প্রায় সরকারহীন দেশে আমরা উলুখাগড়ার প্রাণ, বাঁচান
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে দেশে বড় এক পরিবর্তন আসছে। টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। গত সোমবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে এ তথ্য জানিয়েছেন। আমরা আমজনতা টেলিভিশনের সামনে অধীর আগ্রহে বসে এ বক্তব্য শুনেছি।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিন দিন পেরিয়ে গেছে। অথচ যে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের আশায় অধীর আগ্রহে দেশবাসী, সেই পরিবর্তনের দেখা এখনো মেলেনি। এখন পর্যন্ত নতুন সরকার গঠিত না হওয়ায় কার্যত অচল হয়ে পড়েছে দেশের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শিক্ষার্থী-জনতার ভাষা বুঝতে পারেনি ক্ষমতাসীন দল। তাই সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগ করে এই আন্দোলন দমাতে চেয়েছিল সরকার। এর ফল অসংখ্য ছাত্র-জনতার প্রাণহানি। যেসব প্রাণহানি এখন শুধুই সংখ্যা হয়ে আছে।
আমরা যাঁরা আমজনতা, আমরা যাঁরা একদম সাধারণ মানুষ, যাঁরা কেবল দুবেলা দুমুঠো খাবার আর নিশ্চিন্তে-নিরাপদে বেঁচে থাকার আশায় বেঁচে থাকি; এই আন্দোলন চলাকালে তাঁরা একদিকে আশায় বুক বেঁধেছিলেন, আরেক দিকে ছিলেন আতঙ্কিত। আশায় বুক বেঁধেছিলেন কারণ, দীর্ঘদিনের একচেটিয়া শাসনের অবসান হতে যাচ্ছে। আপামর মানুষ শান্তি ফিরে পাবে, বদল আসবে। আর আতঙ্কিত ছিলেন কারণ, এসব মানুষেরই সন্তান, ভাই, বোন ও স্বজন রাস্তায় নেমে আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। আর সরকারি বাহিনীর বলপ্রয়োগে, গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন তাঁরাই। এই আতঙ্কে ঘুমাতে পারেননি অনেকেই।
কিন্তু কার্যত সরকারহীন এই দেশে একই আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটছে আমাদের মতো আমজনতার। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরপরই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, গণভবন, জাতীয় সংসদ ভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এই দৃশ্য দেশবাসীসহ সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোও এই লুটপাটের ছবি প্রকাশ করেছে। দেশের সম্পদ এভাবে লুট করার ঘটনা কি আতঙ্কের নয়? শুধু তা–ই নয়, শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের ঘটনায় আনন্দমিছিল থেকে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়ি, থানা, গণমাধ্যমের কার্যালয়, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা ও পিটুনিতে পুলিশ সদস্যসহ দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আন্দোলনের আগেও মৃত্যু দেখেছে জনতা, আন্দোলনের পরে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পরও রক্তে রঞ্জিত হলো নানা প্রান্ত। এসব নিহত মানুষও আমজনতা, কারও না কারও স্বজন।
বিজয় মিছিলের পরদিনও সারা দেশে ভিন্নমত, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সন্ধ্যার পর মূল সড়ক থেকে গলি পর্যন্ত অস্ত্র হাতে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ভীতি ছড়াচ্ছে। ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। গভীর রাতে অস্ত্র নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় শোডাউন চলছে। বাসাবাড়িতে ডাকাতি হচ্ছে, দোকান ভেঙে জিনিসপত্র লুট করা হচ্ছে। সন্ত্রস্ত হয়ে আছে মানুষ। থানায় পুলিশ নেই, কোথাও কোনো পাহারাদার নেই। তাই কোনো দিক থেকেই প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। আগে মানুষ একচেটিয়া শাসনব্যবস্থায় জোর গলায় কোনো কথা বলতে পারেনি, এখনো পারছে না। কারণ, এ কথা শোনার মতো কোনো কর্তৃপক্ষ দেশে এখনো নেই। তাহলে আমজনতা তাদের অধিকারের কথা কী সব সময় বুকে ব্যথা নিয়ে গিলে খাবে! কোনো পরিবর্তনই কী তাদের কথা বলার সুযোগ দেবে না?
সোমবার দুপুর থেকে যাঁরা নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা কেন সেই দায়িত্ব পালন করছেন না, জানা নেই। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সড়কে কোনো ট্রাফিক–ব্যবস্থা ছিল না। গত সরকারের সময় মানুষ গুলির শব্দ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেও সেই একই অস্ত্রের ঝনঝনানি সুর বেজে যাচ্ছে। তাহলে পরিবর্তন কোথায় এল! দীর্ঘদিন পর আশার সঞ্চার হয়েও তাই হতাশ হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
যখনই ক্ষমতার পালাবদলের প্রসঙ্গ, যখনই আন্দোলন, তখনই সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতি হয়। তাহলে কি এই দেশে সাধারণ মানুষ উলুখাগড়ার প্রাণ! রাজায় রাজায় যুদ্ধ হবে আর শুধু যাবে উলুখাগড়ার প্রাণ! কিন্তু যুগে যুগে তো এই উলুখাগড়াই আন্দোলনে, গণবিস্ফোরণে সাহস জুগিয়ে গেছে। আন্দোলনের আগে ও পরে এত এত মানুষের প্রাণ গেলে, আর কারা আপনাদের পেছনে যাবে? আতঙ্কিত হয়ে থাকলে আর কি আপনাদের পেছনে সাহস জোগাতে যাবে এই উলুখাগড়া? তাই সবার আগে দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। দেশের সম্পদ রক্ষা করুন, সাহস দিন, বাঁচান আমাদের মতো উলুখাগড়ার প্রাণ।