ঘুরে এলাম সাগরকন্যা

দিনটি ছিল বুধবার। ২০২২ সালের ২ মার্চ। সকাল থেকেই উত্তেজনা আর হৃদয়ের কম্পন যেন থামছেই না। সাগরকন্যাখ্যত কুয়াকাটায় যাব। দীর্ঘসময় করোনা মহামারির স্তব্ধতা ভেঙে যেন একপশলা বৃষ্টি নামল সব ভ্রমণপিপাসুর হৃদয়ে।

আমরা ছিলাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপের পুরো ইউনিট। ভ্রমণের দুদিন আগেই আজাদ ভাই (ইউনিট কাউন্সিল সভাপতি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপ) জানিয়েছেন বেলা তিনটায় ক্যাম্পাস থেকে যাত্রা শুরু। কিন্তু পরে জানতে পারলাম কোনো সমস্যার কারণে যাত্রা শুরু হবে রাতে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় গেলাম রোভার ডেনে। একি অবস্থা সবার! সবাই উচ্ছসিত। খুশির জোয়ার বইছে রোভার ডেনে। এদিকে অপেক্ষমাণ মন যেন ছুটছে সমুদ্রের পানে। বাস ছাড়ার আগ মুহূর্তেই যেন সেলফি তোলার মহড়া শুরু হয়েছিল সবার। অবশেষে সব প্রস্তুতি শেষ করে রওনা দিলাম রাত আটটায়।

বাসে উঠেই যেন মনে হলো বাসের গতির সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব কমছে বহুল প্রতীক্ষিত সেই সাগরকন্যার।

মাগুরা পৌঁছালাম রাত ১০টায়। সেখানে আমরা রাতের খাবার খেলাম। খাবার শেষে আবার রওনা হলাম কুয়াকাটার উদ্দেশে। একটু পরই স্কাউট সংগীত দিয়ে আজাদ ভাই শুরু করলেন আমাদের চলন্ত বাসের সাংস্কৃতিক পর্ব। শিক্ষা সফরের লটারি বিক্রির কাজ পেলাম। সবার কাছে লটারি বিক্রি করলেও সালেহ স্যার (সম্পাদক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপ) ও মিরা আপু (সিনিয়র রোভারমেট) যেন পাত্তাই দিলেন না আমার মতো হকারকে। তবে বেশি ভালো লেগেছে হকার সেজে সবার কাছে লটারি বিক্রি করা। মধ্যরাতে সবাই যখন ঘুমে মগ্ন, তখন মুসা ভাই (ইউনিট কাউন্সিল সাধারণ সম্পাদক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপ) ও আমি চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করায় ব্যস্ত।

বৃহস্পতিবার। ভোররাত চারটায় পৌঁছালাম কুয়াকাটায়। বাস থেকে নামতেই দেখি সবার উৎসুক নয়নজোড়া যেন সকালের সূর্যোদয় ও বেলা শেষে সূর্যাস্তের মোহে ছলছল করছে। হোটেলে উঠলাম। ফ্রেশ হতে হতেই চলে এল আমাদের বহনকারী কয়েকটি ভাড়া বাইক।

রওনা করলাম সূর্যোদয় দেখার উদ্দেশ্যে। সমুদ্রের তীর ঘেষে বালুর ওপর দিয়ে বাইক রাইডিং ছিল যেমন ভয়ংকর, ঠিক ততটাই রোমাঞ্চকর। মোতালেব একসময় তো বলেই দিল ‘আমার ভয় করছে’। ওকে সাহস দিলাম।

সমুদ্রের তীরঘেষা ঝাউবন, ছোট বাঁধ ও রাশি রাশি বালু পেরিয়ে পৌঁছালাম গঙ্গামতির চরে।

কেউ অপেক্ষা করছে সূয্যি মামার, কেউ–বা আবার সমুদ্রের স্মৃতি রাখতে ছবি তোলায় ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পরই দেখা মিলল সবার আগ্রহের সূর্যের। যেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে এক লাল রক্তিমার আবির্ভাব। অপরূপ সূর্যরশ্মি যেন ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হয়ে ছিটকে পড়ছে সবার শরীরের ওপর। বিভিন্ন জেলা থেকে ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনাও ছিল চোখে পড়ার মতো। এরপর যাত্রা রাখাইনপল্লি, বৌদ্ধনাথ মন্দির ও কুয়াকাটা ঐতিহাসিক ‘কুয়া’র উদ্দেশ্যে। সেখানে রাখাইনদের জীবনব্যবস্থা ও তাদের কথা বলার ভাষার ভিন্নতা এই প্রথম দেখেছিলাম। দেখতে দেখতে নাশতা করার সময় হলো। চলে এলাম হোটেলে।

তখন দুপুর, কড়া রোদ। সমুদ্রে এসে এত জলরাশি আর ঢেউয়ের মাঝে গোসল না করলে যেন ভ্রমণই বৃথা।

তীরে গিয়ে আমরা স্কাউট মোটোর বাস্তব রূপ দিতে সমুদ্রের তীর পরিচ্ছন্নসেবা দিই। তারপর শুরু ফুটবল খেলা। কড়া রোদেও সুভাসিত বাতাস মনকে প্রফুল্ল করছিল। নেচে উঠেছিলাম, যখন আমার দল বিজয়ী হয়।

অতঃপর সবাই পরপর সমুদ্রে নেমে পড়ে গোসলের উদ্দেশ্যে। আমিও। সমুদ্রে ঢেউ এসে খেলা করতে লাগল শরীরে। কিছুক্ষণ পরপরই জেলিফিশ ভেসে উঠতে লাগল। লবণাক্তের স্বাদও পেলাম। বেশি উচ্ছ্বাসে তো রুহুল ঢেউয়ের প্রকোপে তার চশমাই হারিয়ে ফেলে।

বিকেলের দৃশ্যে সমুদ্রের তীর ঘেষে লাল কাঁকড়া ও ঝিনুকের ছড়াছড়ি। কেউ লাল কাঁকড়া ধরছে, আবার মিরা আপু, শ্যামলী আপু, ইতি ও রত্না ঝিনুক কুড়াতে ব্যস্ত। আজাদ ভাই, ওয়ালিউল্লাহ ভাই, স্যারসহ তীরে দাঁড়িয়ে সমুদ্র উপভোগ করছেন।

লাল কাঁকড়া অভয়ারণ্য, লেবু বন, শুঁটকির চরসহ পর্যটনকেন্দ্রগুলো যেন এক একটা পার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার আদর্শ জায়গা।

কিছুক্ষণ পরই সূর্য অস্ত যাওয়ার পালা। অধীর অপেক্ষায় পর্যটকেরা। সূর্য যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে। সূর্যের রক্তিম আভায় যেন সমুদ্রের বিশাল জলরাশি রক্তাক্ত। এই সূর্যাস্ত ছিল এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

ফেরার পথে সারি সারি সামুদ্রিক মাছ ও কাঁকড়ার দোকান। কুয়াকাটায় এসেছি, কাঁকড়া খাব না, তা কি করে হয়! কেউ টুনা মাছ, কেউ কাঁকড়া ফ্রাই খেল। দুটোর স্বাদ যেন এখনো লেগে আছে সবার মুখে।

রাত আটটা। কেনাকাটায় ব্যস্ত সবাই। কেউ আচার, কেউ উপহারসামগ্রী। তুহিন তো হেড মাসাজার কিনে বেজায় খুশি। আমি, রুহুল ও মোতালেব গেলাম সমুদ্রে। চারপাশের নিস্তব্ধতার মাঝে রাতের সমুদ্রের গর্জনে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।

পরদিন শুক্রবার। সকালে নাশতা করে রওনা দিলাম ষাট গম্বুজ মসজিদের উদ্দেশ্যে। ফেরার সময় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, খান জাহান আলির মাজার, বাগেরহাট জাদুঘর ও ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ ঘুরে দেখলাম। নাম ষাট গম্বুজ হলেও এই মসজিদের গম্বুজ হিসাব করে দেখলাম গম্বুজ সংখ্যা ৭৭। মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। নান্দনিক ও ঐতিহাসিক স্থানে গিয়ে সেই ১৫ শ শতাব্দীর খান জাহান আলির সময়ে হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। দর্শনার্থীরা কেউ ছবি তুলছে, কেউবা নামাজ আদায় করছে। তবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সারি সারি পলাশ ফুলের দৃশ্যটায় মন আটকে গেছে।

সারা দিনের ভ্রমণ শেষ করে যাত্রা শুরু করলাম ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। তখন মনে পড়ছিল হেমন্ত মুখার্জির সেই গান ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’।

সমুদ্র পানে মন ছুটছিল বারবার, কিন্তু কী আর করার? আবার ফেরার সুযোগ হলে রাতের স্তব্ধতা ও ঢেউয়ের গর্জনের কাছে গিয়ে শোনাব আমার সব পূর্ণতা-অপূর্ণতার গল্প।

লেখক: আশিকুর রহমান, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়