মন্ডার খোঁজে মুক্তাগাছায়
মন্ডা নামটি ছড়িয়ে দিয়েছে মুক্তাগাছাকে; যেমন আমড়া বরিশালকে! কাঁচাগোল্লা কিংবা রূপসী বনলতা নাটোরকে! মুক্তাগাছার মন্ডার সুনাম অনেক আগে থেকেই শোনা। বিবিসি বাংলায় শুনেছি এ নিয়ে প্রতিবেদন; মন্ডায় মুগ্ধতা ছড়িয়েছে গুণীজনের কথোকপথনেও; এসেছেন মন্ডার স্বাদ নিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এ তালিকায় দেশি বিদেশি রথী-মহারথীর নাম দেখে খটকা লাগার কথা; এক জায়গায় দেখলাম জোসেফ স্টালিনের নাম; আসুন বা না আসুন, মন্ডার স্বাদ নাকি তিনি পেয়েছিলেন; আমাদের তেজস্বী কমরেডরা পৌঁছে দিয়ে থাকবেন হয়তো বা! নেতাজি সুভাষ বসুও আছেন এ তালিকায়; বিধান বাবু থেকে এ দেশীয় কোনো বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বাদ পড়েননি; আমরাই বা বাদ পড়ি কেমন করে!
মুহাম্মদ উল্লার গাড়িতে চেপে বসলাম; কেউ কেউ ভুলক্রমে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ ডাকতে আরম্ভ করেছে ইদানীং আমাদের! তা বেশ শোনায় আমাদের কর্ণকুহরে! আলম ভাই আয়োজন করেছেন; বাংলোয় থাকব; মধুপুরের ফরেস্ট্রি কটেজ জলুই; সঙ্গে জ্যোৎস্না তো আছেই! আছে ট্যুরের উসকানিদাতা রাজ্জাকি; কুড়িগ্রাম থেকে চলে এসেছেন; আর শিবলী আজাদ বিশ্বজয়ী দ্য আমেরিকান! অবশ্য সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছেন।
সকালের যাত্রায় মধুপুরে পৌঁছে গেলাম দুপুরের আগেই; আরেকটু এগিয়ে ১৩ কিলোমিটার দূরে পীরগাছা রাবার বাগান; ওটা দেখার লোভ সামলাই কেমন করে! সময় ও বাহন দুই–ই যখন অনুকূলে! তিন হাজার একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে এ বাগান, সে ১৯৮৬ সালের কথা। দেড় লাখ গাছ থেকে সারা বছরই সাদা রাবার সংগ্রহ করা হয়। সে রাবার চলে যায় বাগানেই অবস্থিত রাবার কারখানায়; তৈরি হয় বড় বড় রাবার শিট। এখানে একটি বাংলো আছে, রাত্রিযাপনে বনের সৌন্দর্যের সঙ্গে বানর আর পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়। আমরা অবশ্য ফিরলাম দুপুরেই ডাকবাংলো জলুইতে; মধুপুর গড়ে। বনের ভেতর সরকারি বাংলো। করোনার কারণে লোকজনের আসা কমেছে; অবশ্য দর্শনার্থীরা আসেন বানর দেখতে। বানরগুলো আসে খাবার খেতে।
আমাদের দুপুরের খাবার বাইরে কোথাও খেতে হবে; তবে চা–নাশতার ব্যবস্থা ছিল। ফ্রেশ হয়ে ধীরে–সুস্থে বের হলাম। উদ্দেশ্য দুপুরের খাবার। সেই সঙ্গে মুক্তাগাছা দর্শন আর মন্ডা চেখে দেখা। বাংলো থেকে মুক্তাগাছা ১৭ কিলোমিটার; স্বল্প সময়ের পথ। পথে বেশ কিছু বাজার পড়ে, এসব বাজার আনারসে ভরা। মধুপুর আনারসের হেড কোয়ার্টার, যেমন শ্রীমঙ্গল চায়ের। বাজারগুলো বিচিত্র নামের; কোনোটা কাব্যিক; কোনোটা আবার রস-কষহীন; জলছত্র, ল্যাংড়া; হাঁটুভাঙাও বাদ পড়েনি! আমাদের হাঁটু ঠিক থাকলেই হয়! দুপুরের খাবার গড়াল বিকালে। তা গড়াক; আমাদের তাতে কী আসে যায়! উদর যে ভালোই পূর্তিতে ফূর্তি করছে!
এবার মন্ডা দেখার পালা। মুক্তাগাছা শহরের মধ্যেই; একনামে চেনে; অচেনা কাউকে এখানে পাওয়া দুষ্কর! সিংহ মার্কা মন্ডার দোকান; অন্য কোনো শাখা-প্রশাখা নেই কোথাও। রাম গোপাল পাল গড়ে তুলেছিলেন এই মন্ডার দোকান ১৮২৪ সালে। মুক্তাগাছার পরিচিতি এখন মন্ডার নামেই। পেছনের ইতিহাস বলে, গোপাল পালের জন্ম মুর্শিদাবাদে। সেখান থেকে চলে আসেন রাজশাহীতে। এরপর মুক্তাগাছায় স্থায়ী আবাস। কিংবদন্তি আছে, স্বপ্নে গোপাল দেখতে পান এক সাধু তাঁকে বলছেন মন্ডা বানাতে। ঘুম ভাঙলে নির্দিষ্ট জায়গার মাটি খুঁড়ে স্টোভ পান; সাধু তাঁর হাত ধুয়ে মিষ্টি বানানোর কৌশল শিখিয়ে দেন। এ মিষ্টি মুক্তাগাছার মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর দরবারে সমাদর পায়। জমিদার সন্তুষ্ট হয়ে মিষ্টির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আর এভাবেই গড়ে ওঠে মন্ডার ভান্ডার। মন্ডা দুই রঙের—সাদা আর বাদামি। শীতের গুড় থেকে তৈরি হয় বাদামি মন্ডা। তৈরির উপাদান হলো দুধ, চিনি আর ময়দা। তবে কারিগরি দক্ষতা আর ইনগ্রেডিয়েন্টসের পরিমিতি যেকোনো খাদ্যবস্তুকে অন্যদের তুলনায় আলাদা করে রাখে! সেই সঙ্গে কাঁচামাল প্রাপ্তি ও তার শিল্পগুণ যুক্ত হয়ে তৈরি হয় ব্র্যান্ডিং। যেমন পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, জামতলা যশোরের স্পঞ্জ রসগোল্লা; আবার বস্তুর ক্ষেত্রে গাজীপুরের কার্পাসে তৈরি মসলিন ইত্যাদি।
ঢাকা থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরে মুক্তাগাছা, উপজেলা শহর, ময়মনসিংহ থেকে ২৫ কিলোমিটার। ট্রেনে চলে যাওয়া ময়মনসিংহে; বিভিন্ন পরিবহনের বাসও আছে ঢাকা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের এই শহর ময়মনসিংহে। আবার সরাসরি মধুপুরেও যাওয়া যায় বাসে। আমাদের গন্তব্য ছিল বন বিভাগের কটেজ জলুই; জল আর জ্যোৎস্নার মিতালি মধুপুরের গহীন অরণ্যে। সত্যজিতের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ তো কতবারই দেখা হয়েছে! সৌমিত্র বাবুর অভাব বোধ করিনি; তবে শর্মিলীরা কোথায়! কে জানে!
*লেখক: জিল্লুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, ইংরেজি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ, ইউডা