অনন্য পর্যটনকেন্দ্র নেত্রকোনার দুর্গাপুর
সুজলা-সুফলা, শস্য–শ্যামলা অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এ বাংলাদেশ। স্বাধীনতা লাভের পর ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে আমাদের এ দেশ, যেখানে রয়েছে শত শত নদী, অসংখ্য নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও পাহাড়-পর্বতের সমাহার। আজকের লেখাটি যেহেতু দুর্গাপুরকে কেন্দ্র করে, তাই শুধু এ জায়গাকেই আঁকড়ে ধরে লিখব।
বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে আমাদের ভূপ্রকৃতি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত: ১. সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি, ২. প্লাইস্টোসিনকালের সোপানগুলো এবং ৩. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়গুলো। আনুমানিক প্রায় ৭৫ মিলিয়ন বছর আগে বাংলার বুকে যে পাহাড় ও টিলা গড়ে উঠেছিল, সেগুলোকে আজ টারশিয়ারি যুগের পাহাড় বলে। বর্তমানে ওই সময়ের পাহাড়গুলোর দেখা মেলে কেবল দেশের দুটি অঞ্চলে: এক. উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল (ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট), দুই. দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল (বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম)। ভৌগোলিক পরিসংখ্যান বলে, আমাদের দেশের মোট আয়তনের ১২ শতাংশ এলাকা দখল করে আছে এসব উঁচুনিচু পাহাড়। যে পাহাড়গুলোকে ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুসারে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক. টিপসুরমা (সবচেয়ে উঁচু ও খাড়া), দুই. ডুপিটিলা (মাঝারি উঁচু ও খাড়া) ও তিন. ডিহিং (সবচেয়ে নিচু টিলা)। সম্প্রতি বন্ধুরা মিলে ডিহিং শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এমন পাহাড় ভ্রমণ করে এসেছি, যেগুলোকে অনেকে টিলা নামে চেনে। বলছি নেত্রকোনার দুর্গাপুর অঞ্চলে অবস্থিত দেশের একমাত্র টারশিয়ারি যুগের সাদা মাটির পাহাড়ের কথা, যা পর্যটকদের কাছে বেশ নজরকাড়া ও বহুল সমাদৃত স্থান।
নেত্রকোনা সদর থেকে ৪৫ কিলোমিটার উত্তরে এ পাহাড়ি এলাকা। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সোমেশ্বরী নদীকে আঁকড়ে ধরে গড়ে উঠেছে এই ছোট্ট জনপদ—দুর্গাপুর। এ জনপদের তিনটি এলাকা পর্যটকদের কাছে বেশ প্রসিদ্ধ—বিজয়পুর, বিরিশিরি ও রানীখং। ভারত থেকে আসা নদী সোমেশ্বরী প্রসিদ্ধ এ তিনটি এলাকাকে বিভক্ত করেছে। নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত বিরিশিরি আর উত্তরে অবস্থিত রানীখং, বিজয়পুর। ১৯৭৭ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে বিরিশিরিতে দেশের প্রথম স্বায়ত্তশাসিত উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি গড়ে তোলে। যে একাডেমিতে গারো, হাজং উপজাতির পাশাপাশি দূরদূরান্ত থেকে অন্য উপজাতিরাও বিভিন্ন সময়ের অনুষ্ঠানে আসে, যেখানে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি উপস্থাপন করে। ফলে দর্শনার্থীরা অতি সহজে বুঝতে পারেন ওই এলাকার উপজাতিদের সংস্কৃতি, সামাজিকতা ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ।
তারপর রয়েছে রানীখং এলাকা। স্থানীয় লোকজন থেকে জানা যায়, এই এলাকায় ‘খং-রানী’ নামে এক রাক্ষস বাস করত। আর এ রাক্ষসকে তখনকার বসবাসরত গারো আদিবাসীরা হত্যা করে এ এলাকায় শান্তি স্থাপন করে এবং এলাকাটির নাম হয়ে ওঠে রানীখং। যে এলাকায় ১৯১০ সালে গড়ে উঠেছিল একটি গির্জা, যা এখনো পরিদৃশ্যমান। বিজয়পুরের বিজিবি ক্যাম্পে যাওয়ার পথে হাতের ডানে গির্জাটি চোখে পড়ে। এ ছাড়া রানীখং এলাকায় রয়েছে কয়েকটি খণ্ডিত টিলা। স্থানীয় মানুষের ভাষায় এ জায়গার নাম ‘কমলাবাগান’ (এখন কোনো অস্তিত্ব নেই)। কারণ হিসেবে স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে জানতে পারি, ২০০৮ সালে এ এলাকার সাংসদ ছিলেন মোশতাক আহমেদ। সে সময়ে তিনি উল্লিখিত স্থানটিতে কমলার বিশাল এক বাগান করেছিলেন। এ জন্য আজও অনেকে স্থানটিকে কমলাবাগান বলে ডাকে। কমলাবাগান থেকে আর একটু উত্তরে গেলেই বাংলাদেশ-ভারত সীমানার জিরো পয়েন্ট। যদিও স্থানটিতে অনুমতি ছাড়া যাওয়া নিষেধ, তবে ভুলক্রমে চলে গিয়েছিলাম, আর দেখেছিলাম প্রকৃতির আসল রূপ। এককথায় মনোমুগ্ধকর জায়গা। দুই সীমানায় দুই পাহাড়, মাঝখানে বয়ে চলছে সোমেশ্বরী নদী। দৃশ্যটি দেখে মনে হয়েছিল, পাষাণ পাহাড়ের বুক চিরে সোমেশ্বরী বেরিয়ে এসে বাংলার বুকে নীরবে বয়ে চলছে।
তারপর রানীখং থেকে সোজা বিজয়পুর। এখানে দেখেছিলাম দুর্গাপুরের আসল রহস্য, কেন এত দর্শনার্থীরা এখানে ঘুরতে আসেন। রহস্য হলো নীল পানির হ্রদ আর তার বুক চিরে জেগে ওঠা সাদা রঙের কয়েকটি পাহাড়, মানে চীনা মাটির পাহাড়, যা বাংলাদেশে অদ্বিতীয়। বিশাল উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে স্বচ্ছ নীল, নীলচে ও হালকা সবুজ রঙের পানির ছোট ছোট হ্রদ ও তার পাশে জেগে ওঠা সাদা মাটির পাহাড় এবং পাশে থাকা গ্রামীণ অপরূপ দৃশ্য, যা অতি সহজে মানব হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার তোলে এবং ক্ষণিকের জন্য মানুষকে ভুলিয়ে দেয় দুনিয়ায় তার শত ব্যস্ততা, হতাশা আর দুশ্চিন্তার গ্লানি। তবে শুধু তা–ই নয়, নীল পানির হ্রদের পাশে পাহাড়ের ঢালে জন্মায় মনমাতানো কাশফুল। নীল পানির হ্রদ, সাদা কাশফুল আর সবুজ ছোট ছোট আগাছা দিয়ে সাদা পাহাড় ঘেরা—এগুলো একসঙ্গে দেখে মনে হয়, যেন কোনো এক সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছে, যার পরনে নীল শাড়ি, খোঁপায় কাশফুল আর মুখে চিরল দাঁতের প্রাণখোলা হাসি। মানে মানুষ তার প্রেমে পড়বেই।
তবে শুধু সাদা পাহাড় বললে ভুল হবে। কেননা, সেখানে দেখা মেলে লাল, লালচে, ধূসর ও গোলাপি রঙের পাহাড়েরও। সত্যি বলতে, বিভিন্ন রঙের পাথর দিয়ে গড়ে ওঠা এই পাহাড়গুলো বেশ মনোমুগ্ধকর। দৈর্ঘ্য ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার আর প্রস্থ ৬০০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে এ নৈসর্গিক এলাকা। চীনা মাটি মূলত আমাদের সিরামিকশিল্পের কাজে ব্যবহৃত হয়। খনিজ সম্পদ ব্যুরোর ১৯৫৭ সালের তথ্যানুযায়ী, এ এলাকায় চিনামাটির মজুত প্রায় ২৪ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন, যা দিয়ে বাংলাদেশের ৩০০ বছরের চাহিদা পূরণ হবে বলে ধারণা করা হয়।
উল্লেখ্য, সাধারণত হেমন্তকালে কিংবা শরতের শেষের দিকে এই নৈসর্গিক স্থান ভ্রমণ করা সবচেয়ে সুবিধাজনক। ঢাকা থেকে রাত ১১টা ৫০ মিনিটে মোহনগঞ্জগামী হাওর এক্সপ্রেস ট্রেন রয়েছে, যা নেত্রকোনা সদরে আসে ভোর ৫টায়, ভাড়া ১৬৫ টাকা।
সদরে আসার পর স্টেশন থেকে ৪৫ টাকা ভাড়া দিয়ে কংস নদের ফেরিঘাট পর্যন্ত আসতে হবে। এরপর আবার অটোরিকশায় একদম বিরিশিরি ব্রিজের নিচে, ভাড়া ৪০ টাকা। সেখান থেকে সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে শিবগঞ্জ বাজার থেকে সোজা উত্তরে রানীখং, বিজয়পুর, বিজিবি ক্যাম্প, জিরো পয়েন্ট, পাহাড়ের চূড়ায় সেই ঐতিহাসিক গির্জা, কমলাবাগান, নীল পানির হ্রদ ও সাদা-লাল-গোলাপি রঙের পাহাড়, যা পরিদর্শন করতে সারা দিনের জন্য একটি অটোরিকশা রিজার্ভ করা বেশ সুবিধাজনক, ভাড়া পড়বে ৫৫০-৬০০ টাকা। তবে মোটরবাইক দিয়েও যাওয়া যায়।
পাহাড় ভ্রমণের ইচ্ছা হলে আসতে পারেন নেত্রকোনার দুর্গাপুর অঞ্চলে। জায়গাটিতে এসে যেমন ইতিহাস জানতে পারবেন, তেমনি আনন্দও উপভোগ করতে পারবেন। এ ছাড়া পাবেন পাহাড়গুলোর নিকটে গড়ে তোলা ছোট দোকানগুলোতে উপজাতিদের হাতে তৈরি বাঁশ-বেতের পণ্য এবং ভারত থেকে আসা প্রসাধনসামগ্রী। সুতরাং আসুন, পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে এসে সঠিক ইতিহাস নিজ চোখে দেখি।
*লেখক: জসীম কিবরিয়া, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়