বিপিএটিসির স্মৃতিময় দিনগুলো

আজ যখন লেখাটা লিখছি, তখন হাতে সময় অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। খুব দ্রুতই এই বিপিএটিসির জীবনে ছেদ পড়তে যাচ্ছে; ফিরতে হবে সবার নিজ কর্মস্থলে। এ শেষবেলায় এসে বিষাদ ভর করছে। বিষাদ ভর করাটাই স্বাভাবিক!

২০ এপ্রিলের এক ম্যাড়মেড়ে বিকেলে বিপিএটিসি ক্যাম্পাসে আমাদের এক নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল।

ঢুকতে ঢুকতে মনে হয়েছিল, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিপিএটিসিতে কত রথী-মহারথীর পদচারণ ঘটেছে।

সত্যি বলতে, এসব ভেবেই রোমাঞ্চিত ছিলাম। আজ এই রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের শেষ টানতে হচ্ছে।

শেষবেলায় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে এই বিপিএটিসি! আর কি ফেরা হবে?

মনে পড়ে প্রথম পদার্পণের দিনটা। প্রথম পদার্পণের সঙ্গে কিছু অজানা আশঙ্কা সঙ্গী হয়ে এসেছিল। এই অজানা আশঙ্কা মূলত এখানকার কঠোর নিয়মকে ঘিরে। এই আশঙ্কা উবে যেতে খুব একটা সময় লাগেনি। ২১ এপ্রিল থেকে বিপিএটিসির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। উদ্বোধনী মঞ্চে সেদিন আমি আর সুবর্ণা সিনহা একগাদা এক্সপেক্টেশন নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। শেষবেলায় আজ যখন ফিরে যাচ্ছি, সব এক্সপেক্টেশন যেন পূর্ণতার পথে। কী পাইনি এখানে!

সকাল শুরু হতো জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে। জগিং শেষ করে পিটি সেশন। এরপর সকালের নাশতা সেরে ছুট লাগাতাম ক্লাসের পথে। লাঞ্চ সেরে আধো ঘুমচোখে আবার ক্লাসে এসে বসতাম। এক মিনিটের এদিক-সেদিক হতো না; উপায়ও ছিল না। এখানে সবকিছু সময়ের ফ্রেমে বন্দী। বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ ক্লাসের সঙ্গে ঘুমের লড়াই চলত যুগপৎভাবে। একটা গোপন কথা ফাঁস না করে পারছি না। ক্লাসের মধ্যে ঘুমানোর জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে পুতুল চন্দ্র রায়। পুতুল চন্দ্র রায়কে দেখে মনে হবে উনি ক্লাসের মনোযোগী ছাত্রের মতো লেকচার শুনছেন। আদতে উনি চোখ বুজে ঘুমের রাজ্যে আছেন!

ক্লাস, ডাইনিং, মাঠ—যেখানেই সুযোগ হতো, সবাই মিলে তুমুল আড্ডা গেড়ে বসতাম। আর এসব আড্ডায় অবধারিতভাবে আমাদের প্রিয় সহকর্মী নির্মল কুমার রায় যেন মধ্যমণি। নির্মল কুমার রায় সব সময়ই সহকর্মীদের হাসির খোরাক নিয়ে হাজির হতেন।

আমরা সবাই মুখিয়ে থাকতাম বিকেলের স্পোর্টস সেশনের জন্য। বিকেলে স্ট্রেচিং করে সোজা ভলিবল কোর্টে। কোর্টে ঢোকার পরপরই ভলিবলের সঙ্গে শুরু হতো কথার ঠোকাঠুকি; খানিকটা স্লেজিং বলা যায়। বিকেলটা বেশ কাটত। এই বিকেলের আশা নিয়ে আমাদের একের পর এক দিন কেটে যেতে থাকে।

সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে ডরমিটরির পথ ধরতাম। মাঝেমধ্যেই সন্ধ্যার পর ক্লাস থাকত। সন্ধ্যার পরের ক্লাসগুলোয় রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করত। ক্লাস শেষে রাতের খাবারের পর আমাদের কর্মক্লান্ত দিনের শেষ নামত। শেষ নামলেও ঠিক যেন স্বস্তি মিলত না। অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা হোমওয়ার্ক শেষ করতে করতে ঘড়ি কাঁটা ১২টা ছুঁইছুঁই।

বিপিএটিসির নিত্যদিনকার ডায়েরি শুধু ক্যাম্পাসের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধ কিংবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনকের সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন—এসব মহৎ কর্মও সমোপস্থিত ছিল। টুঙ্গিপাড়া থেকে ফেরার পথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মধুমতী ব্রিজ দেখার সুযোগও হাতছাড়া হয় না।

দেখতে দেখতে ট্যুরের দিন ঘনিয়ে আসে। ছুটে চলি কক্সবাজার। বিপিএটিসির নিত্যদিনের ছকে বাঁধা জীবন থেকে ফুরসত মেলে। কর্মক্লান্ত দিনগুলোর সব ক্লান্তি যেন ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যায়। অসম্ভব সুন্দর দিন কাটে কক্সবাজারে। কক্সবাজারের সেই সুন্দর দিনগুলো দ্রুত কেটে যায়। কক্সবাজারের মায়া কাটিয়ে আবার ফিরতে হয় বিপিএটিসিতে।

বিপিএটিসির শেষ দিনগুলো তরতর করে এগিয়ে যায়। মেস নাইট, ম্যারাথন, খেলাধুলা একে একে সব শেষ হয়ে যায়। শেষ হয় ক্লাস কিংবা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে প্যারাময় দিনগুলো। কালচারাল নাইটের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। কি দুর্দান্ত একটা সন্ধ্যা! জীবন যেন এসব কিছু দুর্দান্ত সন্ধ্যার উপলক্ষের খুঁজে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে থাকে। মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক যেন প্রাণের স্পন্দনে জেগে ওঠে।

বিআইডব্লিউটিএর নবযোগদানকৃত কর্মকর্তারা যে এত প্রাণোচ্ছল, তা আমার নিজেরই জানা ছিল না।

গান, নাটিকা, সমবেত সংগীতে এই অপূর্ব সংগীত সন্ধ্যার শেষ নামে। শেষ নামে এক মাসের দুর্দান্ত এক সুখস্মৃতির।

এত কিছুর ভিড়ে আমাদের সবার প্রিয় দুজন মানুষের কথা বাদ রয়ে গেছে। শ্রদ্ধেয় নজরুল ইসলাম স্যার এবং নাজিম উদ্দিন স্যার; উভয়েই কোর্স সমন্বয়ক হিসেবে আমাদের জার্নিতে শুরু থেকে শেষ অবধি ছিলেন। আমরা আমাদের যেকোনো সমস্যা নিয়ে দ্বারস্থ হতাম এই দুজন স্যারের। আজ ফিরে যাওয়ার পথে দুজনকে মনে পড়ছে।

বিপিএটিসি থেকে ফিরে যাচ্ছি, সেই সঙ্গে শোকজ নিচ্ছি না, তা তো হয় না। আমাদের মধ্যে অনেকেই দুটা শোকজ নিয়ে দুশ্চিন্তা নিয়ে দিন পার করছিল। যাক আজ ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দুশ্চিন্তার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। আজ ফিরে যাওয়ার পথে এসব অম্লমধুর স্মৃতিও সঙ্গী হচ্ছে।

সব ছাপিয়ে গত এক মাসে এখানে দুর্দান্ত কিছু স্মৃতি জমা হয়েছে। আজ (২৬ মে) এসব সঙ্গী করেই ফিরে যাচ্ছি। জানি না আবার কখনো ফেরা হবে কি না। আশায় থাকলাম, আবার কখনো ফিরব এই বিপিএটিসিতে।

লেখক: আনিসুর রহমান, সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা), বিআইডব্লিউটিএ, ঢাকা।

*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]