দ্বীপ জেলা ভোলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন
বাংলাদেশের দক্ষিণে দ্বীপ জেলা ভোলার অবস্থান। এ জেলার মানচিত্রের দিকে তাকালে যেন নদীমাতৃক বাংলাদেশেরই চিরচেনা রূপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। প্রাকৃতিক গ্যাসে এ জেলার রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। প্রাকৃতিক গ্যাস–সম্পদে ভরপুর এ জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও লীলাভূমি। ভোলাকে বলা হয় কুইন আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ। নদী-চর-অরণ্য-সাগর—এ জেলাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। রূপালি ইলিশের জন্যও এ জেলার সুখ্যাতি রয়েছে। স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন বাংলার আইফেল টাওয়ারখ্যাত জ্যাকব টাওয়ার এ জেলায় অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ জেলায় পর্যটনশিল্পের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা।
মনপুরা, চর কুকরিমুকরি, তারুয়ার দ্বীপসহ এখানে রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণকেন্দ্র। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এলাকাগুলোতে না গিয়ে কোনো দর্শনার্থী বুঝতেই পারবেন না, এখানকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য কতটা মনোমুগ্ধকর! জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, নদীপারের মানুষের জীবনযাপন, মাঠে রাখালের মহিষ চরানোর অপরূপ দৃশ্য—যেন ছোটবেলার সেই বাংলা বইয়ে আঁকা পল্লিগ্রামের ছবির মতোই মনে হয়! নদী ভ্রমণ যাঁদের শখ, তাঁদের জন্যও ভোলা জেলার পর্যটন স্পটগুলো অনেক আকর্ষণীয়। চর কুকরিমুকরি বা তারুয়ার দ্বীপের লাল কাঁকড়া, অতিথি পাখির কূজন, সমুদ্রের কল্লোল, নানান প্রজাতির প্রাণীর আনাগোনা দর্শনার্থীদের মন জুড়িয়ে দেবে। হয়তো অনেকের মনে হবে, যেন কক্সবাজার কিংবা সুন্দরবন এসেছেন।
অন্যদিকে সাগরকন্যা মনপুরার নাম শোনেননি, এমন মানুষ পাওয়া দায়। মনপুরার সৌন্দর্যে মন ভরে যায় পর্যটকদের। দিন দিন ভোলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় স্থানগুলোতে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসব স্পটগুলোতে ঘুরতে আসেন। ভোলার চর ফ্যাশনে জ্যাকব টাওয়ার অবস্থিত। প্রায় সব সময়ই এখানে দর্শনার্থীর আনাগোনা লেগে থাকে। প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে একটু মানসিক প্রশান্তির জন্য অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে এখানে ঘুরতে আসেন। শুধু স্থানীয় বাসিন্দারা নয়, দূরদূরান্ত থেকেও অনেক পর্যটককে এখানে আসতে দেখা যায়।
দ্বীপ জেলা ভোলাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানিও বলা যেতে পারে। সবুজের সমারোহ আর নদী কিংবা সাগরের শোঁ শোঁ শব্দ, পাখির কূজন, বইঠা বেয়ে মাঝির নদী পারাপারের অপরূপ দৃশ্য ভ্রমণপিপাসুদের বারবার ভোলার দিকে নিয়ে আসে। ভোলা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই ভরপুর নয়, প্রাকৃতিক সম্পদেও আশীর্বাদপুষ্ট।
ভোলার মানুষ অতিথি পরায়ণতার জন্য সুখ্যাত। ভোলার বিখ্যাত মহিষের দই যে কারও মন জয় করে নেবে। ভোজনরসিক পর্যটকের নজর কেরে নেবে এখানকার স্বাস্যকর, সুস্বাদু খাবারদাবার। এ ছাড়াও এখানকার উৎপাদিত শস্য যেমন তরমুজ, সুপারি, নারকেল, ধান, আলু, বাদামসহ নানান শাকসবজি, ফলমূল দেশের মানুষের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখছে। ভোলার রূপালি ইলিশ দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
দুঃখের বিষয় হলো এ জেলা বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এখানকার মানুষ এখনো পিছিয়ে রয়েছে। সারা দেশে শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছালেও এখানে এখনো অনেক শিশু শিক্ষার আলো থেকে দূরে রয়েছে। অনেক শিশুরই যেখানে সন্ধ্যা হলে পড়ার টেবিলে বসার কথা, সেখানে তাদের অনেককেই বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে সাগরে যেতে হচ্ছে। গভীর রাতে মাছ ধরে বাড়িতে ফেরায় তাদের আর পড়ার সুযোগ হয় না। অল্প বয়সে সংসারের কাজে হাত দেওয়ায় অনেকেরই লেখাপড়া হয়ে ওঠে না। আবার দেখা যায়, নদীপারের অনেক মানুষ বিশুদ্ধ পানির অভাবে ভোগে। এক কলস পানির জন্য মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয় তাদের।
এ জেলার চারপাশে নদী হওয়ায় অন্যান্য জেলার সঙ্গে যোগাযোগে নদীপথই একমাত্র ভরসা। বিভাগীয় শহর বরিশাল কিংবা রাজধানী ঢাকায় যেতে যাত্রীসাধারণকে লঞ্চের ওপর নির্ভর করতে হয়। বৈরী আবহাওয়ায় নদীপথে যাতায়াত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। যাতায়াতের অসুবিধার কারণে পর্যটকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। এর ফলে এখানে ভ্রমণ করতে অনেকেই আগ্রহ হারান। অসুস্থ কোনো রোগীকে দ্রুত বরিশাল কিংবা ঢাকায় পৌঁছানো অনেক সময় অসম্ভব হয়ে যায়। তাই ভোলার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি হলো ভোলা-বরিশাল সেতুর দ্রুত বাস্তবায়ন, যাতে তাদের রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা দ্রুত ও সহজ হয়।
ভোলার ইতিহাস, ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। এখানে অনেক জমিদারবাড়ি এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। ঐতিহ্যবাহী এ জেলায় একটি পাবিলক বিশ্ববিদ্যালয় হলে শিক্ষার আলো আরও বিকশিত হবে। পাশাপাশি ভোলার মানুষের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এবং রোগীদের স্বাস্থ্যসেবায় ভোগান্তি কমাতে এখানে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। ভোলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনা গেলে এটি দেশের অর্থনীতির ভাগ্য বদলে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। আরেকটি বিষয় হলো গ্যাস থেকে যেন ভোলার স্থানীয় মানুষ উপকৃত হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
দেখা যায়, বন্যা কিংবা অন্যান্য দুর্যোগে নদীপারের মানুষের দুঃখের শেষ থাকে না। ভোলা উপকূলীয় জেলা হওয়ায় প্রায় প্রতিবছরই বন্যার প্রকোপে অনেক মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়। এ ছাড়া এ সময় জেলার পর্যটন স্পটগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। পর্যটকদের পড়তে হয় সীমাহীন দুর্ভোগে। তাই ভোলায় পর্যটনকেন্দ্রিক অর্থনীতির উন্নয়নে কর্তৃপক্ষকে অনেক বেশি যত্নশীল হতে হবে।
মোদ্দা কথা হলো ভোলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে এখানকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন সময়ের দাবি। ভোলা জেলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনায়ন করে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাক, পাশাপাশি ভোলায় পর্যটনশিল্পের বিকাশ তরান্বিত হোক।
*লেখক: মারুফ হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া