সন্ধ্যার তুমি

অলংকরণ: আরাফাত করিম

শীতের সন্ধ্যা। বরফগলা পাহাড়ের পাদদেশে যেমন ঠান্ডা হাওয়া বয়, তেমনি ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে দূরন্ত গতিতে। জানালার পাশের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছি। পেছনের দিকে মাথা ঠেকিয়ে। বর্ষীয়ান এ লোহার কামরা, না জানি কত দিনের কত ঘটনার সাক্ষী হয়ে, কত বেদনার স্মৃতি বয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। বয়সের ছাপস্বরূপ মরিচার আবরণকে বছর বদলাতেই রং লেপে ঢেকে দেওয়া হয়।

পরিয়ে দেওয়া হয় নতুনের মুখোশ! ওপরের দিকে তাকিয়ে মরিচা পড়া লোহার পুরোনো পাতের দিকে ক্লান্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে এমনই নানা কথা ভাবছিলাম। সারা শরীরে ক্লান্তির বাজনা বাজছিলো পুরোটা সময় ধরে। চোখ দুটো বুজে আসছে। আর বাধা দিতে চাই না ওদের। চোখ বুজে দুই পা ছাড়িয়ে প্রায় আধশোয়া অবস্থাতেই চলছিলাম। নিজেকে এলিয়ে দিয়েছিলাম পুরোনো ট্রেনের ঝুমঝুম শব্দের মধ্যে। বন্ধ চোখে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ট্রেনের দোলুনিতে দু চোখ বুজে পড়ে থাকতে আরাম বোধ হচ্ছে। হঠাৎই তাতে বাধা দিয়ে পায়ের দিকে ধাক্কা দিয়ে উঠল যেন কেউ। চোখ খুলে নিচের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম।

সন্ধ্যার আলো–আঁধারি। ট্রেনের লাইটগুলো এখনো জ্বালেনি। অন্ধকারের মধ্যেই অস্পষ্টভাবে দেখলাম রোগা শরীরের একটা মেয়ে ঠিক আমার সামনের সিটে বসা। ধড়ফড় করে উঠে ঠিক হয়ে বসলাম। সামনের সিটে যে কোনো মেয়ে বসেছে, সেটা খেয়ালই করা হয়ে ওঠেনি এতক্ষণে। ট্রেনে ওঠার পরই বেশ ক্লান্ত লাগছিল।

ঠিকঠাক হয়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম সন্ধ্যার আকাশের দিকে। স্বল্প আলোকে দেখছিলাম রেল লাইনের পাশের ছোট ছোট টিনের ঘর, ফসলি মাঠের ব্যস্ত কৃষক আর তাদের মাথার ওপর সন্ধ্যার রক্তিম আকাশ। সব কিছুই ছুটে চলছে! ক্লান্তভাবে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলাম ট্রেনের মধ্যে। সামনের সিটে বসা মেয়েটাকে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, তার ঘন কালো চুলগুলো বাইরের বাতাসে উড়ে মুখের ওপর চলে আসছে। রুগ্ন মলিন মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে রুক্ষ চুলগুলো, সেদিকে তার তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই বলেই মনে হলো। মনে হলো জানালা দিয়ে সে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, হয়তো চারপাশের অন্ধকার নামা দেখছে। কিংবা সেদিকেও খেয়াল নেই।

খানিকবাদে ট্রেনের কামরাগুলোয় আলো জ্বেলে উঠল, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের অন্ধকার নেমে গেছে চারপাশে। রাতের অন্ধকার আকাশে আজ চাঁদের দেখা নেই, ক্রমেই অন্ধকার বাড়ছে চারদিকে, সেই অন্ধকারের মধ্য থেকে কনকনে ঠান্ডা হওয়া প্রবেশ করছে জানালা দিয়ে, শীত শীত করছিল। তবুও জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিলাম, ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে আমার ওপর দিয়ে। বেশ ভালোই লাগছে। কিন্তু আমার ভালো লাগা বাকিদের কাছে হয়তো ভালো লাগল না। সবাই একযোগে জানালা বন্ধ করার কড়া তাগিদ দিলেন, তাদের মতকে অগ্রাহ্য করার ইচ্ছে কিংবা উপযুক্ত কারণ কোনোটাই আমার নিকট ছিল না, তাই ভালো লাগার কথা ভুলে জানালার ওপর কাচ টেনে আনলাম।

একটি লোকাল ট্রেনে চলছিলাম, ভাড়া শুরু আট টাকা থেকে, অনেকেই বসবার মতো জায়গা না পাওয়াই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যাচ্ছেন। দেখলাম কয়েকজন বৃদ্ধ নারী দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে হাঁটুর ওপর ভর করে বসে পড়লেন। এ ধরনের লোকাল ট্রেনে চলছি অনেক দিন যাবৎ। এ সকল গাড়িতে ভাড়া কম, যাত্রী বেশী। রক্ত মাংসের শরীরের এই যাত্রীদের চেয়ে লোহার তৈরি এ রেল গাড়িগুলোর মূল্যই এখানে বেশী! শুনতে খটকা লাগলেও শতভাগ সত্যি এ তথ্য। বেশীরভাগ দিনেই উপচে পড়া ভিড়, সে ভিড়ের মধ্য থেকে মাঘের শীতেও ঘাম ঝড়ে অনেকের গা বেয়ে। আজ ভিড় কম। যারা বসার জায়গা পাননি, তারা দাঁড়িয়ে আছে স্বাভাবিকভাবেই। গাদাগাদি করে দাঁড়াতে হচ্ছে না।

তাকিয়ে দেখলাম আমার সামনে দাঁড়িয়ে একজন ঘুমে ঝিমাচ্ছেন। বয়স আনুমানিক সত্তর হবে, মুখে সাদা দাড়ি, মাথায় জালের পাতলা টুপি। একমনে ইচ্ছা হচ্ছিল উঠে গিয়ে তাকে বসতে দিই, আবার মনে হচ্ছিল নিজেরই ক্লান্ত লাগছে। অনেকক্ষণ ইতস্তত করতে করতে এক ধাক্কায় উঠে দাঁড়ালাম।

বৃদ্ধ লোকটাকে জায়গা ছেড়ে বসতে দিলাম। সে তেমন কোনো কৃতজ্ঞতা দেখালেন না, তবে তার বয়স্ক উজ্জ্বল সাদা মুখের মধ্যে তৃপ্তির ছাপ দেখতে পেলাম। জানালার পাশে বসা সেই মেয়েটা মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে, দেখলাম সাদাসিধে মুখের মেয়েটা দারুণ রোগা। মুখটাতে অস্বাভাবিক রকমের সাদাটে ভাব, যেন এক ফোঁটাও রক্তের ছোঁয়া নেই তাতে। মেয়েটার মাথার ওপর আঁচল নেই, কালো সিল্কি চুলের ওপর কারেন্টের আলো, নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমার ওদিকে চেয়ে অনেকক্ষণ কাটল।

অস্বাভাবিক রকমের সাদাটে মুখের নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা রোগা মেয়েটাকে বেশ মায়াবী লাগছে, কী মাধুর্য!

চোখ ফিরিয়ে আনলাম, অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম, মনে মনে সংকল্প করলাম আর কোনো বিপর্যয় নয়, কেবল সংযম।

যে লোকটাকে উঠে গিয়ে বসতে দিয়েছিলাম পরের স্টেশনেই সে নেমে গেল। চুপিসারে নেমে যাচ্ছিলে, সামনের সাদাটে মুখের মেয়েটা হাত নেড়ে আমার দিকে বলে উঠলো, ‘এই আপনি এসে বসুন, সিট টা তো আপনার। উনি চলে যাচ্ছেন।’ আমার সঙ্গে অনেকেই মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল। এই স্তদ্ধ কালো অন্ধকারের মাঝে ছুটে যাওয়া রেলগাড়িটার যাত্রীসকলও বেশ ক্লান্ত। সারা দিনের ক্লেশ ফুটে উঠছে তাদের মুখজুড়ে। এ স্তদ্ধ নীরবতায় ট্রেনের ঝুমঝুম শব্দ ছাড়া কোনো ধরেনের শব্দই তেমন ছিল না, হঠাৎই এই গাঢ় নীরবতা ভেঙে শব্দ করাতেই সকলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে তার সাদাটে রক্তহীন মুখের দিকে তাকাল। রেলের স্বল্প বৈদ্যুতিক আলোয় তার মুখের ভাব দেখে মনে হলো সে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। চঞ্চল চোখজোড়া মহূর্তেই নিচের দিকে নেমে এল।

আমিও আর না ঘাটিয়ে বসে পড়লাম। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, দেখলাম সে আপনা হতেই চোখ উঠিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা ভাবে হালকা হাসল। মনে হলো এটা ওর অতিথি আপায়্যনের রীতি। তার অদ্ভুত এ ভঙ্গিতে আমারও গাল প্রসারিত হলো। মুচকি হাসলাম। দেখলাম সে চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করছে। গায়ের ওড়নাটা আর আঁটসাঁটভাবে পরে নিচ্ছে। সম্ভবত তার শীত করছে। কয়েকবার গলা খাঁকানি দিল। চুপ করে থাকল।

আমি একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছি। মেয়েটা সামনের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ছে, মনে হলো সে লজ্জা পাচ্ছে। বাম হাত উঁচু করে গালে ঠেকাল, পেছনের দিকে ঝুঁকে বসল। মাথা ঘুড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো জানালা দিয়ে। এই আবছা অন্ধকারে মেয়েটাকে কালো মনে হচ্ছিল। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম, সে কালো নয়, আমার চেয়ে ঢের বেশী ফরসা। জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসে তার চুলগুলো উড়ছিল।

অনেকক্ষণ ধরেই দেখছিলাম তাকে। আবিষ্কার করলাম তার চোখ দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী চঞ্চল। সেগুলো উজ্জ্বল, রেলগাড়ির লাইটের এই স্বল্প আলোতে সে চোখ দুটি স্পষ্টত সুন্দর। বেশ নমনীয় চেহারা। মুখে এক ধরনের নম্র ভাব। তবে মুখটা লম্বাটে, আর সারা মুখময় এক রক্তহীনভাব। যেন এক ফোঁটাও রক্তের সন্ধান মিলবে না সেখানে।

রোগা শরীরের বেশ লম্বা গড়নের মেয়ে সে। গায়ের পোশাক বেশ মার্জিত। এভাবে আমার তাকিয়ে থাকা দেখে সে তেমন একটা অবাক হয়নি বলে মনে হলো। সত্যি বলতে এভাবে অনেককেই দেখেছি, সৌন্দর্যের শেষে কি আছে, তা দেখবার কৌতূহল আমার অনেক দিনের। তাই অনাধিকার চর্চার বালাই ভুলে গিয়ে আপনমনে দেখেছি এ পৃথিবীর অনেক সৌন্দর্যকে। কেবলই নারী নয়, শর্ষে ফুলের ওপর বসা মধু মাছিও আমার নিবদ্ধ দৃষ্টিকে সন্দেহের চোখে দেখেছে, অনেক মেয়েকে দেখেছি যাঁরা পেছনে এক গাল হেসে আরেকজন কে বলেছে, ‘ছেলেটা কীভাবে দেখছে দেখ।’ হয়তো তাতে তাদের খানিকটা গৌরবও ছিলো, তবে এই মেয়েটির মুখে তেমন কোন চিহ্ন পেলাম না।

এই যে এতক্ষণ যাবৎ তাকে নিরীক্ষণ করছি, এতে তার কোনো ভাবান্তর লক্ষ করিনি। সম্ভবত তার চোখে পড়বার মতো বড় কোনো ঘটনা না এটি। তবে সে যাই হোক, আর যতটাই হোক, আমি এ মহূর্তে এক মনে চাচ্ছি তার সঙ্গে কথা হোক। দু–একটি অভ্যর্থনা সূচক কথাতে আমার মন ভরবে না, পরিচয়টা নিতান্ত হোক। যদি সেটুকু অনেক বেশি চাওয়া হয়ে থাকে, তবে সে শুধু আমার সামনে বসে থাকুক, তার স্টেশন না আসুক। আজ এ সন্ধ্যা না কাটুক। বাইরের হিম বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলো করে রক্তহীন পাণ্ডুর মুখের ওপর আছড়ে দিক। আমি একদৃষ্টে কেবল চেয়ে থাকি। এ সৌন্দর্য না শেষ হোক।

অধরা স্বপ্নগুলো মনে মনে আবৃত্তি করছিলাম বার বার করে। কিঞ্চিৎ মাদকতাময় স্বাদও উপভোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম। সে চেষ্টাখানিও প্রশমিত হলো, ট্রেনের হুইসেলের শব্দে চৈতন্য ফিরল আমার।

ট্রেনের শব্দ হালকা হয়ে আসছে, জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে দেখলাম অদূরেই একটা স্টেশন। বুঝলাম থামবে। এক মহূর্তের জন্য যেন মনে হলো আমার কিছু হারিয়ে ফেলছি। একরাশ শূন্যতা আমায় ঘিরে ধরে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকল, মেয়েটা কি নেমে যাবে? আমার মনে হচ্ছিল সে নেমে যাবে। হারানোর ব্যথা ভেতর থেকে দমিয়ে রেখে তার দিকে  তাকালাম, সে হয়তো আমার চোখের ভাষা বুঝল। খেয়াল করলাম, সে গম্ভীর হয়ে গেল, মাথা নিচু করে একটু শব্দ করে বলল, ‘এখানে অনেকক্ষণ দাঁড়াবে। আপনি চাইলে কিছু কিনে এনে উঠতে পারেন। একঝিলিক খুশি মনের মধ্যে খেলে গেল। দ্রুত দাঁড়িয়ে বাইরের জন্য রওনা দিলাম, বলে গেলাম ‘এখানেই থাকবেন চুপটি মেরে। আমি আসছি, এশার নামাজটা পড়ে আসি।'

সে কিছু বললো না, চুপ করে রইল। আগের মতোই মুখে কিছুটা গাম্ভীর্যের ছাপ। তবে আমি নিশ্চিত হলাম যে সে নামবে না। আরও কিছুটা সময় সে কাছে থাকবে।
নামাজ শেষ করে উঠে চলে আসছিলাম, দেখলাম একজোড়া কালো কচি চোখ এই স্টেশনের স্বল্প আলোকে জ্বলছে। সেগুলো অন্ধকার ভেদ করে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি একটু ভয় পেয়ে উঠলাম। দ্রুত এসে ট্রেনে উঠে পড়লাম আর একই সময় হুইসেল দিয়ে ট্রেন চালু হয়ে গেল। সেই মেয়েটা কোন পাশে আছে, খুঁজতে হবে। একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম সে দুচোখ পাকিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। তার পাশে আমার জন্য জায়গা রেখেছে।

আমার সিটে অন্য একজন ঘুমুচ্ছে। চারপাশের প্রায় সবাই গভীর ঘুমে শুধু দু–একজন জেগে আছে। মেয়েটার পাশে এসে বসলাম। সে খুব অন্তরঙ্গতার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলো ‘নামাজ পড়েছেন?' আমি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি প্রশ্ন করে বসলাম, ‘আপনার নাম কী?’ সে বলল, ‘হেমাঙ্গিনী।’ বললাম ‘আপনার চোখ সুন্দর। আপনার নাম থাকা উচিত ছিলো সুনয়না।’

ভেবেছিলাম সে কিছু একটা বলবে, আমিও কথা বলা শুরু করব। সত্যি বলতে আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু সে নীরব মুখে জানালা দিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলো। সম্ভবত সে আমার উপর ভীষণ বিরক্ত হয়েছে। আমি একটু বিব্রত হলাম।

লেখক: মাহামুদুল হাসান, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।