পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া— দেশজুড়েই যেন প্রকৃতি তার আপন গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। কোথাও নদী, কোথাও হাওর, আবার কোথাও দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়-পর্বত, টিলা, গভীর অরণ্য। বাংলাদেশ কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধারই নয়, এর রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য। তরুণদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা চাই। আমরা হয়তো ইতিহাসের বই পড়ে ইতিহাস জানতে পারি। কিন্তু যে ঐতিহাসিক স্থানে ঘটে যাওয়া বিষয় ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে, শুধু বই পড়ে তা জানা গেলেও পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, যদি না সেখানে যাওয়া হয়। তাই আমাদের বই পড়ার পাশাপাশি ঘুরতেও যেতে হবে।
দেশের প্রতিটি জেলার রয়েছে স্থানীয় সংস্কৃতি, জীবনাচার ও ঐতিহ্যবাহী খাবারদাবার। প্রতিটি জেলাই কোনো না কোনো জিনিসের জন্য বিখ্যাত। তরুণরদের উচিত অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যাওয়া। কেননা, এতে মানসিক প্রশান্তি যেমন পাওয়া যায়, তেমনি জ্ঞানেরও বিকাশ ঘটে। দুঃখের বিষয় হলো, অনেক তরুণ আছে, যারা অন্য জেলা দূরে থাক নিজের জেলাই ঘুরে দেখেনি। ফলে দেখা যায়, তাদের মধ্যে অনেকেই নিজ জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞ। কিন্তু তারা যদি অন্তত নিজ জেলা চষে বেড়ায় এবং কোথায় কী আছে, তা জানার প্রয়াস চালায়, তাহলে তা অন্যদের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হবে। বিশেষ করে, এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যুগে তা আরও সহজ একটি বিষয়। কোথাও ঘুরতে গিয়ে সেটা মোবাইলে ধারণ করে, নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে শেয়ার করার মাধ্যমে তাদের বন্ধুদের নিজ জেলায় আমন্ত্রণ জানাতে পারে তারা। এতে ওই জেলার পর্যটনশিল্পের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে।
পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালে, অনেক স্বপ্নবাজ তরুণের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। অনেক তরুণ পায়ে হেঁটে নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। কেউ কেউ সাহসিকতার সঙ্গে পাহাড়-পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করে লাল-সবুজের পতাকা উঁচু করে ধরছে। তাদের মধ্যে অনেকে দেশের পাহাড়-পর্বত ছাপিয়ে এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উঁচু করে ধরার স্বপ্ন দেখছে। আবার কেউ কেউ দেশের নদ-নদী, পাখপাখালি, জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করছে। পাখির জন্য গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি বসাতে দেখা যায় অনেককে, যা আগামী দিনগুলোতে তারুণ্যের সম্ভাবনাকেই তুলে ধরে।
পর্যটনশিল্পের বিকাশে তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যরাও যেন ভ্রমণে আগ্রহী হয়, সে জন্য তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা অন্যের সাথে শেয়ার করতে হবে; এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যমে হলো পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কোথাও ঘুরতে গিয়ে তারা সেখানকার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা মোবাইল কিংবা পিসিতে লিখে পত্রিকা অফিসে মেইল করে দিতে পারে। পাঠানো লেখাটি পত্রিকা ছাপিয়ে দিলে, সেটা পড়ার মাধ্যমে হাজারো তরুণ নতুন জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হবে। আবার কেউ চাইলে ফেসবুক লাইভে এসে, বাংলা কিংবা ইংরেজি ভাষায় সে স্থান সম্পর্কে মানুষকে জানাতে পারে। ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরা যেতে পারে। প্রযুক্তি যথাযথভাবে ব্যবহার করে এভাবে তারা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো তুলে ধরতে পারে। এ ছাড়া পর্যটন এলাকায় যাতে জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতি না হয়, তার জন্যও তরুণেরা প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে। সাধারণ মানুষকে পর্যটন এলাকার প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সচেতন করতে পারে।
অন্যদিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে যদি দেশি সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য না তুলে ধরা হয়, তাহলে প্রযুক্তির এ সহজলভ্যতার যুগে তারা বিদেশি সংস্কৃতির কবলে পড়ে ভুলে যাবে দেশমাতৃকার সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য। কাজেই পিতা-মাতার উচিত তাঁদের সন্তানকে অবসর সময়ে দেশের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে নিয়ে যাওয়া। তাদের সামনে দেশের লোকশিল্প, মৃৎশিল্প, কুটিরশিল্প, বাঙালির জীবনযাত্রা, দেশীয় রান্নাবান্না, খাবারদাবার তুলে ধরা। সে জন্য দরকার দেশের আনাচকানাচে ছুটে যাওয়া। আমাদের মনে রাখতে হবে, যারা নিজেদের শিকড়কে ভুলে যায়, তারা বেশি দিন টেকে না।
পর্যটনের মাধ্যমে তরুণদের মাঝে শুধু যে ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা যায় শুধু তা নয়, এর মাধ্যমে তারা সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের দীক্ষা লাভ করতে পারে। দেখা যায়, অনেক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা বছরের একটি সময় স্টাডি ট্যুরে বের হয়। তাদের সঙ্গে শিক্ষকেরাও থাকেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের বলে দেয় হয়—কখন, কোন জায়গায় কী করতে হবে, কোন কাজগুলো করা যাবে না এবং শিক্ষার্থীরা তা পালন করে থাকে। এভাবে তারা বছরব্যাপী শ্রেণিকক্ষে যা শিখল ভ্রমণে এসে তা চর্চা করার সুযোগ পায়। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এতে যেমন আনন্দ পায়, তেমনি পরবর্তী জীবনে এটি তাদের সুশৃঙ্খল হতে সাহায্য করে।
বিভিন্ন সময় ভ্রমণে গিয়ে অনেক তরুণ-তরুণীকে বিপদের সম্মুখীন হতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই ঘুরতে বের হওয়ার আগে পরিকল্পনা ঠিক করে নিতে হবে এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আরেকটি কথা হলো, তরুণদের পর্যটন এলাকায় কোনোভাবে বিশৃঙ্খল হওয়া যাবে না, তাদের নম্রতা, ভদ্রতার পরিচয় দিতে হবে সেখানে। কেননা, আজকের তরুণেরাই আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব দেবে। তাই তাদের সুনাগরিক হওয়ার বিকল্প নেই। মোদ্দাকথা হলো, পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। আর এ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সবার আগে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।
*লেখক: মারুফ হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়