রদান।

—জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও বাস্তবায়ন হওয়াটা জরুরি।

—বাল্যবিবাহের কুফল, উপযুক্ত বয়সে বিয়ের প্রভাব এবং মেয়েদের ক্ষমতায়নের গুরুত্ব বিষয়ে বার্তা প্রদানে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং ধর্মীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ ও সচেতন করা প্রয়োজন।

—বাল্যবিবাহর ঝুঁকিতে থাকা কন্যাশিশুদের চিহ্নিত করে তাদের জীবন দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।

—শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের যত্ন, উন্নয়ন ও সুরক্ষায় বিশেষভাবে কাজ করা দরকার।

—মা–বাবা, পরিবার ও সমাজের প্রবীণ সদস্য এবং পুরুষ-কিশোরদের সম্পৃক্তকরণ জরুরি।

—লিঙ্গভিত্তিক নিয়মনীতি বা প্রথাকে ভেঙে কন্যাশিশুদের মানবাধিকার ও নেতৃত্বের গুরুত্ব তুলে ধরে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি ও উন্নয়ন সহযোগীদের একসঙ্গে সমন্বিত উপায়ে কাজ করা।

—বাল্যবিবাহ বন্ধ করা কিশোরী মেয়ে এবং তার পরিবারের জন্য একটি কার্যকর ফলোআপ করতে হবে।

—মেয়ের বয়স কমাতে মা–বাবা কর্তৃক ব্যবহৃত হলফনামার ভুল কাগজপত্র ব্যবহার পরিত্যাগ করা।

—বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের বিষয়ে পুরুষদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

লেখক: সৈয়দা আশরাফিজ জাহারিয়া প্রধান: জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন বিশেষজ্ঞ