আগ্রার লালদুর্গের স্মৃতি
যমুনা ব্রিজ স্টেশন পার হতেই যমুনা নদী। সাদা লোহার ব্রিজ গলে বামদিকে দেখা যাচ্ছে দূরের তাজমহল। প্রেমযমুনা পেরিয়েই চোখ ছানাবড়া। লাল লাল সুউচ্চ দেওয়াল। What is that? বলতেই পাশের যাত্রীর উত্তর-আগ্রা ফোর্ট। ওহ্, দারুণ! ট্রেন থেকেই! মাঝে সরু পিচের রাস্তা। ওপারে লাল কেল্লা (আগ্রা ফোর্ট) এপারে রেললাইন ও আগ্রা ফোর্টস্টেশন। ওয়েস্ট বেঙ্গল ও বিহার-আসাম থেকে আসা রেলগুলো এখানে থামে। একটু দূরেই আরেক স্টেশন। আগ্রা ক্যান্ট। বাজার বা মেইন শহর ক্যান্টের কাছাকাছি। ভারতের আন্তপ্রাদেশিক ট্রেনগুলো যেকোনো একটি স্টেশনে থামে। খুব কমই ব্যতিক্রম আছে।
আগ্রা ফোর্টস্টেশনে নামলাম সকাল ১০টার দিকে। ট্রেন মাঝপথে লেট করায় প্রায় ৩৬ ঘণ্টার জার্নি শেষে শিয়ালদহ থেকে কলকাতা-আজমির এক্সপ্রেসে। নেমেই লাল লাল প্রাচীরঘেরা দুর্গের পাশেই আধা ভ্রাম্যমাণ দোকান। নাশতা করে পায়ে হেঁটে পায়চারী।
যমুনা নদী, ব্রিজ, লালকেল্লার চারদিক। এরপর অটোতে আগ্রা দুর্গের পাশ দিয়ে তাজমহল। তাজমহল দেখে আগ্রা ফোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা বেলা ৩টায়। প্রায় দুই কিলোমিটার অটোতে এসে পৌঁছলাম আগ্রা ফোর্টে। তাজমহল রোডের দিকের মানসিংহ গেটে। আগে গেটটির নাম ছিল ‘আকবর দরজা’। এ গেটের নিকটবর্তী বেশির ভাগ নান্দনিক স্থাপনা। উঁচু প্রাচীর আর বিরাট পরিখার সমাহারে সুরক্ষিত দুর্গ তৈরি করেছিলেন আকবর। এটাই মুঘলদের বসতবাড়ি। তাজমহলে শুয়ে থাকা মমতাজ ও সম্রাট শাহজাহানসহ অনেকের বসতবাড়ি। ট্রেন থেকে তাজমহল-ফোর্ট ইউ আকৃতির। মোঘলদের অনবদ্য স্থাপনা। ১৯৮২ সালে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।
কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আচ্ছাদিত আগ্রা ফোর্ট। লাল ইটে মোড়ানো পথ বেয়ে লাল উঁচু প্রাচীরে ঘেরা প্রাসাদে প্রবেশ করলাম। মূল গেট পেরিয়ে ঢালু পথ।
অপ্রতিরোধ্য ও অজেয় এক দুর্গ। শত্রুপক্ষের কেউ ঢুকে পড়লেও রক্ষে নেই। প্রাচীরের গায়ে ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে গরম তেল ও গরম পানি ঢেলে দেওয়া হতো। পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া সমতল ও ঢালু পথ মাড়িয়ে যেত। ফলে দুর্গ আর জয় করা সম্ভব ছিল না তখনকার শত্রুদের। তারপর আবারও গেট। প্রথমেই জাহাঙ্গীর মহল। এরপর যোধাবাঈয়ের মহল। তারপর দেওয়ান-ই-আম। এটাই হচ্ছে দরবার হল। এখানকার সিংহাসনে বসে শাহজান দেশ পরিচালনা করতেন ও প্রজাদের সঙ্গে মিলিত হতেন।
নয়নাভিরাম ৪০ পিলারের উঁচু দরবার। পাশেই ব্যক্তিগত দেখা–সাক্ষাতের জন্য নির্দিষ্ট ছিল দেওয়ান-ই-খাস। বহুমূল্য ময়ূর সিংহাসন ছিল এখানেই। পরে যেটি লুট হয় নাদির শাহের হাতে। তেহখানায় যাওয়ার সিঁড়ি রয়েছে কাছেই। প্রবল গ্রীষ্মে মাটির তলার ঠান্ডা ঘরে আশ্রয় নিত রাজপরিবার। যমুনা নদীর স্রোত বয়ে যেত নিচ দিয়ে। বেগমদের রাজগোসলখানা হচ্ছে শিশমহল। আগ্রা ফোর্টের আকর্ষণের কেন্দ্রে রয়েছে এর শিশমহল। এখানে অসাধারণ ওয়াটার ইঞ্জিয়ারিং করা হয়েছে। পানি গরম করার জন্য ল্যাম্প¤ব্যবহার করা হতো এখানে। মার্বেলের চেয়েও দামি আয়না দিয়ে খচিত শিশমহলের দেয়াল। অজস্র কাচের প্রতিবিম্বে নান্দনিক দৃশ্য সৃষ্টি হতো শিশমহলে। সম্রাটের বিশ্রামঘরটির নাম খাসমহল। নারীদের নামাজ পড়ার মসজিদ রয়েছে এখানে। নাগিনা মসজিদ। পুরষদের জন্য মোতি মসজিদ। সবই রাজকীয় আভিজাত্য আর কারুকার্যে মোড়া।
আগ্রা ফোর্টেই বন্দী ছিলেন শাহজাহান, সন্তান আওরঙ্গজেব বন্দী করে রেখেছিলেন তাঁকে। নিজ প্রাসাদ থেকে তিনি দেখতে পেতেন যমুনার ওপারে তাজমহলকে। স্মৃতিচারণ করতেন প্রিয় সহধর্মিণী মমতাজকে। যোধাবাঈ মহল থেকেও তাজকে দেখা যায়। যমুনা তীরে নির্মিত ফোর্টটির নির্মাণকৈশলে দক্ষতার ছাপ আছে। আছে চাতুর্যতাও। বাইরে থেকে বোঝা যায় না এর প্রবেশপথ কোনটি।
সম্রাট শাহজাহান পছন্দ করতেন সাদা। তাই স্থাপনা নির্মাণে শ্বেতপাথর ব্যবহার করতেন বেশি। সম্রাজ্ঞী যোধাবাঈ ভবনটির নির্মাতা আকবর। এটি লাল। আকবর লাল রং পছন্দ করতেন বলে জানা যায়। আগ্রাফোর্টের নিচ দিয়ে যমুনা নদীর পানি প্রবাহিত হতো। ঘরকে ঠান্ডা রাখতেই এ নির্মাণপদ্ধতি নেওয়া হয়েছে। আগ্রা ফোর্ট নির্মাণশৈলীতে ভারতীয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ রয়েছে। আগ্রা ফোর্টের দেয়ালে দেয়ালে কারুকাজ। আবাসনের পাশাপাশি রাজ পরিবারের বিনোদন, গান-নাচের আসর, রাজকার্যের জন্য দরবার হলে কী নেই এখানে।
সময়সূচি
আগ্রা ফোর্টে প্রবেশ করতে চারটি গেট আছে। যমুনা নদীর দিকেও একটি। তবে মানসিংহ গেট প্রতিদিনই খোলা থাকে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খোলা থাকে। তাজমহমল শুক্রবার বন্ধ থাকলেও ফোর্ট খোলা থাকে। বরং এদিন প্রবেশ ফিও কম।
প্রবেশ ফি
সার্কভুক্ত ও বিমস্টেকভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য ভারতীয় ৩০ রুপি। অন্য দেশের নাগরিকদের জন্য ভারতীয় ২৫০ রুপি। তবে উভয় ক্ষেত্রে আগ্রা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ভারতীয় ৫০০ রুপি চাঁদা দিতে হয়। শুধু শুক্রবারে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৫০০ রুপি ফ্রি। তবে একবার চার্জ দিলে তাজমহল, আকবর টম্ব, ফতেপুর সিক্রি, সেকেন্দ্রা, ইতিমাদি উদ্দৌলা দেখতে শুধু সেখানকার প্রবেশ ফি লাগবে। তাজমহলের এন্ট্রি টিকিট দেখিয়ে আগ্রা ফোর্টে ঢুকলে ৩০ রুপি খরচ হবে, তা না হলে আলাদা করে ৫০০ রুপি খরচ করে টিকিট কাটতে হবে। ১৫ বছর পর্যন্ত শিশুদের প্রবেশ করতে কোনো ফি লাগে না।
কীভাবে যাবেন
প্রথমেই দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাস বা ট্রেনে যশোর-বেনাপোল বা দর্শনা নেমে ভারতীয় সীমান্ত পার হতে হবে। এরপর বনগাঁ বা গেদে রেলস্টেশন থেকে কম-বেশি তিন ঘণ্টায় কলকাতার শিয়ালদহ। এরপর আগ্রা যাওয়ার ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলুন। কলকাতার শিয়ালদহ থেকে ট্রেন যাচ্ছে আগ্রা। কলকাতা-আজমির এক্সপ্রেস, অনন্যা এক্সপ্রেস ও উদয়ন আভা তুফান এক্সপ্রেস। হাওড়া-যোধপুর বিকানির এক্সপ্রেস হাওড়া থেকে যাচ্ছে। যেকোনো ট্রেনে গিয়ে আগ্রা ফোর্টস্টেশনে নেমে পড়তে হবে। এরপর অটোতে আগ্রার যেকোনো স্থাপনা ও দর্শনীয় জিনিস দেখতে পারবেন। বিমান ঢাকা থেকে দিল্লি গিয়েও সেখানে যেতে পারবেন যে কেউ।
কোথায় থাকবেন
আগ্রা ব্যস্ততম শহর। কারণ, এটা পর্যটন শহর। দিল্লি-জয়পুর-আগা পর্যটন ট্রায়াক্স বলা হয়। ফলে থাকা ও খাওয়ার জন্য কোনো চিন্তা নেই। সব বাজেটের সরকারি-বেসরকারি হোটেল আছে আগ্রায়। ভাড়া ৬০০ টাকা থেকে শুরু।