পর্যটনশিল্পে শৃঙ্খলা ফিরুক

দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করতে পরিকল্পিত পর্যটনের গুরুত্ব অপরিসীম। পর্যটনশিল্পকে পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলা না গেলে তা থেকে উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। আমাদের দেশে দিন দিন পর্যটনশিল্পের গুরুত্ব বাড়লেও কমছে পরিকল্পিত পর্যটন। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যেখানে–সেখানে ময়লা–আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা যায়। আবার পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। প্লাস্টিক দূষণের স্বীকার হচ্ছে অধিকাংশ পর্যটন এলাকা। যত্রতত্র চকলেট, চিপসের প্যাকেট, ফলের খোসাসহ ইত্যাদিতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। আবার কোথাও কোথাও ধারণক্ষমতার অধিক পর্যটকের সমাগম হওয়ায় সেখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। সেন্ট মার্টিনের কথাই ধরুন। এখানে অতিরিক্ত পর্যটকের যাতায়াতের কারণে বা অপরিকল্পিত পর্যটন সেন্ট মার্টিনের প্রবালের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় সাগরতলে হারিয়ে যাবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। তাই সেখানে পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল পর্যটন গড়ে তোলা সময়ের দাবি।

ঘোরাঘুরি একজন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আর আমাদের আনন্দদায়ক ভ্রমণের জন্যই পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে ভালো রাখতে হবে। সেখানকার পরিবেশ যেন ক্ষতির সম্মুখীন না হয়, সেদিকে সবার খেয়াল রাখা জরুরি। ঘোরাঘুরির মাধ্যমে শুধু যে মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে তা নয়; এর মাধ্যমে আমরা সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের দীক্ষা লাভ করতে পারি। কোথাও ঘুরতে গেলে আমরা পারি আমাদের সন্তানদের আচরণে পরিবর্তন আনতে। তাদের বলে দিতে পারি পর্যটনকেন্দ্রে কিংবা অন্য কোনো জায়গায় কোথায় চকলেটের কাগজ ফেলবে, কোথায় ময়লা-আবর্জনা ফেলতে হয়। মোটকথা হলো সেখানে তাদের চলাফেরা কেমন হবে, তা আমরা তাদের শেখাতে পারি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আজকের শিশুরাই আগামীর নাগরিক। তাই তাদের যোগ্য ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পর্যটনকেন্দ্রে যদি তাদের এ শিক্ষাগুলো দেওয়া যায়, তাহলে তারা এ কাজগুলো তাদের বাস্তব জীবনেও প্রতিফলনের চেষ্টা করবে। কেউ যদি নিজ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ না করে, তাকে কথা বলে, ভয় দেখিয়ে কতক্ষণ সামলানো যায়! সুতরাং আমাদের উচিত, নিজ নিজ জায়গায় থেকেই পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে পরিকল্পিত পর্যটন গড়ে উঠেছে, সেখানে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব!

অন্যদিকে পর্যটকদের বিভিন্ন ঝামেলায় পড়তে দেখা যায়। হয়রানি, অতিরিক্ত খরচ বহন, অবকাঠামোগত সমস্যা, আবাসনের অপ্রতুলতা, সুস্থ বিনোদনের অভাব ইত্যাদি কারণে পর্যটকদের আনন্দদায়ক ভ্রমণ বিষাদে রূপ নিচ্ছে। ফলে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যেতে তাঁরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। অনেককে উচ্চ ভলিউমে মাইক বা সাউন্ড বক্স বাজিয়ে সেখানে শব্দদূষণ করতে দেখা যায়। ডিজে গানের মতো অশ্লীল গান বাজানো যেমনি একজন পর্যটকের ক্ষতির কারণ হচ্ছে, তেমনি স্থানীয় মানুষও বিরক্ত হয়।
কোনো জায়গায় গেলে সেসব স্থানের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে পর্যটকেরা সাধারণত ছবি তুলতে আগ্রহ দেখান। কিন্তু দেখা যায়, কিছু অসাধু ফটোগ্রাফার সামান্য কিছু ছবি তুলে দিয়ে পর্যটকদের জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে।

অনেক সময় ১০০ কিংবা ২০০ টাকার জায়গায় তাঁদের গুনতে হয় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। এমনই একটি অভিজ্ঞতার কথা শুনতে পাই আমার এক মামাতো ভাইয়ের মুখে। তারা কয়েকজন মিলে গতবার কুয়াকাটায় বেড়াতে গিয়েছিল, সেখানে তারা এক ফটোগ্রাফারকে তাদের ছবি তুলে দিতে বলে। কিন্তু তিনি তাদের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে তাঁর নিজের মতো করে ছবি তুলতে থাকেন এবং একপর্যায়ে অল্প কয়েকটা ছবির জন্য দুই হাজার টাকার মতো দাবি করে বসেন। এভাবে অনেক পর্যটককে ছবি তুলতে গিয়ে হয়রানির স্বীকার হতে দেখা যায়।

অন্যদিকে সমুদ্রের জলে গোসল করতে গিয়ে নারীদের পরতে হয় যত বিড়ম্বনায়। সেখানে দেখা যায়, অনেকে তাদের এলোমেলো অবস্থার ছবি তোলে এবং পরবর্তীকালে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়, যা কখনো কাম্য নয়। আবার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে অনেক লোকেশন সাইনবোর্ড শুধু বাংলায় হওয়ায় বিদেশি পর্যটকদের সঠিক লোকেশন খুঁজে পেতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাই এখানকার লোকেশন সাইনবোর্ডগুলো বাংলার পাশাপাশি যেন ইংরেজিতেও লেখা হয়। এতে বিদেশি পর্যটকদের জন্য লোকেশন খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। পর্যটন এলাকার প্রতিটি সম্পদ নিজের ভেবে সেখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

অনেক জায়গায় পুকুর–জলাশয় ভরাট করে কিংবা গাছপালা, বন উজাড় করে ভবন গড়ে তুলতে দেখা যায়, যা কখনো সমীচীন নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে পর্যটনশিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। মোদ্দা কথা, শুধু পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুললে হবে না, সেটি যেন পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে ওঠে। সমস্যা, প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে আমাদের দেশে পরিকল্পিত পর্যটন গড়ে উঠবে, এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক: মারুফ হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া