ঘুরতে যেতে পারেন মহেশখালীর আদিনাথে

‘যদি সুন্দর একটা মুখ পাইতাম,
মহেশখালীর পানের খিলি তারে বানায় খাওয়াইতাম’

চট্টগ্রামের সুমিষ্ট কণ্ঠের শিল্পী শেফালী ঘোষ নেই। কিন্তু তাঁর এই গানের মধ্যে বেঁচে আছে মহেশখালীর নাম। তিনি যেমন মহেশখালীর পানের গুণ গেয়েছেন, তেমনি সৌন্দর্যে মহেশখালী কোনো অংশে কম নয়। বরং সৌন্দর্যের মহেশখালী অনেক বেশি এগিয়ে।

পরিবার নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে গেলে আপনি মহেশখালী দ্বীপ ভ্রমণ করতে পারেন। সেখানে আপনি একের মধ্যে অনেকগুলো বিষয় উপভোগ করতে পারবেন। যাঁরা সাগরপথে ট্রলার বা স্পিডবোটে চড়ে কোথাও যাননি, তাঁদের জন্য এটা হবে সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য। স্পিডবোটে বা ট্রলারে চড়ে বাঁকখালী চ্যানেল পার হওয়ার সময়টা দারুণ। সকালবেলা দূরে রোদ আর নদীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে। সুবিশাল পাহাড় আর অপরূপ দৃশ্যের এই দ্বীপ।

চ্যানেলের দুই দিকে রয়েছে মনোরম দৃশ্য, যা আপনাকে মুহূর্তেই একটা নতুন জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আপনি যখন মহেশখালী দ্বীপে পৌঁছাবেন, তখন আপনার কাছে মনে হবে আপনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমিতে বিচরণ করছেন। যেখানে রয়েছে জল, বৃক্ষ ও মৃত্তিকার অপূর্ব মেলবন্ধন। জীবনের হাজারো ব্যস্ততায় একটুখানি ভ্রমণের সুযোগ যেন সঞ্জীবনী শক্তি এনে দেয়। তাই ছুটি মিললেই একাকী বা দল বেঁধে হোক, সময়টাকে কাজে লাগাতে চাইলে সপরিবারে ঘুরে আসুন মহেশখালী।

চারদিকে সাগরবেষ্টিত মহেশখালী দ্বীপের অন্যতম দর্শনীয় স্থান আদিনাথ মন্দির। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮৮ ফুট উঁচু মৈনাক পাহাড়ের চূঁড়ায় আদিনাথ মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ১০.৮৭ মিটার, প্রস্থ ৮.৬২ মিটার, উচ্চতা ৫.৯৩ মিটার। পাহাড়ের ঢাল কেটে বানানো ৬৯টি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় মন্দিরে।

এ মন্দিরের পাশেই কক্সবাজার জেলা পরিষদ কর্তৃক আদিনাথ জেটি সম্প্রতি নির্মিত হওয়ায় পর্যটকদের এখানে আসা আরও সহজ হয়েছে। আদিনাথ মন্দিরের পাদদেশে রাখাইন সম্প্রদায়ের একটি পাড়া ও ঠাকুরতলা বৌদ্ধবিহার নামে একটি বিহার রয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদাররা বৌদ্ধবিহারটিতে অগ্নিসংযোগ করে। তাদের নির্বিচার গোলাবর্ষণে পাঁচজন নিরীহ রাখাইন শহীদ হন। পাকিস্তানিদের নির্মম তাণ্ডবলীলার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এখনো ওই বৌদ্ধবিহারে শ্বেতপাথরের গলাকাটা কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি কালের নীরব সাক্ষী হিসেবে রয়েছে। আদিনাথ মন্দিরে আগত পর্যটকদের জন্য অস্থায়ীভাবে রাখাইন রমণীরা তাঁদের নির্মিত কাপড়, চাদর বিক্রি করার জন্য পসরা সাজিয়ে রাখেন।

পূজা-অর্চনা

প্রতিদিনই নিয়ম মোতাবেক আদিনাথ, অষ্টভুজা, ভৈরব ও রাধা গোবিন্দের মন্দিরে একই সময়ে পূজা-অর্চনা হয়ে থাকে। এছাড়া প্রতিবছর ফাল্গুনের শিব চতুদ৴শী তিথিতে পূজা-অর্চনা ও পক্ষকালব্যাপী মেলা হয়। এ সময় পুণ্য সঞ্চয় ও মনস্কামনা পূরণে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত তীর্থযাত্রীদের পদচারণে মন্দির প্রাঙ্গণ মুখর থাকে। মন্দিরে বিরল প্রজাতির একটি পারিজাত ফুলগাছ রয়েছে। ভক্তরা প্রতিনিয়ত মনস্কামনা পূরণে মানত করে গাছে সুতা বেঁধে রেখে যান এবং কামনা পূর্ণ হলে সুতা খুলে পূজা অর্পণ করেন। মূল মন্দিরের পেছনের দিকে দুটি পুকুর রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৮০ ফুট উচ্চতায় পুকুর দুটির অবস্থান হলেও এর জল কখনো শুকায় না।

মন্দিরের ব্যবস্থাপনা

মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত বুকলেট থেকে জানা যায়, নবাব আলীবর্দি খান দেওয়ান ব্রজ কিশোর লাল কানুনগোর প্রতিনিধি দেওয়ান কালিচরণের ৯ বছরের কিশোর শরৎচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে এই দ্বীপে আসেন এবং দ্বীপটি ক্রয় করেন। পরবর্তী সময়ে শরৎচন্দ্র নাগা সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে এসে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর জমিদারির সব সম্পত্তি ১৮৭৬ সালে শ্রীশ্রী আদিনাথ মন্দিরের নামে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে উইল করে দেন। আদিনাথ দ্বৈত ব্যবস্থাপনা পুরি অ্যাক্ট অনুযায়ী মোহন্ত শাসনে ছিল। পরবর্তী সময়ে মোহন্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে ১৯১১ সাল থেকে এর ব্যবস্থাপনা সীতাকুণ্ড স্রাইন কমিটির অধীনে ন্যস্ত রয়েছে।

কীভাবে যাবেন

কক্সবাজার জেলার কস্তুরী ঘাট অথবা ৬ নম্বর ঘাট এলাকা থেকে ট্রলার ও স্পিডবোটে মহেশখালী যাওয়া যায়। ট্রলারে প্রায় ১ ঘণ্টা ও স্পিডবোটে প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে। স্পিডবোট থেকে নেমে মহেশখালী জেটিঘাট থেকে ব্যাটারচালিত টমটম বা ইজিবাইকে করে যেতে হবে মহেশখালীর প্রধান আকর্ষণ আদিনাথ মন্দির। চাইলে আপনি হেঁটেও যেতে পারেন। এখানে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি বৌদ্ধবিহার রয়েছে। বিখ্যাত আদিনাথ মন্দির আর বৌদ্ধবিহার ঘুরে দেখে আপনার মন প্রশান্তিতে ভরে যাবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রলার ও স্পিডবোট পাওয়া যায়। মন্দিরে তীর্থযাত্রীদের জন্য থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া মহেশখালীতে মোটামুটি মানের থাকার হোটেল আছে। তবে একটু উন্নত পরিবেশে থাকতে চাইলে কক্সবাজার অথবা চকরিয়াতে থাকা যেতে পারেন।