এলডোরাডো-৬০-এর পাহাড় ভ্রমণ
ভালো থাকার জন্য শরীর ও মনের সুস্থ থাকা চাই। কারণ, শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক সুনিবিড়। শরীর সুস্থ থাকলেই মন সুস্থ থাকবে। অন্যদিকে মন অসুস্থ হলে শরীর অসুস্থ থাকাই স্বাভাবিক। শরীর সুস্থ থাকার জন্য যেমন ভেজালমুক্ত খাদ্য থাকা জরুরি, তেমনি মনের সুস্থতার জন্য প্রকৃতির গাঢ় পরিবেশের সংস্পর্শে থাকা চাই। দুর্ভাগ্য, টিউশনি ও পড়াশোনার চাপে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীর প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব হয় না। ফলে সহজেই একঘেয়েমি এবং ক্লান্তি চলে আসে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা বছর ক্লাস-পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত।
অবশ্য ভেটেরিনারি অনুষদে ক্লাস ও অ্যাসাইনমেন্টের চাপ অন্যান্য অনুষদের থেকে একটু বেশি। বর্তমানে আমাদের সঙ্গে ভেটেরিনারি অনুষদে ২০২০-২১ সেশনে ১৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। যাঁদের মধ্যে চারজন শিক্ষার্থী নেপালের ও ১০ জন মালয়েশিয়ার। ব্যবহারিক ক্লাসের সুবিধার্থে ২০০ শিক্ষার্থীকে ১০টি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি গ্রুপের মধ্যে রয়েছে আলাদা ধরনের বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা। শিক্ষার্থীরা গ্রুপের বিভিন্ন ধরনের নাম দিয়েছেন। তেমনি আমাদের গ্রুপের নাম হচ্ছে এলডোরাডো-৬০; যা বাকৃবি ভেটেরিনারি অনুষদের ৬০তম বেঞ্চের শিক্ষার্থীদের ইঙ্গিত করে।
বাকৃবিতে শুক্র ও শনিবার ক্লাস বন্ধ থাকার সুবিধার্থে গ্রুপের সবার সিদ্ধান্ত, একঘেয়েমি দূর করতে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এমন কোথাও ঘুরতে যাওয়ার। অবশেষে গ্রুপে আলোচনা শেষে শেরপুর জেলার মধুটিলা ইকোপার্ক ও গজনী অবকাশে ঘুরতে যাওয়ার জন্য সবাই রাজি হয়। সেই অনুযায়ী নানা ধরনের পরিকল্পনা সাজায় এবং সিদ্ধান্ত হয়, শনিবারে যাবে। ঘড়ির কাঁটায় যখন সাড়ে ছয়টা, তখন নিজ হল থেকে বের হয়ে শেরপুরে যাওয়ার জন্য রওনা হই। সময়মতো সাতটার বাস পেয়েও যায়। বাসের সহকারীদের সঙ্গে দর-কষাকষি শেষে বাসে উঠে পড়ি। প্রায় দেড় ঘণ্টা বাস চলার পর আমরা সবাই শেরপুর জেলায় পৌঁছায়। পরে শহরের হোটেলে নাশতা করে দুটি আট সিটের সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করি। তাঁদের সঙ্গে দর-কষাকষি করে চুক্তি করা হয় সারা দিন পাহাড় ঘোরার।
শেরপুর শহর থেকে ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পর প্রথম মধুটিলা ইকোপার্কে যাই। সেখানকার উঁচু উঁচু পাহাড়, প্রকৃতির শান্ত-মনোরম পরিবেশ এবং গাছে গাছে বাহারি রঙের ফুল কৃষ্ণচূড়া, সোনালু আমাদের মুগ্ধ করে। ঘণ্টাখানেকের জন্য নেটওয়ার্কের বাইরে প্রকৃতির নিবিড় পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাই। গ্রুপের সবাই উল্লসিত হয় বনের ভেতরে প্রবেশ করতেই। হঠাৎ একজন বন কর্মকর্তা এসে সতর্ক করলেন বনের ভেতরে না যেতে। তিনি জানালেন, ‘বন্য হাতির দল গতকাল এখানে ঘোরাফেরা করেছে।’ প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরক্ষণই মনের ভেতর দ্বিগুণ উৎসাহ জাগে বন্য হাতি দেখার। আমরা বন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জেনে নিই এখনকার সব চেয়ে উঁচু পাহাড় কোন দিকে। তাঁর নির্দেশমতো আমরা সেই পাহাড়ের দিকে যেতে থাকি। পথে বন্য হাতির মলমূত্র আমাদের পাহাড়ের ওঠার উৎসাহকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। পাহাড়টা বেশ উঁচু ছিল। অনেক কষ্টে পাহাড়ের শিখরে পৌঁছাই। পাহাড়ের চূড়ায় উঠতেই চারদিকে ঘন বন আর সবুজ বৃক্ষের সঙ্গে দমকা হাওয়া আমাদের সব ক্লান্তি একমুহূর্তে দূর করে নতুন করে উৎসাহের জন্ম দেয়।
আমরা পাহাড়ের চূড়ায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করি এবং বন্য হাতির পাল দেখার জন্য উঁকি দিতে থাকি। সেবার ভাগ্য সহায় না থাকায়, অবশেষে আমরা বন্য হাতির পাল না দেখেই পাহাড় থেকে নেমে আসি। পাহাড় থেকে পরের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রওনা হতেই কয়েকজন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁদের নানা সংগ্রামের কথা আমাদের বিমোহিত করে। বিজয় বাম বলেন, পাহাড়ে বসবাসের সময় মাঝেমধ্যেই বন্য হাতির আক্রমণের শিকার হতে হয়। ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়। পাহাড়ে কেউ সুস্থ হলে তাদের হাসপাতালে নিতে নিতেই মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে।
এর আগেই আমরা প্রায় ছোট-বড় ১০টি পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিলাম। পরবর্তী গন্তব্য মধুটিলা ইকোপার্ক। সেখান থেকে প্রায় আধ ঘণ্টা পর গজনী অবকাশকেন্দ্র পৌঁছাই। সেখানকার চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের প্রাণবন্ত করে। দুই পাহাড়ের মাঝে ঝুলন্ত সেতু, লেকের ওপর ভাসমান ড্রামের ব্রিজ, কেব্ল গাড়িতে ভ্রমণ বেশ মজার ছিল। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সংগ্রামের কথা এবং গাঢ় সবুজ পাহাড়ের উপভোগ শেষে সবাই খাওয়াদাওয়া ও বিশ্রামের জন্য বন্ধু রিয়াজের বাসায় যাই। তার চমৎকার খাবারের আয়োজন ও বাহারি খাবার বেশ সুস্বাদু ছিল। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে সবার সঙ্গে একটু গল্প মেতে উঠি। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার জন্য রাত আটটার বাসে উঠি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা নিরাপদে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাই। সর্বশেষ কবি মহাদেব সাহার কবিতা দিয়ে শেষ করতে চাই, ‘স্মৃতি ছাড়া কোনো নোটবুক নাই, টুকে রাখি কোথা ইট বা খোয়াই...’।
*লেখক: মো. রিয়াজ হোসাইন, শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়