স্মৃতিময় মিসর

মিশরের পিরামিডফাইল ছবি

‘আমার মন চলে যায় মনের কাছে
বলতে মনের কথা, দেহ পড়ে থাকেরে
মনের যত কথা থাকে
রাখি তারে গোপন করে
বুকের মাঝে নিত্য তুমি
খেলো কত খেলারে।’

আসলে প্রত্যেক মানুষের মাঝেই লুকিয়ে আছে একটা কবি মন, একটা প্রেমিক হৃদয়। আর থাকে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন, যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, তাকে আনন্দ দেয়, তাকে পুলকিত করে, আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তেমনই একটি মন সেদিন পুলকিত হয়েছিল, বিমোহিত হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার ভূমধ্যসাগরের নীলাভ–নয়নাভিরাম জলের সৌন্দর্যে। বড় চমৎকার মনোরম ছিল সেই আনন্দময় মুহূর্তগুলো। যা ইচ্ছা করলেও স্মৃতির পাতা থেকে মুছে ফেলা যাবে না। আসলে প্রকৃতি বড় বৈচিত্র্যময়, বড়ই রহস্যময় ও কাব্যময়। তার চেয়েও বড় রহস্য ও কাব্যময় আমাদের মন। বড় বিচিত্র এ ভাবনা, বড় বিচিত্র এ অনুভূতি। তাই প্রকৃতির প্রেমে মানুষ আকুল হয়ে ছুটে চলে দেশ হতে দেশান্তরে। ভ্রমণপিপাসু মানুষের চোখেমুখে ভেসে ওঠে অজানাকে দেখার ও জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। প্রকৃতি ও সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে সে খুঁজে পায় অনাবিল আনন্দ ও সুখ। কেননা পৃথিবীর পরতে পরতে রয়েছে সুন্দরের একেকটা বাগান।
বলছিলাম ২০১১ সালের কথা। আমার স্বামী কুয়েত মিশনে থাকার সময় মিসরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। নীলনদ, পিরামিড আর মমি দেখার ইচ্ছাটা অনেক আগে থেকেই মনের মধ্যে ছিল। তবে ইচ্ছাটা যে একদিন সত্যি হবে, সেটাও ছিল একটা স্বপ্ন।
মিসরে যাওয়ার সুযোগ যখন পেয়েছি, তখন আর সময় নষ্ট করিনি। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের সঙ্গে আরও একটি পরিবার যেতে রাজি হয়ে গেল। আর এরপর থেকেই শুরু হয়ে গেল মিসর যাওয়ার প্রস্তুতি। সেই সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল পিরামিড, কায়রো মিউজিয়াম, মমি, নীলনদ, আলেকজান্দ্রিয়ার পৃথিবী বিখ্যাত লাইব্রেরি, বাতিঘর, রাতের কায়রো শহর ইত্যাদি, যা এত দিন বইপুস্তকে পড়েছিলাম। আর এখন তা বাস্তবে দেখতে যাব, ভেবেই পুলকিত হচ্ছিলাম!

অপেক্ষার পালা শেষে একদিন এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মহাখুশিতে আমরা যাত্রা শুরু করলাম কুয়েত থেকে মিসরের উদ্দেশে। কুয়েত থেকে আকাশপথে আমরা প্রথমে গেলাম আলেকজান্দ্রিয়া বিমানবন্দরে। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম পর্যটন শহরটিতে। যেন এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের মাঝে উপস্থিত হলাম। দেহ-মন উদাস হয়ে গেল।

আমরা একটি সুন্দর পরিপাটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। দুই পরিবারের জন্য যা ছিল খুবই চমৎকার। ফ্ল্যাটটি ছিল ভূমধ্যসাগরের খুবই কাছে। রুমে ঢুকেই মনটা ভরে গেল। অনেক সুন্দর করে সবকিছু গুছিয়ে রেখেছিল। যেহেতু ফ্ল্যাটে উঠেছি, সেহেতু মনে হচ্ছিল যেন বাসাতেই আছি। ভূমধ্যসাগরের পাশেই ছিল আমাদের ফ্ল্যাটটি। ভূমধ্যসাগরের নীলাভ–নয়নাভিরাম জলের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল, বিমোহিত করেছিল। আমি যেন এক অন্য আমি হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মাঝে যেন সেই মুহূর্তে অন্য এক আমিকে খুঁজে পেলাম। যে আমিটা এত দিন এক অন্ধকার গলিতে নিভৃতে গুমরে কেঁদেছিল। আজ যেন তা পূর্ণতা পেল। আমার চেতনা যেন একটি সাদা সত্যিকার পালকের মতো উড়তে শুরু করল। আমার মন যেন ডুবে যাচ্ছিল, হারিয়ে যাচ্ছিলাম অন্য এক আমিতে। আমার আমিতে যেন আমি আর নেই। আবিষ্কার করলাম নিজেকে এক নতুন আমিতে। টাইটানিকের নায়িকার মতো দুহাত বাড়িয়ে ইচ্ছা করছিল পৃথিবীকে আলিঙ্গন করতে, তাকে সাধুবাদ জানাতে। বারান্দায় বসে চা-বিস্কুট খেতে খেতে ভাবছিলাম আকাশ-পাতাল কত কিছু! মিষ্টি বাতাসের পরশ এসে লাগছিল দেহ-মন-প্রাণে। মনে হচ্ছিল বাসনার নদীতে অবগাহন করছিলাম।

ফাইল ছবি: এএফপি

ভূমধ্যসাগরের আকাশছোঁয়া ওই জলে মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম। রুম থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম সৃষ্টির অপার রহস্যের সৌন্দর্য। পৃথিবীর এত সুন্দর, সৃষ্টি এত রহস্যময়, প্রকৃতি এত উদার, ভেবে ভেবে অবাক হচ্ছিলাম। হঠাৎ ‘আম্মু আম্মু’ ডাক শুনে চৈতন্য ফিরে এলো। এর পরদিন সকালে সবাই মিলে দেখতে গেলাম পৃথিবী বিখ্যাত ঐতিহাসিক আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি। যাচ্ছিলাম ঘোড়ার গাড়িতে। যেতে যেতে মনে পড়ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু লেখা, ‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত।’ এই লাইব্রেরিটি সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার প্রতীক।

লাইব্রেরি দর্শন শেষে রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দেখতে গেলাম আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত সেই বাতিঘরটি। সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজগুলো যেন রাতের অন্ধকারে দিক না হারিয়ে ফেলে, সে জন্য সমুদ্রের তীরে বা পাহাড়ে প্রাচীনকালে নির্মাণ করা হতো বাতিঘর। প্রাচীন সময়ের সব থেকে উঁচু বাতিঘরটি হলো এই আলেকজান্দ্রিয়া বাতিঘর। বিস্ময়কর এই বাতিঘর ভূমধ্যসাগরের উপকূলে মিসরের ফায়োস নামের একটি দ্বীপে। পরদিন সকালে রওনা হলাম রাজধানী কায়রোর উদ্দেশে। কায়রো এসে পৌঁছালাম সন্ধ্যায়। এখানে আমরা একটি হোটেলে উঠেছিলাম। তার পরের দিন দেখতে গেলাম কায়রো জাদুঘরে। সারা পৃথিবীর পর্যটকদের যেন মিলনমেলা বসেছে। টিকিট কেটে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আমরাও ঘুরে ঘুরে দেখলাম প্রাচীন নির্দশনসমূহ। আর দেখলাম বিশ্ববিখ্যাত মমি। যা দেখে শিহরিত ও বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। রাতের শহর কায়রো কায়রোকে বলা হয় ‘রাতের শহর’। আমরা দুই পরিবার একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে কায়রোর রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।

রাতের কায়রো বড় চমৎকার। দোকানিরা তাদের দোকানগুলোকে মনোরমভাবে সাজিয়ে রেখেছে। যা দেখলে সবারই কেনাকাটা করতে ইচ্ছে করবে, আমরাও অনেক কিছু কিনেছিলাম। মিসরের খাবার আমাদের খাবারের মতো নয়। মিসরীয়রা নরম নরম আঠালো ভাত খেতে পছন্দ করে। তার চেয়েও বেশি পছন্দ করে খবুজ বা রুটি। তবে পর্যটকদের জন্য রয়েছে নানা রকম খাবারের দোকান। তবে আমরা বেশির ভাগ সময়েই রুমে রাইস কুকারে রান্না করে খেয়েছিলাম। এরপর দেখতে গেলাম বড় কাঙ্ক্ষিত সেই পিরামিড। সভ্যতার আদিভূমি মিসর। মানব ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এ মিসরেই হয়েছে। মিসর বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পিরামিডের ছবি। এটি পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের একটি। পিরামিড হলো একপ্রকার জ্যামিতিক আকৃতি বা গঠন, যার বাইরের স্তরগুলো ত্রিভুজাকার এবং যারা শীর্ষে একটি বিন্দুতে মিলিত হয়। মিসরে রয়েছে ছোট–বড় প্রায় ৭৫টি পিরামিড। সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় হচ্ছে ‘গিজার পিরামিড’ যা ‘খুফুর পিরামিড’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের এক আশ্চর্য পিরামিড দেখে মুগ্ধ ও অভিভূত হলাম। ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস বলেছিলেন, ‘মিসর নীলনদের দান’। সেই নীলনদে রাতের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে জাহাজে করে ঘুরে বেড়িয়েছি আর উপভোগ করেছি তাদের সংস্কৃতি ও আতিথেয়তা। যতক্ষণ জাহাজে ছিলাম, সম্পূর্ণ সময়টা নাচে–গানে ও আপ্যায়নে ভরপুর ছিল এবং স্মৃতিপটে থেকে গেল কত স্মৃতিময় ঘটনা। আবার ভোর হলো। কায়রো শহরকে চিরকালের মতো বিদায় জানিয়ে ছুটলাম মিসরের আরেক প্রান্তে। গেলাম লুক্সের, ফেরাউনের প্রাসাদ এবং মিসরের আধুনিক ও পর্যটন নগর হুরগাদায়। যতদূর সম্ভব এভাবে ঘুরে ঘুরে দেখলাম মিসরকে। আর স্মৃতির ভান্ডারে যতন করে রেখেছি সেই আনন্দঘন স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো। যা এখনো মনের কোনে নিজের অজান্তেই উঁকি মারে। আমাকে আজও আবেগাপ্লুত করে। সবকিছু মিলিয়ে আসাধারণ ভ্রমণের একটি দেশ মিসর।

*লেখক: শিক্ষিকা ও লেখক