রেমা-কালেঙ্গায় ভ্রমণ
দীর্ঘদিন সিলেটে ছিলাম, তখন থেকেই রেমা-কালেংগা ছিল অতি পরিচিত নাম। যাব যাব করে যাওয়া হয়নি! এখন ঢাকায় থাকি পেশাগত কারণে। সুযোগ কম, তাই একটা আক্ষেপ রয়েই গিয়েছিল। সেই আক্ষেপ মেটাতে যখন সুযোগ এল, হেলায় মিস করতে চাইনি! হঠাৎ একদিন বন্ধু জিকু ফোন দিয়ে বললো, যাবে নাকি! আমি দুই ইঞ্চি এগিয়ে উত্তর দিলাম, কবে যাচ্ছ, দিনক্ষণ জানাও আমাকে।
জিকু সমস্ত পরিকল্পনা দিলো আর এ দিকে আমি আরও দুজন সফরসঙ্গী যোগাড় করলাম! ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ঢাকার বাইরে শর্ট কোনো ট্যুরে পাঁচজন সফরসঙ্গী হলো সবচেয়ে উত্তম, যদি মুভমেন্টের বড় একটা অংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশাতে হয়! এতে খরচ কিছুটা কমে। তবে আমরা এ যাত্রায় পেলাম চারজন। মন্দের ভালো! তবে যেটা বেশি ভালো সেটা হলো, এ চারজনের প্রত্যেকই ট্যুরের ব্যাপারের খুব আগ্রহী আর চ্যালেঞ্জ নিতে পারদর্শী!
আমরা যাত্রা শুরু করলাম টঙ্গী থেকে। বাস ছিল রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে, জ্যাম পেরিয়ে বাস আমাদের কাউন্টারে আসতে আসতে অতিরিক্ত সময় নিল ৩০ মিনিট, জ্যামের শহর হিসেবে তাই খুব সহজেই ক্ষমা করে দেয়া যায়! বাস যাবে মূলত নরসিংদী হয়ে! এই রাস্তা আমার অনেক চেনা! টঙ্গী পেরোলেই জানালা দিয়ে যে বাতাস আমাকে ছোঁয়, আমি সেই বাতাসে পাই বিশুদ্ধতার অনুভব! যত সামনে এগোবে, ততোই আপনি নিজেকে আরও বিশুদ্ধভাবে অনুভব করবেন!
আগে থেকেই জানতাম, বাস থেকে নেমে যেতে হবে শায়েস্তাগঞ্জে ভোরের বেশ খানিক আগে! আমাদের ধারণা করা সময়েই নেমে গেলাম! তারপর পাশেই একটা সাধারণ হোটেলে নাস্তা সেরে নিলাম! তারপর দিনের আলোর অপেক্ষা! ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর সূর্য যখন জানান দিলেন, তিনি ঘুম ভেঙ্গে হামি দিয়েছেন, তখন আমরা একটা সিএনজি নিয়ে রওনা দিলাম! আগের রাতে বেশ ভালো বৃষ্টি হয়েছিল! তাই পিচ ভেজা রাস্তায় দুই পাশের সাজানো সবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি! বেশ খানিকটা যাওয়ার পর আমরা ভাঙ্গা রাস্তার সামনে পড়লাম, মাঝেসাঝে সিএনজি থেকে নামতে হয়েছিল ধাক্কা দেওয়ার জন্য। সেই সময় আমরা হেইয়াহো হেইয়াহো করতে করতে ভালোই কাজ করেছিলাম! বুঝলাম, বাকিটা পথ এভাবেই পাড়ি দিয়ে যেতে হবে আমাদের গন্তব্যে!
আমাদের লক্ষ্য হল হবিগঞ্জ চুনারুঘাটের কালেঙ্গা অংশ দিয়ে অভয়ারণ্যে প্রবেশ করা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আমাদের অভ্যর্থনা দিয়েছিল! সারা আকাশে কালচে মেঘ! আর নতুন করে যোগ দিয়েছিল আমাদের গাইড! একজোড়া গামবুট আর বড় একটা ছাতা নিয়ে তিনি হাজির। শুরু হল আমাদের বনভ্রমণ।
রেমা-কালেঙ্গা হলো আমাদের দেশে সুন্দরবনের পরে সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমি। এটি সংরক্ষিত আর বন্য প্রাণীর জন্য দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়ারণ্য! হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত এই বন ভারতের ত্রিপুরার সীমান্তের নিকট অবস্থিত। মূলত কালেঙ্গা, রেমা আর ছনবাড়ি—এই তিন অভয়ারণ্য নিয়ে এই বনভূমি গঠিত। তবে ভ্রমণ পিয়াসুদের নিকট রেমা-কালেঙ্গা বন নামে বেশি পরিচিত।
যাঁরা বোটানি এবং জুলোজি নিয়ে পড়ালেখা করেছেন, তাঁদের জন্য এ বনভূমি স্পেশাল! কারণ, এ বনভূমিতে আছে ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা-লতাগুল্ম! আর এদের সঙ্গেই উঠাবসা আছে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ আর ৭ প্রজাতির উভচর প্রাণী। আছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি! যেমন প্যাঁচা, টিয়া, পাতি ময়না, লালমাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুলি, কালো মথুরা, ভীমরাজ, মাছরাঙ্গা, ঈগল, চিল প্রভৃতি।
এদের মধ্যে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বুলবুলি, প্যাঁচা এবং টিয়াপাখি দেখার। শুনেছি কয়েক প্রজাতির বানর আছে! তবে আমার সামনে এসে বেশ দাপট দেখিয়েছিল সিংহরূপ বানর। মুখপোড়া হনুমানকেও দেখেছি বেশ চুপচাপভাবে। বনের মধ্যে নিয়ম হলো যতখানি পারা যায়, নীরব থাকা। মনে রাখতে হবে বনটা মূলত আমাদের রাজত্বের মধ্যে পড়ে না। তাই এখানে আমাদের অহংকার দেখানো শোভা পায় না! তবে অবশ্যই মনযোগী হয়ে হাঁটতে হবে আপনাকে। কারণ, হুটহাট কাঁটাযুক্ত গাছ সামনে আসতে পারে! সামনে পড়তে পারে, বিশাল জাল ছড়িয়ে অপেক্ষায় থাকা বড় আকারের রঙিন মাকড়সা! অল্প কিছুদূর হাঁটার পরেই আপনাকে আলিঙ্গন করতে পারে জোঁক! যার উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, এ ট্যুরে আমাকে সর্বোমোট ১১টা জোক ধরেছিল! এর মধ্যে ধারণা করছি তিনটা ছিল টাইগার জোঁক! তাই মনযোগী হয়ে না হাঁটলে বিড়ম্বনায় পড়তে পারেন।
বনের মধ্যেই দারুণভাবে আবিষ্কার করলাম, বনরক্ষীদের জন্য বানানো চারপাশ খোলা কাঠ দিয়ে বানানো ঘর! এ ঘরে বনরক্ষীরা রাতে থেকে বন পাহারা দেন। সুযোগ পেয়ে দিনে দুপুরে এ ঘরে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। এখানেই দেখা মিলল এশিয়ার সবচেয়ে বড় কাঠবিড়ালির, তাও আবার একসঙ্গে কয়েকটা! এ গাছ থেকে ওই গাছে লাফিয়ে বা হেঁটে বেড়িয়ে আমাদের সময়কে দারুণ উপভোগ্য করে তুলল। যদিও শুনেছি এখানে নাকি আরও দেখা মিলে মেছোবাঘ, দেশি বন্য শুকর, উল্লুক, সজারু, মায়া হরিণ, গন্ধগোকুল, বেজি ইত্যাদি। তবে তাদের মনে হয় শিডিউল খুব কড়া ছিল, তাই দেখা মেলেনি আমাদের সঙ্গে। তবে বনের মধ্যে যে ১৮ প্রজাতির সাপের দেখা মিলেনি, তাতে আমি খুব খুশি!
অর্কিডে ভরা বন
যে অর্কিড ফুল বা ফুলের গাছ আমরা এত দাম দিয়ে কিনি, সেই অর্কিড এই বনের মধ্যে প্রচুর দেখেছি! ছিল টগর ফুলসমেত গাছ! এই ছিল পুরো বন ভ্রমণের সার সংক্ষেপ! তবে বেশিই ভাল লাগল, যখন বন থেকে বেড়িয়ে পেলাম চা–বাগান! তাও আবার শ্রীমঙ্গলের চা–বাগান! অর্থাৎ হবিগঞ্জের চুনারুঘাট দিয়ে প্রবেশ করে বের হলাম শ্রীমঙ্গলের চা–বাগান দিয়ে। এর মধ্যে কেটে গেলো চার–পাঁচ ঘণ্টা হাঁটাহাঁটিতে! এ সময়ের মধ্যে উপভোগ করেছিলাম ঘন বনের মধ্যে বৃষ্টিসহ ব্যাপক ঝড়! প্রতিটা গাছের ডালপালা আনন্দে নেচেছে, দিয়েছে সেই ঝড়ে শোঁ শোঁ শব্দ করে। অনেক দিন স্মৃতির কুঠরিতে থাকবে সেই মুহুর্তগুলো! আর ভেজা বনে নিচে পড়ে থাকা পচা পাতার একটা আলাদা গন্ধ আছে! হাঁটাচলার মধ্যেই উপভোগ করেছি গন্ধ! উঁচু–নিচু টিলা আর ঘন গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা এই বনে আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন অন্যভাবে।
আমি গিয়েছিলাম মূলত বর্ষাকালে! তবে শীতকালে আলাদা ফ্লেভার পাওয়া যাবে! ইচ্ছা আছে শীতকালে আরেকবার যাওয়ার! আমাদের ভ্রমণ শেষ হয়েছিলও বিকেলের দিকেই। তাই বলা যায়, এক দিনের মধ্যে সুন্দরভাবে কাভার করতে পারবেন গোটা এলাকা।
আপনারা যাঁরা যেতে চান, অবশ্যই স্থানীয় গাইড নিয়ে যাবেন। আগে থেকেই গাইড ঠিক করে নিতে হবে আপনাকে। জোঁক থেকে নিরাপদ থাকতে লবণ নিতে পারেন। ড্রাই ফুড খুব কার্যকর আর অবশ্যই খাবার পানি নিয়ে যাবেন মিনিমাম এক লিটার করে জনপ্রতি।
যেভাবে যাবেন
প্রথমে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে আসতে হবে। সেখানে সিএনজি বা টমটমে করে শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজে আসবেন জনপ্রতি ১০ টাকায়। এখান থেকে জনপ্রতি ২০ টাকায় সিএনজি করে আসবেন চুনারুঘাট মধ্যবাজারে। তারপর আবার সিএনজি করে কালেঙ্গা বাজারে আসবেন। চাইলে এই সমস্ত পথ এক সিএনজিতে আসতে পারেন সেই শায়েস্তাগঞ্জ থেকে রিজার্ভ নিয়ে (এভাবেই আমরা এসেছি)। সেক্ষেত্রে ভাড়া পড়তে পারে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
আবার আমরা যেদিক দিয়ে বের হলাম, অর্থাৎ শ্রীমঙ্গল দিয়ে। চাইলে সেই শ্রীমঙ্গল দিয়েও আসতে উল্টোপথে প্রবেশ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে জিপ গাড়ি বা সিএনজি করে সহজেই রেমা–কালেঙ্গা বনে পৌঁছাতে পারবেন।