বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নে কাজ করছে ঢাবির একদল তরুণ

ব্র্যাকের হোপ ফেস্টিভ্যাল ‘যত্নের দোকান’।
ছবি: সংগৃহীত

ঘটনাটি ২০১৮ সালের নভেম্বরের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মাসুম বিল্লাহর মাথায় ধারণাটি আসে।

পরে শাহরিয়ার কবির, আশরাফুল ইসলাম, নাবিদ নেওয়াজ, নাইম হৃদয়, তাবাচ্ছুম ফারিহা, নওশীন অনন্যাসহ তাঁর অন্য সহপাঠীদের চিন্তা যোগ হয়। সবাই মিলে প্রণয়ন করেন কর্মকৌশল। গঠন করা হয় ‘কানেকটিং ডিজঅর্ডারস’ নামের সামাজিক সংগঠন।

সংগঠনটি প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেয় যোগাযোগ বৈকল্য বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা হবে। এ জন্য তারা তৈরি করে একটি ব্লগ। ধীরে ধীরে সংগঠনের সদস্যসংখ্যা, কর্মপরিধি ও স্বপ্নের বিস্তার ঘটে।

‘যত্নের দোকান’ উদ্যোগের জন্য কানেকটিং ডিজঅর্ডারসকে ‘আমরা নতুন ইয়াং চেঞ্জমেকারস অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েছে ব্র্যাক।
ছবি: সংগৃহীত

২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে একটি ভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচির আয়োজন করে ‘কানেকটিং ডিজঅর্ডারস’। তারা প্রথমবারের মতো অফলাইনে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ঢাবির টিএসসি চত্বরে আয়োজন করে ‘ভালোবাসার ফ্রেমে কানেকটিং ডিজঅর্ডারস’ নামের অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানে পাঁচ শতাধিক মানুষ অংশ নেন। তাঁদের সঙ্গে অটিজম, ডাউন সিনড্রোমসহ অন্যান্য স্নায়ু বিকাশজনিত প্রতিবন্ধকতায় থাকা মানুষদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

পরবর্তী সময়ে ‘কানেকটিং ডিজঅর্ডারস’ একটি ফেসবুক ভিডিও ক্যাম্পেইন আয়োজন করে। ক্যাম্পেইনটির নাম ‘শতমুখ বলে ওদের কথা’।

‘আমার হাতেখড়ির গল্প’ শিরোনামে ডিসলেক্সিয়া-বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ‘কানেকটিং ডিজঅর্ডারস’। এসব কার্যক্রম কানেকটিং ডিজঅর্ডারসকে পরিচিতি এনে দেয়।
একদল তরুণের এই সামাজিক উদ্যোগ করোনার থাবাও থামাতে পারেনি। করোনা মহামারিতে আয়োজন করা হয় বেশ কয়েকটি ওয়েবিনারের।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নে নানা কাজ করছে কানেকটিং ডিজঅর্ডারস।
ছবি: সংগৃহীত

সময়ের ধারাবাহিকতায় এই তরুণ দল ২০ টির বেশি ইভেন্ট আয়োজন করেছে। এ ছাড়া ১০ টির বেশি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। কানেকটিং ডিজঅর্ডারসের চলমান ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্টের নাম ‘যত্নের দোকান’।

কানেকটিং ডিজঅর্ডারস বিশ্বাস করে, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা মানুষকে বৈষম্য থেকে উত্তরণের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই লক্ষ্যে কানেকটিং ডিজঅর্ডারস ‘যত্নের দোকান’ প্রজেক্ট হাতে নেয়। এই দোকানের মাধ্যমে সারা দেশ থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হাতে তৈরি পণ্য সংগ্রহ করা হয়। পরে তা অনলাইনে প্রদর্শন ও বিপণন করা হয়। বিক্রি হওয়া পণ্যের অর্থ পৌঁছে দেওয়া হয় উৎপাদনকারীর হাতে। এই অর্থ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করছে।

স্পিচ ডিলে বা স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ডিজঅর্ডারস যাঁদের আছে, তাঁরা যাতে বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে গুণগত মানের স্পিচ সেবা নিতে পারেন, সে জন্য কানেকটিং ডিজঅর্ডারস আধুনিক স্পিচ থেরাপি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বাংলা ভাষায় যোগাযোগ বৈকল্যবিষয়ক রিসোর্স বৃদ্ধি কানেকটিং ডিজঅর্ডারসের অন্যতম লক্ষ্য। ইতিমধ্যে ডাউন সিনড্রোম-বিষয়ক ইনফো গ্রাফিক ‘একুশে এক্সট্রা’ ই-বুক হিসেবে বিনা মূল্যে পাঠের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। এটি কানেকটিং ডিজঅর্ডারসের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে।

জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী অধিকার সনদের ইলাসট্রেটেড কমিক ‘বিশেষ-ষত্ব’ প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
চলতি মাসের ৯ থেকে ১১ তারিখ বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ব্র্যাকের ‘হোপ ফেস্টিভ্যাল’। এই আয়োজনের ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন কর্নারে ছিল ‘যত্নের দোকান’। এই দোকানে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়।

‘যত্নের দোকান’-এর অন্যতম দায়িত্বশীল অফিশিয়াল নওশিন সায়রা জানান, ফেস্টিভ্যালে তোলা ৯০ শতাংশ পণ্যই বিক্রি হয়ে যায়। এই অর্থ এসব পণ্যের কারিগর তথা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

‘যত্নের দোকান’ উদ্যোগের জন্য কানেকটিং ডিজঅর্ডারসকে ‘আমরা নতুন ইয়াং চেঞ্জমেকারস অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েছে ব্র্যাক। অ্যাওয়ার্ডটি অর্জন সম্পর্কে সংগঠনের সহপ্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘স্বীকৃতি সব সময়ই আনন্দের। একই সঙ্গে স্বীকৃতি প্রত্যাশা ও দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দেয়। ব্র্যাকের এই স্বীকৃতি আমাদের কাজকে আরও বেগবান করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’

উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। এই উন্নয়ন যাত্রার কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যাতে এই অগ্রযাত্রার সমান অংশীদার হতে পারেন, তাঁরা যাতে পিছিয়ে না পড়েন, তাঁরা যাতে ক্ষমতায়িত হন, সে জন্য কাজ করে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ কানেকটিং ডিজঅর্ডারস।