যানজট নিরসন ও নিরাপদ যোগাযোগের মাধ্যম রেল কি হতে পারে

ট্রেন
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

সকাল ৮টা ৪২ মিনিটে ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস পৌঁছানোর কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের ৪০ মিনিটেরও বেশি সময় পর ট্রেন আসে। এমন ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। বাংলাদেশে ট্রেনের যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে। তখনো মানুষ নৌপথ, পায়ে হেঁটে কিংবা ঘোড়া ও গরুর গাড়ি ব্যবহার করত যাতায়াতের বাহন হিসেবে। বর্তমানে সড়কপথের যোগাযোগব্যবস্থার তুলনামূলক উন্নত হলেও ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। প্রতিটি জেলা শহরে রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা, নির্মাণের সময় ও ব্যয়ের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি, জমি দখল, টিকিট কালোবাজারিসহ নানা সমস্যা রেলের অগ্রযাত্রার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহনমালিক ও শ্রমিক নেতারা সব সরকারেরই কাছের মানুষ হওয়ায় রেলের উন্নয়নে এত ধীরগতি। কারণ, দেশব্যাপী রেলের যোগাযোগ উন্নত হলে পরিবহন ব্যবসা কমে যাবে।

রেলের যোগাযোগ তুলনামূলক নিরাপদ ও আরামদায়ক হলেও স্বাধীনতার ৫১ বছরে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি রেল নেটওয়ার্কের। যেমন ঢাকা থেকে খুলনা অন্যতম দীর্ঘ রেলপথ হলেও নেই দ্রুতগতির ভালো ট্রেন। কিছু অংশ বাদে সবটুকুই সিঙ্গেল লাইন। কিন্তু এ রুটেরই দর্শনা থেকে বাংলাদেশে প্রথম রেলপথ চালু হয়। রেলের সেবার মান খারাপ হওয়ার মূলে রয়েছে পুরোনো ইঞ্জিন, বগি ও সিঙ্গেল লাইন। সঙ্গে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ তো আছেই। তবে, পরিকল্পিত পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকা শহরের যানজট কমাতে এবং ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের সঙ্গে স্বল্প সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে রেল ব্যবহার করা যায়।

প্রথমত, প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহরে রেলপথ নির্মাণ করতে হবে। যেখানে জেলা ও উপজেলা শহরে হবে ডাবল লাইনের এবং ঢাকা শহরে প্রবেশপথে ছয় থেকে আট লেনের রেলপথ। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, বি.বাড়ীয়া, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর জেলার সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করে ১০ থেকে ২০ মিনিট পরপর এসব জেলার মধ্যে রেল চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকার মধ্যে কমলাপুর, তেজগাঁও, ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবন্দর রেলস্টেশন আধুনিকায়ন ও পরিবেশবান্ধব করে তৈরি করতে হবে, প্রয়োজনে স্টেশনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অফিস–আদালতে কাজ করে এক থেকে দুই ঘণ্টায় বাড়ি পৌঁছাতে পারবে মানুষ। কাজের জন্য এসব জেলার মানুষকে ঢাকাতে থাকতে হবে না।

দ্বিতীয়ত, ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার রেললাইন নির্মাণ এবং প্রতিটি বাস ও রেলস্টেশনের সঙ্গে মেট্রোস্টেশন তৈরি করতে হবে, তাহলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত সময়ে যাতায়াত করা যাবে। ঢাকা থেকে দূরের শহরগুলোতে দ্রুতগতির ট্রেন চালু করতে হবে। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ হলে আড়াই ঘণ্টায় যশোর পৌঁছানো যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ রেলপথ ব্যবহার করে বেনাপোল ও দর্শনা স্থলবন্দরকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আমদানি–রপ্তানির কাজে লাগানো যায়। এ ছাড়া উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বৃহত্তর যশোর ও খুলনা অঞ্চলে শিল্প ও কলকারখানা নির্মাণ করলে মানুষ রেলের মাধ্যমে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে আসবে আবার কাজ শেষে বাড়ি ফিরে যাবে। বিদেশে পণ্য আমদানি–রপ্তানিতে যশোর বিমানবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এভাবেই দেশের প্রতিটি বিভাগ ও বৃহত্তর জেলা শহর নিয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। ফলে ঢাকার শহরে জনসংখ্যা কমবে।

এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আধুনিক সুবিধাসংবলিত হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিনোদনকেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরি, সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। এককথায় যাকে বলে ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ। পরিবহনব্যবস্থা পুরোপুরি সরকারি ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। ট্রাফিক আইন বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে। ব্যক্তিগত ও সরকারি গাড়ির সংখ্যা কমাতে হবে, চালু করতে হবে আধুনিক বাস সার্ভিস। কারণ, সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে ঢাকা শহরে বসবাস ও যাতায়াত করা আরও কঠিন হয়ে যাবে।

সরকার পদ্মা সেতুতে রেল–সংযোগ স্থাপন, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ, যমুনা নদীতে রেল সেতু নির্মাণ, জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী এবং দর্শনা থেকে খুলনা পর্যন্ত ডাবল লাইন, সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণসহ রেলের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে ও বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে দ্রুতগতির (হাইস্পিড) রেলপথ নির্মাণের চিন্তা রয়েছে। একইভাবে খুলনা, যশোর, রাজশাহী, সিলেটে হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণে নজর দিতে হবে। রেলের সুষম উন্নয়ন নিয়ে অভিযোগ আছে। এখন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রেলের উন্নয়ন ও যাত্রীসেবার মান নিশ্চিতে কাজ করতে হবে।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়