হুমায়ূন–স্মৃতিতে একবেলা

বৃষ্টিঝরা দিনে সবাইকে ছেড়ে আকাশে মেঘের কাছে চলে গেছেন কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মাটির বিছানায় তাঁকে যেখানে শায়িত করা হয়েছে, সেটি রাজধানী থেকে বেশ দূরে গাজীপুরের প্রত্যন্ত এক অঞ্চল পিরুজালীর তাঁর প্রিয় নুহাশপল্লীতে।

করোনার বিধিনিষেধের আগে থেকেই ভীষণ ইচ্ছা ছিল ঘুরে আসব প্রিয় লেখকের স্মৃতির পাতায় পাতায়। যেখানে পাখি, গাছ, ইট–পাথর ও টিনের প্রতিটি কাঠামোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর ঘ্রাণ। সেই ভাবনা থেকেই ঘুরে আসা হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিবিজড়িত নুহাশপল্লী।

ভাবনা মতোই সকালে সাভার থেকে বাসযোগে বেরিয়ে পড়া। যানজট, ধুলো আর উঁচু–নিচু সড়কে দুই ঘণ্টায় দুটি ভিন্ন গাড়িতে জার্নির পর পৌঁছে গেলাম হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকেই পিরুজালীর সিএনজিচালক জসীম উদ্দিনের যানে হুমায়ূন আহমেদের বাড়ির সামনে।

কটকটে দুপুরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নেমেই দেখা হলো কাঠবিড়ালি মশাইয়ের সঙ্গে। মনে হলো, আমাকে দেখে লুকোচুরি খেলছিলেন তিনি। কয়েক কদম পেরিয়েই নুহাশপল্লীর মূল ফটক। সেখানে ২০০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম হুমায়ূন স্মৃতিতে।

একটু এগোতেই যেন স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে বসে আছে হুমায়ূন আহমেদের ম্যুরাল। এর ঠিক উল্টো দিকেই ছোট্ট শিশুর হাত ধরে দাঁড়ানো এক মা। হুমায়ূনের সারা দিন ওই মা-ছেলেকে দেখতে কেমন লাগে! ভাবতে ভাবতেই শুরু হলো হুমায়ূনের নুহাশপল্লী যাত্রা। ইট বিছানো সড়কে জমা পড়েছে শেওলার স্তর। সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে বকুলতলায় বসার চেয়ার-টেবিল। শুভ্র রঙের জায়গাটিতে বসতেই সামনে দেখা হলো দুজনের সঙ্গে। না জীবন্ত নয়, পাথরের মূর্তিরূপে সামনেই ফলের ঝুড়ি হাতে দাঁড়ানো কিশোরী। যেন আলো ফোটার আগেই নিজ হাতে সকালের জলখাবার নিয়ে আসছে সে। এর পাশেই উপুড় হয়ে পড়ার ভঙ্গিমায় শোয়া শিশু। হাতে বই গুজে দিলেই অ আ ক খ বলতে শুরু করবে সে। কিছুক্ষণ বসার পর শুরু হাঁটা। কয়েক কদম এগোতেই দুপাশে পামওয়েলের বড় বড় গাছ।
কাছেই ছোট্ট করে স্বপ্নে দেখা গাছ মোড়ানো পথ। পথের শেষেই মাছের ছোট্ট পুকুর। পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আরেক শুভ্র পরী। মাছ পাহারা দিচ্ছে সে!

ঠিক উল্টো পাশে বামদিকে কাঠের বড় বড় দাবার ঘুঁটি। কিন্তু খেলার সময় কই!

হাতে সময় খুব কম। দ্রুত শেষ করতে হবে পুরো যাত্রা, তাই এগোনো।

দেখা মিলল ‘বৃষ্টিবিলাস’র। হাঁটু মুড়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। এ ঘরেই তৈরি হয়েছে হুমায়ূনের বহু সাহিত্য! দেখেছেন জীবনের বহু রোদ-বৃষ্টি! ঘরের সামনে বসা একজন কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, আরেকটু এগোলেই ঔষধিগাছের বাগান, জলপরী আর প্রিয় লীলাবতী দিঘি।

ইট বিছানো রাস্তায় ফের যাত্রা। কয়েক কদম এগোলেই বড় ক্যাকটাস। পাশেই বসে থাকা শিশুর মূর্তি। অযত্নে যার হাত খোয়া গেছে! তার পেছনেই বড় পাহাড়! কাছে যেতেই দেখা মিলল বিশাল আকৃতির দৈত্যের। পাহাড়সম দৈত্যের সামনে জলাধারে বসে আছেন জলকন্যা। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুজন! একটু এগোতেই দেখা মিলল শিশুপ্রেমী হুমায়ূনের। দৈত্য আকৃতির একেকটি ডাইনোসর, সাপ স্বাগত জানাচ্ছে আগত ব্যক্তিদের! এই ডাইনোসরের পাশেই হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় ঔষধিগাছের বাগান। বাগানের সামনে লেখকের আবক্ষমূর্তি।

এরপর যাত্রা মৃত নবজাতক কন্যা লীলাবতী নামের সেই পুকুরের উদ্দেশে। যে দীঘির পাড়ে জড়িয়ে রয়েছে হুমায়ূনের যত্ন। দীঘির পাড়েই ‘ভূত বিলাস’ নামে বাংলো। সেখানে দাঁড়াতেই চোখে পড়বে দিঘির মাঝখানে করা ছোট্ট দ্বীপ। লেখক বেঁচে থাকতে এখানেই গানবাজনার আয়োজন করা হতো। দ্বীপে যাওয়ার কাঠের পুলের কাঠামোটি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। সেই পুল পেরিয়েই দ্বীপ যাত্রা। এ দ্বীপে বসেই বহু সাহিত্য রচনা করেছেন লেখক হুমায়ূন আহমেদ।

দুপুর গড়িয়েছে, আশপাশে নেমে এসেছে শান্ত বিকেল। চারপাশ হিমুর হলুদাভ রং ধারণ করেছে। এমন বিকেলে হুমায়ূন আহমেদ যদি হারিয়ে যেতেন, তিনি কী ভাবতেন? আমার মনে পড়ছে তাঁর লেখা সেই গানটি। গানের মতো মাথায় সাদা ক্যাপ ছিল না। তবে হাতে ছিল নুহাশপল্লীর ম্যাপ!
মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ
হাতে আছে অচেনা এক শহরের ম্যাপ।
ব্যাগ ঝুলিয়েছি কাঁধে
নামবো রাজপথে,
চারিদিকে ঝলমলে রোদ
কেটে যাবে আঁধারের ছায়া-অবরোধ।
চারিদিকে কী আনন্দ,
অতি তুচ্ছ পতঙ্গেরও অপূর্ব জীবন।

ফিরতে হবে। বেরিয়ে গেলাম নুহাশপল্লী থেকে। কথা হলো সকালের সেই সিএনজিচালক জসীম উদ্দিনের সঙ্গে। কৃষিকাজের পাশাপাশি সিএনজি চালান। মাঝবয়সী এ চালক জানান হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিকথা। পিরুজালী এলে পুরো এলাকা চষে বেড়াতেন লেখক। যেন পিরুজালীতে পোঁতা রয়েছে তাঁর নাড়ি! নামকরা ব্যক্তিটি সবার সঙ্গে মিশতেন একজন কৃষকের মতোই। জসীম বলেন, ‘বাঁইচা থাকতে তারে বুঝতে পারি নাই আমরা। এত বড় মানুষ উনি! বুঝবো কেমনে! হোতাপাড়া বাজার থেকে এই প্রায় ৬-৭ কিলোমিটার পথ হেঁটে চলে আসতেন নিজের বাড়িতে। তারপর এখানকার দোকানে চা খেতেন। সকাল–বিকেল এলাকায় হাঁটতেন। সবার সঙ্গে মিলেমিশে কথা বলতেন। মারা যাওয়ার পর টের পেলাম, উনি এত বড় মানুষ। এত নামকরা মানুষ।’

তবে আক্ষেপও জানালেন কিছুটা। বলেন, ‘আগে এই বাড়ি ছিল খুবই যত্নে। স্যার বছরে কয়েকবার এসে থাকতেন। এলাকাবাসীর সুখ–দুঃখ শুনতেন। তাঁর আগ্রহেই কাদামাটির এই ৬-৭ কিলোমিটার সড়ক ভালো করা হলো। তিনি মারা যাওয়ার পর আর কেউ এখানে আসে না। তাঁর পরিবার ওই বছরে এক–দুবার আসে। এলেও স্যারের মতো করে মিশে না। স্যারের চলে যাওয়ায় পুরো এলাকার মানুষ কাঁদছে। এখনো স্যারের কথা মনে পড়লে মন খারাপ হয়ে যায়। তাঁরে যাঁরা সামনাসামনি দেখছেন সবার একই রকম হবে। তিনি তো তেমনই মানবিক মানুষ ছিলেন।

জসীম উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যেন মানবিক হুমায়ূন দর্শন করা হয়ে গেল। এক দিনের হুমায়ুন স্মৃতি মানসপটে ভেসে থাকবে বহুদিন!

  • লেখক: সানজিদা জান্নাত পিংকি, সাভার, ঢাকা। শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়