চল বন্ধু হারিয়ে যায়, চায়ের দেশে
সকাল হলেই ব্যস্ত হতে হয় বইয়ের পাতায়, শ্রেণিকক্ষের একঘেয়ে পাঠে। বিশ্বকে জানার জন্যই পড়ালেখা, কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হতো এই একঘেয়েমি আর কত! ঠিক সেই সময়েই এলো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি ও ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষকদের কাছ থেকে এক আনন্দের খবর। শ্রেণিকক্ষের দেয়াল ডিঙিয়ে, বইয়ের পাতার গণ্ডি ছাপিয়ে এবার যাব দূরের শহর, চায়ের দেশ সিলেটে। খবর শোনামাত্রই সবার মুখে হাসি, পুরোনো স্বপ্নে নতুন রং।
স্বপ্নবাজেরা গত জুলাই মাসের এক সন্ধ্যা হতেই কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে জড়ো হতে থাকেন। আনন্দ, আড্ডা ও প্রস্তুতির মধ্যেই কেটে যায় সময়। রাত আনুমানিক নয়টা, চায়ের দেশের উদ্দেশে আমাদের যাত্রা। এই যাত্রায় সফরসঙ্গী ছিলেন প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক খন্দকার মো. মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক শেখ মোহাম্মদ সায়েম, সহকারী অধ্যাপক মো. ফখরুল হাসান ও প্রভাষক মো. বায়েজিদ হোসেন।
পাখিদের ঘুম ভাঙার আগেই আমরা পৌঁছে যাই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি)। সেখানে নাশতা ও বিশ্রামের আয়োজন ছিল। তারপর ঘুরে দেখা হয় পুরো সিকৃবি ক্যাম্পাস। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল শহীদ মিনার ও অনুষদের নান্দনিক স্থাপনাগুলো। নাশতা শেষ হতেই বেরিয়ে পড়ি মালনীছড়া চা-বাগানের উদ্দেশে। তখন প্রকৃতি ছিল তার নান্দনিক জৌলুশে। গাঢ় নীল আকাশ, তুলার মতো মেঘ আর ঝলমলে রোদে সাজানো সকাল। আমাদের যাত্রার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চা–শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে চা উৎপাদনে বজ্রপাতের প্রভাব বিশ্লেষণ করা। এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি আমরা তাঁদের জীবনের নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়েও আলোচনা করি। যেমন পরিবারের সদস্যসংখ্যা, উপার্জনক্ষম সদস্য ও আয়ের উৎস। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার পর তাঁদের কঠিন জীবনযাত্রার এক বাস্তব চিত্র আমাদের সামনে আসে। এটি স্পষ্ট যে বর্তমান বাজার অর্থনীতিতে তাঁদের আয় খুবই কম, যার ফলে এই আর্থিক দুর্বলতা তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক প্রবণতাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়টি হলো নারী শ্রমিকেরা তুলনামূলকভাবে কম বেতন পেয়ে থাকেন, যা মজুরির ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়। এ ছাড়া বাগান এলাকার রাস্তা ধরে হাঁটার সময় আমরা লক্ষ করি, রাস্তাগুলো ছিল অত্যন্ত নোংরা এবং সেখানে সাপ ও অন্য পোকামাকড়ের উপদ্রব ছিল। তবে চা–শ্রমিকেরা তা উপেক্ষা করেই প্রতিদিন তাঁদের কাজ করেন। চা-বাগানে আমরা চা-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের কাজ, জীবন ও স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানি। তাঁদের হাসি, পরিশ্রম ও সরলতা আমাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে।
পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে আচমকা বৃষ্টির শুরু। কালো ঘন মেঘ আর দমকা হাওয়ার সঙ্গে বাস ছুটে চলেছিল সাদাপাথরের উদ্দেশে। বৃষ্টিভেজা পাহাড়, সাদাপাথর আর সব মিলিয়ে দৃশ্যটা ছিল যেন জীবন্ত এক কবিতা। মনে হচ্ছিল, এ যেন নদী, পাহাড় ও মেঘের মিলনমেলা। সূয্যিমামা একটু আড়াল হতেই আমরা ফিরে যাই সিকৃবি ক্যাম্পাসে। এরপর সিকৃবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আলিমুল ইসলাম আমাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং নতুন অডিটরিয়ামটি ঘুরে দেখান। তাঁর অনুপ্রেরণামূলক কথায় সফরটি আরও অর্থবহ হয়ে ওঠে। রাত নয়টায় আমরা বাকৃবির উদ্দেশে রওনা হই।
আমাদের এই সফরটি কেবল কোনো সাধারণ ভ্রমণ ছিল না, এটি ছিল চা–শ্রমিকদের জীবন যুদ্ধের উপলব্ধি। শ্রেণিকক্ষের তাত্ত্বিক জ্ঞানকে সরাসরি মাঠে প্রয়োগ করে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জন করাই ছিল এই সফরের মূল উদ্দেশ্যে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আভিজাত্য এবং মালনীছড়া চা–বাগান পরিদর্শন এই লক্ষ্য পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক দিনের এই শিক্ষা সফর আমাদের জীবনের মধুর স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা ভবিষ্যতে বারবার ফিরে ডাকবে চায়ের দেশের ভ্রমণের সেই একদিনের গল্পে।
*লেখক: তাহমিনা সোনিয়া, শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]