আমার প্রথম ভালোবাসা প্রথম আলো

প্রথম আলো আয়োজিত ‘পাঠকের মুখোমুখি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী পূজা সাহাফাইল ছবি প্রথম আলো

প্রথম আলো আমার কাছে প্রথম ভালোবাসার মতো। প্রথম আলোর একেবারে প্রথম সংখ্যা থেকে আজ পর্যন্ত সেই ভালোবাসা অটুট রয়েছে। একসময় ছিলাম নিবিষ্ট পাঠক। এখন পর্যন্ত যৎকিঞ্চিৎ লেখালেখি করি, তার শুরুটাও হয়েছিল প্রথম আলোর হাত ধরেই। দেশে থাকতে প্রিন্ট পত্রিকার বিশেষ বিশেষ পাতা, কখনোবা বিশেষ সংখ্যা আলাদা করে রেখে দিতাম আবার পড়ব বলে। এখনো অনলাইনে অনেক লিংক সংরক্ষণ করে রাখি পরে পড়ব বলে। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন প্রথম আলোর পাতায় একাধিকবার উঁকি দিই না। তাই দেশে এবং প্রবাসে নির্ভরযোগ্য খবরের জন্য এখন পর্যন্ত প্রথম আলোই আমার প্রথম ভরসা।

প্রথম আলোর ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘জীবনবদলের কারিগরেরা’ শিরোনামে একটা লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখাটার অসিলায় জীবনে প্রথমবারের মতো পুরস্কারও পেয়েছিলাম। এটা এখন পর্যন্ত আমার জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন। আমি সব সময়ই ‘দূর পরবাস’ পাতায় লিখি। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন উপলক্ষে মূল পাতায় লেখা দিই। এ বছর মা দিবস উপলক্ষে ছুটির দিনে একটা লেখা দিয়েছিলাম ‘মায়ের যে কথাটা ঢাকায় আমার জীবনকে সহজ করে দিয়েছিল’ শিরোনামে। লেখাটা পাঠক উৎসাহব্যঞ্জকভাবে গ্রহণ করেছিল।

প্রথম আলোর বর্তমান স্লোগান ‘হারবে না বাংলাদেশ’ খুবই যুগোপযোগী বলে আমার মনে হয়। কারণ, আমরা এখন এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে ভালোর সাথে কেউ থাকতে চায় না। সবাই যেকোনোভাবে স্বার্থোদ্ধারে ব্যস্ত। ভালো হোক মন্দ হোক, যেখানে নিজের স্বার্থ, আমরা শুধু সেখানেই সময় দিই। কিন্তু প্রথম আলো একটা ‘ফাইন লাইন’ মেনে চলছে। এটা আমার কাছে খুবই আশাব্যঞ্জক একটা বিষয়। আর আলোর পথে বলতে প্রথম আলো এমনসব উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত, যেগুলো আলোকিত মানুষ তৈরির ভিত্তি।

এ ছাড়া আমি মনে করি, ‘কিশোর আলো’ প্রথম আলোর এক যুগান্তকারী উদ্যোগ। আমরা একসময় নিয়মিত রহস্যপত্রিকা পড়তাম। পাশাপাশি কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দমেলা পড়তাম। আনন্দমেলার বিশেষ সংখ্যাগুলো সব সময়ই আমাদের জন্য ছিল বাড়তি আকর্ষণ। দেশে থাকতে একইভাবে নিয়ম করে কিশোর আলো সংগ্রহ করতাম এবং পড়তাম। এখনো অনলাইনে কিশোর আলো নিয়মিত পড়া হয়। কিশোর আলো আমাদের শিশু থেকে শুরু করে তরুণদের মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

এবার আসি আমার কিছু পর্যবেক্ষণ বিষয়ে। আমি গত কয়েক বছর দেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় দেখেছি আমাদের গ্রামীণ শিশু–কিশোর থেকে শুরু করে তরুণদের হাতেও মোবাইল পৌঁছে গেছে। এতে আমি খারাপ কিছু দেখি না। কিন্তু সব প্রযুক্তিরই দুটো দিক থাকে—ভালো আর মন্দ। আমার মনে হয়, প্রথম আলো মোবাইল টেলিকম কোম্পানিগুলোর সহায়তায় আমাদের নতুন প্রজন্মকে মোবাইলের ভালো ব্যবহারের দিকে উৎসাহী করে তুলতে পারে। পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করে ফ্রিল্যান্সিংয়ে দক্ষ করে তুলতে পারে। এতে করে একদিকে যেমন বেকারত্ব দূর হবে, অপরদিকে দেশ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে।

আমাদের দেশের মূল সমস্যার নাম যেমন অধিক জনসংখ্যা, তেমনি সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার নামও এটাই। দেশ–বিদেশের কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতায় দেখেছি চীন কী চমৎকারভাবেই না তার জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করেছে। সব জনগণকে বড় বড় ডিগ্রি নেওয়ার দরকার নেই। যে যেই কাজটা করবে, তাকে শুধু সেই কাজটার সঙ্গে ভাষাগত ন্যূনতম দক্ষতার প্রশিক্ষণ দিলেই কিন্তু একজন মানুষ সমস্যা থেকে সম্ভাবনায় রূপান্তরিত হয়। এসব দক্ষ জনশক্তির চাহিদা বিশ্বজোড়া। আমাদের দেশের মানুষ যেকোনো ধরনের কাজ করে স্বাবলম্বী হতে দরকার শুধু একটু দিকনির্দেশনা।

এখানে আরেকটা ব্যাপার উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি। সেটা হলো বাংলাদেশে পরিচয়পত্র–সংক্রান্ত কাগজপত্র বানানোর বিবিধ জটিলতা আছে। একেবারে জন্মসনদ থেকে শুরু করে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট কোনোটা বানানোই সহজ নয়। এগুলো বানাতে গেলে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন রকমের হয়রানির শিকার হতে হয়। এখন সময় এসেছে জাতীয় আয়কর মেলার মতো করে ‘পাসপোর্ট’ মেলা করার, যেখানে সহজেই হাতে–কলমে পাসপোর্ট তৈরি ও নবায়নের ওপর কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে। এসব ব্যাপারে প্রথম আলো অবশ্যই সরকারি সংস্থাগুলোর জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করতে পারে।

প্রবাস থেকে দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়টা এখনো অনেক জটিল ব্যাপার। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দেশের ব্যাংকে টাকা পাঠালে বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র চাওয়া হয়। এটা ঠিক আছে যে প্রথমবার বিষয়টা যাচাই করার জন্য এসব কাগজপত্র জরুরি কিন্তু এটা যদি প্রতিবারই করতে হয় তাহলে এখন প্রবাসী আর উৎসাহ পান না। তখন সে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান। এতে দুই ধরনের ঝুঁকি থাকে। প্রথম হুন্ডির টাকা দেশে ঠিকঠাক পৌঁছবে তো। দ্বিতীয়ত দেশ একটা বিশাল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। সময় এসেছে এ বিষয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের। আর সেই কাজটা প্রথম আলো খুব ভালোভাবে করতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস।

ছবি: সংগৃহীত

এবার আসি দূর পরবাস পাতার বিষয়ে। এই পাতা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিদের একই সুতায় বাঁধে। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, দেশের পাঠকের পাশাপাশি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছেন প্রথম আলোর পাঠক। আর তাঁরা প্রথম আলোর পাতায় এসে শুরুতেই নজর রাখেন দূর পরবাসে। তাই আমার মনে হয়, এ পাতার কলেবর বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। আর দূর পরবাস থেকে নির্বাচিত লেখাগুলো প্রথম আলোর প্রিন্ট সংস্করণেও প্রকাশ করা জরুরি। এতে করে দেশের সঙ্গে প্রবাসীদের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

ইদানীং প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনের একটা বিষয়ে একটু আলোকপাত করতে চাই। সেটা হচ্ছে ইউটিউবের মতো খুবই চটুল শিরোনাম দিয়ে অনেক সংবাদ প্রকাশ করা হয়। যেমন অমুক একি বললেন! আমার মনে হয় প্রথম আলোর মতো এত বড় মাপের পত্রিকা এগুলো সহজেই এড়িয়ে চলতে পারে। আর সেলিব্রিটিদের ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে খবর করাটাও আমার কাছে দৃষ্টিকটু লাগে। প্রথম আলো নিজেই নিজের মানদণ্ডটা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে আমার মনে হয় এ ধরনের খবর প্রকাশ তার সঙ্গে যায় না।

শেষে বলতে চাই, প্রথম আলো প্রথম আলোই। এখনো বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম হচ্ছে প্রথম আলো। প্রথম আলো তার দূর পরবাস পাতার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে থেকে কত যে লেখক আবিষ্কার করেছে, তার তুলনা নেই। আমি নিজেও নিজের মুখচোরা স্বভাব থেকে বেরিয়ে এসে অসংকোচে নিজের মতপ্রকাশের সাহস দেখিয়েছি প্রথম আলোর কারণেই।

প্রবাসের সঙ্গে দেশের জীবনযাপনের তুলনা, প্রবাসীর বোবা কান্না, প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মের জীবনবোধ এমন অনেক বিষয় নিয়ে ভাবনাটা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারছি প্রথম আলোর কল্যাণেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ কিন্তু প্রথম আলো সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য। তাই আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তুলনায় প্রথম আলোকে এখন পর্যন্ত বড় প্ল্যাটফর্ম মনে করি। জন্মদিনে প্রথম আলোর জন্য অকৃত্রিম শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা। প্রথম আলো তার রজতজয়ন্তী পেরিয়ে একসময় সুবর্ণজয়ন্তী এবং হীরক জয়ন্তী উদ্‌যাপন করবে বলেই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।