রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে একদিন

শিলাইদহ ‘রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি’ বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অন্যতম একটি পর্যটনকেন্দ্র।
ছবি: লেখক

শিলাইদহ ‘রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি’ বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অন্যতম একটি পর্যটনকেন্দ্র। পদ্মা নদীর তীরবর্তী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এ কুঠিবাড়িটি কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নে অবস্থিত। দীর্ঘদিন ক্লাস, টিউটোরিয়াল, অ্যাসাইনমেন্ট, ইনকোর্স, কোর্স পরীক্ষা দিতে দিতে যখন হাঁপিয়ে উঠছিলাম, ঠিক তখনই কুষ্টিয়া শহরে থাকা প্রিয় বন্ধুবর ফারুকের সঙ্গে চলে গেলাম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ি দেখতে।

সফরের দিনটি ছিল গত বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর)। আমি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের শেখপাড়া বাজারের একটা আবাসিক এলাকায় থাকতাম। ওই দিন সকাল ৯টায় কুষ্টিয়া শহরের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া ক্যাম্পাসের বাসটিতে তাড়াতাড়ি এসে উঠে পড়লাম। দীর্ঘক্ষণ বাসে দাঁড়িয়ে থাকার পর কোনো সিট ফাঁকা পেলাম না। বন্ধের দিন বিধায় ক্যাম্পাসের সবাই একটু শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বের হয়েছেন। তাই আর বাসের সিটে বসা হলো না। পুরোটা পথ দাঁড়িয়ে গেলাম। তবে মনে মনে তখন অনেক আনন্দ কাজ করছিল, আজকে বিশ্বকবির রেখে যাওয়া প্রাচীন বাড়িটি ঘুরতে যাব। ৪০ মিনিটের দীর্ঘ যাত্রার পর বাস থেকে নেমে পড়ি কুষ্টিয়ার চৌড়হাসের স্টেশনের মাথায়।

সেখান থেকে অটোরিকশায় ১৫ টাকা ভাড়া দিয়ে চলে গেলাম লাহিনী বাজারে। যেখানে বন্ধু ফারুক থাকে। সেখানে কিছুক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করলাম। সে আসার পর শুরু হলো রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির উদ্দেশে যাওয়ার আসল সফর। লাহিনী থেকে এবার সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চলে গেলাম কুষ্টিয়ার আরেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আলাউদ্দিন নগরে। সেখান থেকে ২০ টাকা ভাড়ায় এবার ভ্যানে করে চলে যাই বহুল কাঙ্ক্ষিত রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে।

কুঠিবাড়িতে প্রবেশের আগে দুজন মিলে দেখে নিলাম সেখানে দেয়ালে টাঙানো থাকা একটা প্রদর্শনী চার্ট। চার্টে টিকিটের মূল্যসহ আরও কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া ছিল। চার্ট পড়ে বুঝতে পারলাম ভেতরে ঢুকতে অবশ্যই কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে। ২০ টাকা দিয়ে আমি দুটি প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করে নিই। ভেতরে প্রবেশ করে অত্যন্ত অবাক হলাম সুন্দর মনোরম নয়নজুড়ানো স্থাপনা দেখে। ধীরে ধীরে দুজন সামনে হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর এবার চোখে পড়ল চারটা সুন্দর ভবন। যেগুলো কবি ঠাকুরের লিখিত কাব্যগ্রন্থ ও উপন্যাসের নামে নামকরণকৃত। গীতাঞ্জলি ভবনের সামনে গিয়ে দুজন ক্যামেরাবন্দী হয়ে গেলাম।

এবার আরেকটু সামনে হাঁটতে শুরু করলাম তারপর পৌঁছে গেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত রবিঠাকুরের কুঠিবাড়ির ভেতরে। একে একে দেখতে শুরু করলাম কবিগুরুর অসংখ্য স্মৃতিবিজড়িত প্রাচীন ছবির অ্যালবাম। যে অ্যালবামগুলো সমৃদ্ধ করা হয়েছে বিশ্বকবির বিভিন্ন ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে। তাঁর মধ্যে কয়েকটি হলো—১. তাঁর ঘুমানোর খাট, ২. খাজনা আদায়ের চেয়ার–টেবিল, ৩. পদ্মা নদীতে চলাচল করা কাঠের নৌকা, ৪. হাত পালকি, ৫. আট ও ষোলো বেহারার পালকি, ৬. হাতের লেখা ইংরেজি চিঠিপত্রসহ আরও অসংখ্য কবিতা–গানের খণ্ডিত অংশের দেয়ালিকা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িটি বিভিন্ন বাগান পুকুরসহ প্রায় ১৬ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। কুঠিবাড়িটিতে ছোট–বড় ১৫টি কক্ষ রয়েছে। নিচতলা ও দোতলার উন্মুক্ত ব্যালকনিগুলো রাণীগঞ্জ টালি দিয়ে তৈরি ঢালু ছাদ দ্বারা আংশিক আচ্ছাদিত। নিচতলার ওপরের মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে ত্রিকোণ প্রান্তবিশিষ্ট একটি ঢালু ছাদ। দোতলার ওপরের পিরামিড আকৃতির ছাদ ভবনটিকে আরও বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে।

১৮০৭ সালে রামলোচন ঠাকুরের উইলসূত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর এ জমিদারির মালিক হন। রবিঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে প্রথম শিলাইদহে আসেন ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে। তাঁর নাগরিক কবি থেকে মাটি ও মানুষের কবি হয়ে ওঠার পেছনে এই কুঠিবাড়ি তথা শিলাইদহ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ বাড়িতে বসেই তিনি ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারি পরিচালনা করেন। এখানেই বসে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত সব কাব্যগ্রন্থ, গান, নাটক ও উপন্যাস। তার মধ্যে ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘চৈতালি’, ‘গীতাঞ্জলি’ অন্যতম।

ঐতিহাসিক এই কুঠিবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। এ নদীতে কবিগুরু নৌকায় চলাচল করতেন। তিনি তাঁর যৌবনকালের উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন এখানে। রবীন্দ্রপ্রেমীরা এখানে এসে কবির স্পর্শ পেতে চেষ্টা করেন। বাড়িটি পর্যটন আকর্ষণের পাশাপাশি রবীন্দ্রচর্চার জন্য গবেষকগণের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আমরা দুই বন্ধু বাড়িটার চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম আর সুন্দর দৃশ্যগুলো মুঠোফোনে ক্যামেরাবন্দী করলাম। তারপর নিজেদের মধ্যে চিন্তা ও গবেষণা করতে করতে কুঠিবাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আর এর মধ্য দিয়ে আমাদের বহুল স্মৃতিবিজড়িত রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির সফরটি খুব আনন্দঘন পরিবেশে শেষ হলো।

**লেখক : মো. ইয়াছিন আরাফাত, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া

**নাগরিক সংবাদে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারবেন যে কেউ। ঠিকানা [email protected]