ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের আউটলুক নির্ভর করে দর্শনের ওপর

প্রতীকী ছবি

আজ বেশ রোদ উঠেছে ঢাকার শহরে। বাইরে ঝলমলে রোদ। ঋতুরাজ যেন পরিবর্তনের গান গাইছে। পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের পোশাকে এসেছে পরিবর্তন। গরম কাপড় ছেড়ে গ্রীষ্মকালীন পোশাকে ফিরে গেছে মানুষ। পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষ তার বাহ্যিক বেশভূষায় পরিবর্তন আনতে পারে খুব সহজে। কিন্তু মানুষ সহজে যে জিনিস পরিবর্তন করতে পারে না, তা হলো ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ব চাইলেই একদিনে পরিবর্তন করা যায় না। এ জন্য চাই লম্বা সময়ের প্রস্তুতি। তবে তার আগে যে জিনিসটি খুব দরকার, তা হলো ব্যক্তিত্বের কোন জায়গায় দুর্বলতা আছে, তা চিহ্নিতকরণ।

বেশির ভাগ মানুষ এটি করতে পারে না বা সচেতন মনে করতে চাই না। যার কারণে আমরা বেশির ভাগই ব্যক্তিত্বের একটি আদর্শ জায়গা ধারণ করার আগেই ইহলোক ত্যাগ করি।

মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে তার দর্শনে। একজন মানুষের দর্শনই বলে দেয়, তার ব্যক্তিত্ব কতটা শক্তিশালী। প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পাওয়া যায় তার দর্শন থেকে।

দর্শনের বৈচিত্র্য পাওয়া যায় একই জিনিস আমরা কত ভাবে দেখতে পারি, তার ওপর। একটি জিনিস আমার কাছে একটি সাধারণ বস্তু হলেও অন্যজনের কারণে তা হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।

তাই তো আমরা সবাই আপেল মাটিতে পড়তে দেখাটা সাধারণ নিয়ম ভাবলেও নিউটনের চোখ আবিষ্কার করেছে ‘মহাকর্ষীয় সূত্র’।

সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ মানুষের পার্থক্য এ দর্শনে। তাই তো সবাই পণ্ডিত হয় না। কোনো কিছু পণ্ড করতে গেলে, তা বিভিন্ন কোণ থেকে দেখার ক্ষমতা থাকতে হয়। সাধারণ মানুষ তাই সহজেই রাজার কথা মানে। অসাধারণ মানুষ তা করে না বলেই সক্রেটিসকে রাজার আদেশে হেমলক বিষ দিয়ে মারা হয়েছিল। তবু সক্রেটিস আত্মসমর্পণ করেননি। এটাই শক্তিশালী দর্শন উদ্ভূত ব্যক্তিত্ব। এ ধরনের ব্যক্তিত্ব সহজেই নিজেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সঁপে দেয় না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এ দর্শনহীনতায় ভুগছে। বেশির ভাগ শিক্ষকদের নেই দর্শন। অনেকের কাছেই শিক্ষকতা হলো রুটিন ওয়ার্ক। এর ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি করছে দর্শনবিহীন কিছু প্রশিক্ষিত মানুষ, যারা কাপড় সেলাই করতে জানলেও নতুন নতুন ডিজাইন উদ্ভাবনের ক্ষমতা রাখে না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমাজ পরিবর্তনে রাখতে পারছে না অবদান। আবার পরিবর্ততিত অবস্থায়ও এসব বিশ্ববিদ্যালয় মুখ থুবড়ে পড়ছে। করোনাভাইরাসের মতো মহামারি মোকাবিলায় আমাদের তাই অপেক্ষা করতে হয়েছে অন্যদের দয়ার ওপর।

বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন আসলে রাষ্ট্রীয় দর্শন দিয়ে প্রভাবিত হয়। যে দেশের রাষ্ট্র দর্শন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকা সে দেশের সরকার আসলে ছাত্র-শিক্ষকদের কাছ থেকে ক্ষমতায় টিকে থাকার মন্ত্র ছাড়া আর কিছু চায় না। চায় না বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্র উপকৃত হোক। তাই তো এখানে এসব দেশের সমাজে আমলারা যতটা সমাদৃত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ততটা নিগৃহীত।

ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র—সব জায়গায় আসলে সঠিক দর্শন চাই। দর্শনের ওপর শুধু ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রেরও আউটলুক প্রকাশ পায়। এ আউটলুক যেমন একদিনে বিনষ্ট হয় না, তেমনি এটি একদিনেও তৈরি করা সম্ভব নয়। একজন ব্যক্তির দর্শন ঠিক করতে হলে চাই অনেক বেশি পড়াশোনা। বিজ্ঞান/সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, সংস্কৃতি—সবই জানতে হয় নিজের দর্শন যাচাই করে নিতে। দেশি ও বিদেশি লেখকের বই পড়ার মাধ্যমে ইমাজ্নেশন পাওয়ার বাড়ানোর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী দর্শন তৈরি করা সম্ভব। আর শক্তিশালী দর্শনই তৈরি করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র।

লেখক: মো. ফজলুল করিম, অধ্যাপক, বিজিই (বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ), মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল

*নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]