চায়ের দেশে ঘোরাঘুরি

উত্তরের হিমেল হাওয়া তখন কমে গেছে। পরিবেশ নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁরা এ সময়ের নাম দিয়েছেন বসন্ত। পাতাঝরা এই সময়েই আমাদের যেতে হবে শিক্ষাসফরে। মূলত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরে। যেহেতু আমরা উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, তাই চায়ের বাগানে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ থেকেই চা প্রসেস করার প্রক্রিয়া হাতে–কলমে শেখা জরুরি। সঙ্গে একটু ঘোরাঘুরি। সব মিলিয়ে দেখা গেল সীমান্ত–লাগোয়া শহর সিলেটে যার অনিন্দ্য কম্বিনেশন। ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব ২৪৩ কিলোমিটার। বাস ভাড়া করা হলো।

এবার যাওয়ার পালা। মোট চার দিনের ট্যুরে আমাদের যেতে হবে বুরজান টি ফ্যাক্টরি, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর আর জাফলং।

ভোররাতের পর পূর্ব আকাশে রক্তিম আভা। বাংলাদেশের আকাশ সকাল হওয়ার প্রত্যাশায়। ঠিক তখনই আমাদের যাত্রা শুরু। কয়েকটি জেলা শহর পাড়ি দিতে হয় সিলেট যেতে। নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ—তারপর সিলেট। প্রতিটি জেলা একেকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে। চায়ের রাজধানী সিলেটে যেতেই চোখে পড়ে অনেক পাহাড় ও নদী। সেখানে পাহাড় আর মেঘের মেলামেলি। পাশের দেশের রাজ্যটির নাম হয়তো তাই মেঘালয়। ওখানেও চা হয়। দুয়ের মিলন যেন চায়ের প্রাণশক্তি। যদিও দার্জিলিংয়ের চা পৃথিবীপ্রসিদ্ধ। তবে সিলেটে চায়ের উৎপাদন বেশি।

সিলেট শহরে প্রথমেই গেলাম বুরজান চা ফ্যাক্টরিতে। সেখানে চা–পাতা সংগ্রহ করা, উইল্টিং, রোলিং, অক্সিডেশন, ফিক্সাশন, ইয়েলোয়িং, কিউরিয়ের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানলাম। চায়ের অনেক নাম জানলাম সেখান থেকে। গ্রিন টি, ইয়েলো টি, হোয়াইট টি, ওলং টি ও ব্ল্যাক টি। এ ছাড়া গোল্ডেন টি নামে আরেক প্রকার চা আছে, সে সম্পর্কেও জানলাম। পরদিন বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে জানলাম চায়ের আদি ইতিহাস সম্পর্কে। হান সাম্রাজ্য সর্বপ্রথম গ্রিন টি তৈরি করে আর মীং সাম্র্রাজ্য কালো চা। ব্রিটিশরা কিভাবে উপমহাদেশে চায়ের প্রচলন শুরু করে, সে সম্পর্কেও জানলাম। তারপর চা–বাগান ঘুরে দেখলাম। চায়ের ফুল দেখে অবাক হলাম। আরও অবাক হলাম, যখন জানলাম চা–গাছ আমরা যত ছোট দেখি, আসলে তত ছোট নয়। চা–গাছ ছোট করে রাখা হয়।

সিলেটের জাফলং ও ভোলাগঞ্জ অপরূপ সুন্দর দুটি স্থান। এর অবস্থান সিলেটের উত্তর–পূর্ব দিকে। ওপারেই ভারতের মেঘালয়। সামনে সারি সারি পাহাড়। দূর থেকে তাকালে মনে হয়, আকাশে হেলান দিয়ে আছে পাহাড়। আর পাহাড়ের গায়ে তুলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘরাশি। নিচে বয়ে চলছে ধলাই নদ। ধলাইয়ের বুকে বিছিয়ে আছে হাজারো পাথর। সাদা সাদা, কালো কালো, আবার কিছু ফ্যাকাশে। মনিরুজ্জামান স্যার পাথরের ফসিল সম্পর্কে ধারণা দিলেন। কালোগুলো বহু প্রাচীন, আর সাদাগুলো নতুন। পাথরের ফাঁকে পানির অবিরাম ধারায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।

সাব্বির স্যার যদিও সতর্ক করেছিলেন। পায়ের পাতা শীতল পানি ছুঁতেই শিহরিত হলাম। প্রচণ্ড গরমেও বরফ গলার মতো ঠান্ডা সেই পানি। কিন্তু পরে যখন জাফলং গেলাম, তখন মনে হলো একটির থেকে আরেকটি সুন্দর। ওপারে জৈন্তা পাহাড়। এপারে পিয়াইন নদী। দূরে পাহাড়ের ক্ষত থেকে সৃষ্ট ঝরনা আর নদীর বুকে সাজানো নানান রঙের পাথর। উঁচু পাহাড়ের সুনসান নীরবতা আর ঘন অরণ্য জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। ডাউকি পাহাড়ের অবিরাম জলপ্রপাত পিয়াইন নদীতে প্রাণ সঞ্চার করে প্রতিনিয়ত। এ জন্যই হয়তো জাফলং প্রকৃতির কন্যা। প্রকৃতির এই রূপ দেখলে ওপার থেকেও দেখার ইচ্ছা জাগে। মনে হয়, ডাউকির ওই ঝুলন্ত ব্রিজ থেকে যদি দেখা যেত।

আমি প্রকৃতিপ্রেমী। সোনালি সূর্যের আলোয় এই বাংলাদেশ দেখার প্রবল ইচ্ছা আমার। বাতাসের স্বচ্ছতা পাওয়া যায় যেখানে, সেখান থেকে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা হয় না। মনে হয়, এখানেই যদি থাকতে পারতাম বহু বছর, বহুক্ষণ, বহু সময়। তবুও ফিরে আসতে হয়। ফিরতে ফিরতে যোগ হয় আরও কিছু স্মৃতি। এই স্মৃতিগুলোই আমার সঙ্গী। সিলেট ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও আমার জীবনের অংশ। যা আমার মনে চিরসবুজ হয়ে থাকবে।
*লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়