নেপালের সিন্ধুপালচক: একটি না ভোলা পথের গল্প
ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে না, এমন মানুষ বোধ হয় খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রকৃতির খুব কাছাকাছি যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে ঘুরে বেড়ানো। কখনো কখনো পরিকল্পনা করে ঘুরতে যেতে হবে সেটা যেমন ঠিক, আবার পরিকল্পনাবিহীন ঘোরার আনন্দও অপার। পেশাগত অথবা অন্য কোনো প্রয়োজনে বাইরে কোথাও যেতে হলে শুধু মন আর দেখার চোখ দুটো খোলা রাখলেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় অনেক আনন্দময় স্মৃতি যোগ হতে পারে। এ রকমই প্রেক্ষাপটে কয়েক দফা নেপাল ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। যদিও গুটিকয়েক ছবি তোলা ছাড়া কোথাও এ অভিজ্ঞতার কথা লেখা হয়নি কখনো। নেপাল বললে সবার মতো আমারও প্রথম যেটা মনে এসেছিল, সেটা হলো হিমালয়ের সাদা বরফের চূড়া, কাঠমান্ডুর দরবার স্কয়ার, পশুপতিনাথ মন্দির, নাগরকোট অথবা পোখারার কথা। এগুলো তো নেপালের প্রতিষ্ঠিত ও বহুল প্রচারিত সৌন্দর্য, যা সত্যিই অসাধারণ। কিন্তু আজ লেখার বিষয়বস্তু ভিন্ন।
আজ বলব নেপালের সিন্ধুপালচক নামের একটি জায়গার কথা। যেখানে যেতে যেতে সত্যিই মনে হবে, গন্তব্যে পৌঁছানোর কোনো মানেই হয় না, পথই যেন গন্তব্য। আজ মূলত এই যাত্রাপথ এবং পথের পাশের দৃশ্যমান বস্তুগত ও অবস্তুগত বিষয়েরই গল্প বলব। সিন্ধুপালচক জেলার খাঁড়া পাহাড়, আচমকা নেমে আসা দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি ঝরনা, আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা আর ঘন পাইনবন ক্ষণিকের জন্য হলেও নিশ্চিত আপনাকে নিয়ে যাবে রূপকথার দেশে।
সিন্ধুপালচক নেপালের বাগমতি প্রদেশের অন্তর্গত চীনের সীমান্তবর্তী একটি স্বল্পোন্নত জেলা। ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে এ জেলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং প্রায় ৩ হাজার ৫০০–এর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। জেলাটি অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় ভূমিকম্প–পরবর্তী ত্রাণ তৎপরতা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয় এবং স্থানটি আজও সে জীর্ণতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সড়কপথে কাঠমান্ডু থেকে যেতে আমাদের সময় লেগেছিল প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো। শহর থেকে মাইক্রোবাসে যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরই আশপাশের দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে। কিছু দূর যেতেই মাটির রং বদলাতে থাকে, বাড়িঘরের দূরত্বও বাড়তে থাকে। দূরে ওপরে তাকালে কেব্ল কারের আসা-যাওয়া চোখে পড়ে দু–একবার। এ ধরনের সরু ও ঢালু রাস্তায় যে কখনো বাস চলতে পারে, প্রথমত সেটাই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল আমার। পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠার রোমাঞ্চকর যাত্রায় বেশির ভাগই ছোট গাড়ি চোখে পড়েছে।
যাওয়া-আসা মিলিয়ে মাত্র দুটি যাত্রীবাহী বাস দেখেছি, আর তাতেই আমার ধারণা পাল্টে গেছে। মানুষের নিজের ওপর ভরসা আর সাহস দেখে বারবার মনে হয়েছে, সত্যিই মানুষের অভিধানে ‘না’ বলে কিছু নেই। ভেবেছি, এটা যদি আমার নিত্যদিনের যাতায়াতের রাস্তা হতো, তাহলে ঘটনাটি কেমন দাঁড়াত! সে যা–ই হোক, এই যে এত উঁচুতে ওঠা কিংবা নামা, এটার কিন্তু আলাদা একটা মর্মার্থ আছে। কোনো কোনো সময় না চাইতেই জীবন অনেক রোমাঞ্চ ছড়িয়ে রাখে তার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে। পাহাড়ের গা বেয়ে দারুণ সরু রাস্তা ধরে ওপরে উঠতে গিয়ে আমার অন্তত সেটাই মনে হয়েছে। যেকোনো সময়ের চুল পরিমাণ অসতর্কতা মুহূর্তেই চিরতরে সব নিঃশেষ করে দিতে পারে, এটা জেনেও মানুষ কখনো থেমে থাকে না। গতিময়তার অপর নামই যে জীবন, সেটা আরও একবার নয়, কয়েকবার আপনার মনে হবে এই যাত্রাপথে।
আমরা যখন শহর পেরিয়ে সবে পাহাড়ি রাস্তায় উঠতে শুরু করেছি, তখন নিচ থেকে ওপরের গাড়িগুলোকে ভীষণ ছোট দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। প্রথমে বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিল যে ওগুলো আসলে চলন্ত গাড়িই। তারপর একসময় আমাদের গাড়িই যখন ওই একই উচ্চতায় পৌঁছাল, তখন নিচে তাকাতে ভয়ই লেগেছিল। আবার এ পথের শেষ কোথায়, সেটা দেখার উত্তেজনাও চেপে রাখা কঠিন ছিল। সব মিলিয়ে দারুণ একটা অনুভূতি, যেটা ওই পরিস্থিতিতে না পড়লে বোঝানো যাবে না। এর ওপর আছে শীতের দাপট। যতই ওপরে উঠি, শীতলতার অনুভূতি আরও তীব্র হয়। তারপরও নির্মল শীতল আবহাওয়া, পাশের পাইনবনের ঘনত্ব, দূরে নিরক্ষরেখার মতো চীনের সীমানাপ্রাচীর, নরম রোদ্দুর আর ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘদল দেখে মনে হতে বাধ্য, পৃথিবীতে যেনবা উচ্চতাই সত্য, বাকি সব অকিঞ্চিতকর!
কিন্তু বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। আরও কিছু দূর এগোতেই মানববসতিহীন উঁচু পাহাড়ের মধ্যে পিতলের বিশালাকার এক বুদ্ধমূর্তি অবিচল, স্থিরতার প্রতীক হয়ে নির্জনতার মধ্যে বসে আছে! এত উঁচুতে, এত বড় বুদ্ধমূর্তি দেখা যেতে পারে, সেটা আশাতীত ছিল।
পরিবেশটাই এমন যে আরও একবার মানুষ হয়ে জন্মানোর জন্য মনে মনে বলতে হবে ‘আমি অকৃতী অধম বলেও তো, কিছু কম করে মোরে দাওনি!’ এরপর আরও আছে পাহাড়ি ঝরনার সমতলে নেমে আসা এবং হঠাৎ থমকে গিয়ে নুড়িপাথরের সঙ্গে কাদাপানি মিশে যাওয়ার দৃশ্য। যেন পরিচিত কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন। সত্যিই আমার এমন মনে হয়েছিল। ‘খাদ’ নামে পশ্চিম বাংলার পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলির একটি অসাধারণ সিনেমা আছে। যেখানে একটি পাহাড়ি জলাধারের পাশে কাহিনির প্রয়োজনে সবাই আটকে থেকে স্মৃতিচারণা করে। সিন্ধুপালচক যেতে ওই রাস্তার পাশে এ রকম জলাধার দেখে ছবির দৃশ্যের সঙ্গে অনেক মিল পেয়েছিলাম। খুব নামতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য সময়ের সীমাবদ্ধতা ছিল আমাদের। তাই আর থামা হয়নি। কিন্তু তাতে কোনো আক্ষেপ নেই, যা দেখেছি সেটাই তো ভাবনার বাইরে ছিল।
যাত্রাপথে আমাদের সঙ্গে ছিল নেপালি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থার দুই সহকর্মী, যাদের মধ্যে একজন পূর্বপরিচিত। ওর সঙ্গে একসময় আমি বাংলাদেশেও কাজ করেছি। দীর্ঘদিনের পরিচিত হওয়ার কারণে এবং আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের ফলে গল্পের ফাঁকে ওর কাছ থেকে সিন্ধুপালচক সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পেরেছিলাম। যেমন এখানকার সূর্য কোশি ও ভোটে কোশি নদী ভেলা চালানোর জন্য বিখ্যাত। এখানে নেপাল-চীন সীমান্তের খুব কাছেই ‘হাতছানি’ বা ‘গরম জলের ঝরনা’ নামে একটি তীর্থস্থান আছে। এ ছাড়া মাউন্টেন ট্র্যাকিংয়ের জন্যও এ এলাকার খ্যাতি আছে বেশ। এখানে ‘ল্যাংটাং’ নামের একটি জাতীয় উদ্যানও রয়েছে।
এ ছাড়া সিন্ধুপালচকে ঐতিহ্যবাহী অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যাত্রা বিরতিতে আমরা যে রিসোর্টে দুপুরের খাবার খেতে (যদিও তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়) থেমেছিলাম, সেটিও ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। অনেক উঁচুতে বসে মজাদার সব খাবার খেতে খেতে চারপাশের নির্জন পাহাড় দেখা আর পাখিদের অবিরাম ডাকাডাকি নিঃশব্দতার ভিন্ন গল্প শোনাবে। অথবা জীবনকে বস্তুগত দেনা-পাওনার বাইরে এনে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। মনে হবে, যেন অনন্তকাল থেকে যাই এই গ্রহে। যথাযথ প্রচার ও প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে স্থানটি নেপালের অন্যান্য জায়গার মতো পর্যটকদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। সব পথই একসময় শেষ হয় অথবা আমরাই যাওয়া থামিয়ে দিই। কিন্তু কোনো কোনো পথ থেকে যায় মনের কোণে। সিন্ধুপালচক ভ্রমণ এমনই একটি না ভোলা পথের গল্প।
লেখক: একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত