সাদা পাথরের দেশে

সাদা পাথর দেখতে পর্যটকেরা
ছবি: লেখক

সারা বছর তুমুল কর্মব্যস্ততায় কাটে। নানা রকম ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শারীরিক ও মানসিক ধকলেই কাটে শহুরে জীবন। একটু চনমনে হতে চায় মন। সময় বের করা কঠিন কাজ। তারপরও এবার আর কোনো ছাড় দিলাম না। যা হওয়ার হোক। বেড়াতে যাবই। বেছে নিলাম সিলেটকে।

সিলেটকে বেছে নেওয়ার কারণ দুটি। এক, যাতায়াতের ব্যবস্থা ভালো। দুই, শহর থেকে পর্যটনের জায়গাগুলো কাছেই। গাড়ি নিয়ে দিনের মধ্যে বেশ কিছু জায়গা দেখা যাবে। যেটা আমাদের মতো কম ছুটি যাঁদের, তাঁদের জন্য সুবিধাজনক। সাদা পাথর, চা–বাগান, পাহাড় ও ঝরনার দেশ সিলেট। আমাদের দেশে ট্রেনের সময়মতো আসেও না, যায়ও না—এমন একটা ধারণা আছে। এবারও তার ব্যতিক্রম পেলাম না। প্রায় ৪০ মিনিট পর উত্তরায় ট্রেন এল।

হুড়মুড়িয়ে উঠলাম। কেবিনে গিয়ে চোখ কপালে, সিটে অন্য লোক বসা। তাঁর কেবিনের টিকিট নেই। তবুও নানা যুক্তি। আপনারা নিচে বসেন, আমি ওপরের সিটে বসে যাই। কী আজব আবদার! হাসব না কাঁদব, ভেবে পেলাম না। মেয়েরা নিচে বসবেন, তিনি ওপরে ঘুমানোর সিটে যাবেন। তা–ও আবার তাঁর কোনো টিকিটই নেই। এক দফা তর্কবিতর্ক হলো। পরে সুবিধা করতে না পেরে পালালেন।

সিলেটের ভোলাগঞ্জে সাদা পাথর দেখতে ঢল নামে পর্যটকদের
ছবি: লেখক

ঝিক–ঝাক ট্রেন যাচ্ছে। পরিবার কখনো চিপস, কখনো নুডলস, কখনো কোমল পানীয় বের করছে। আর সবাই মজা করে খাচ্ছি। ট্রেনের লোক ও নানা খাবার নিয়ে আসছে। তা–ও একটু চেখে দেওয়া বাদ গেল না। ভ্রমণে নানা রকম খাবারের পসরা বসে। বিশেষ করে লঞ্চ, ট্রেনে তো কথাই নেই। তবে সতর্কতা হলো, খাবার খেয়ে সব হারানোর সুযোগ আছে বইকি। চা– বাগান, জমিতে হলুদ শর্ষের চোখ জুড়ানো উপস্থিতি, পাহাড়ের পাশ দিয়ে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে মিষ্টি রোদের লুকোচুরি। এ এক মুগ্ধকর পরিবেশ।

ট্রেনের কেবিনের ওপরের সিটে শোবার ব্যবস্থা আছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। ভাইয়ের মেয়ে তামিমা উঠতে গিয়ে চিৎকার জুড়ে দিল। প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। বলা বাহুল্য, ট্রেন যখন লাইন পরিবর্তন করে। তখন বেশ বড় রকমের ঝাঁকুনি লাগে। তবে শেষ অবধি সে উঠতে পেরেছিল। উঠে গলা ছেড়ে গাইল—চলো না ঘুরে আসি অজানাতে...। আমরাও তাঁর সঙ্গে গলা মিলালাম।

নচেৎ যে জমে না। খাওয়া, গল্প, আড্ডা, ছবি তোলা ইত্যাদি করতে করতে সিলেট চলে এলাম। রাত হয়ে গেছে। এদিন আর কোথাও যাওয়া হলো না। সরাসরি হোটেলে গেলাম। তবে এখানেও পেলাম বিপত্তির দেখা। হোটেলে ব্যাগ রেখে বাইরে খেয়ে এসে দেখলাম, রুমের দরজা খুলছে না। লক নষ্ট হয়ে গেছে। ঘণ্টাখানেক বসে থাকতে হলো। পরে ঠিক করা হলো, ভ্রমণে এমন টুকটাক বিপত্তি, ঝক্কি–ঝামেলায় আনন্দ আছে। এগুলো না হলে যেন জমে না। ভ্রমণটা সাদামাটা হয়ে যায়। সমৃদ্ধ হয় না। স্মৃতির ভান্ডার ভারী হয় না।

পরদিন সকালে ছুটলাম সাদা পাথর, ভোলাগঞ্জের উদ্দেশে। সিলেট শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। রাস্তা ভালোই। ভোলাগঞ্জ গিয়ে ৮০০ টাকা দিয়ে নৌকা (ইঞ্জিনচালিত) রিজার্ভ করা হলো। ছোট নৌকা, বেঞ্চ দিয়ে বসার ব্যবস্থা। নৌকায় ওঠার আগে ১০০ টাকায় একটি সানগ্লাস নিলাম। টুকটাক কেনাকাটার ব্যবস্থা আছে নৌকাঘাটে। আছে টয়লেটও। দুই পাশে বালু ও পানি খুব কম। কোথাও মাটি দেখা যায়। এরই মধ্য দিয়ে নৌকা চলছে। এই বুঝি নৌকা থেমেই গেল। এমন ভয়ও পাচ্ছিলাম।

সামনে পাহাড়, নিচে পানি, ওপরে খোলা আকাশ। এ পরিবেশে নৌকার একেবারে মাথায় গিয়ে ছবি তুলতে ভুল হলো না কারও। কেউ দুই হাত ওপরে উঁচিয়ে ছবি নিল। মুক্ত আকাশের দিকে ইঙ্গিত। হাত বাড়ালোই পানি, আমাদের কেউ আবার পানিতে হাত ভিজাল। এতেই কত আনন্দ। শহরের গুমোট ও যান্ত্রিক জীবনে এ পরিবেশ কোথায়? এই আনন্দ কোথায়? ইঞ্জিনচালিত হলেও নৌকার ইঞ্জিনে তেমন বিকট শব্দ নেই। যা আমাদের স্বস্তি দিচ্ছিল। অতি দূরে ওই পাহাড়। মনে হচ্ছিল, নৌকা ধীরে ধীরে পাহাড় ছুঁয়ে যাবে। যদিও পাহাড়গুলো আমাদের না। প্রতিবেশী দেশের।

কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকা ভিড়ল সাদা পাথরের কাছাকাছি। আমরা হেঁটে গেলাম খানিকটা। সাদা পাথরের ওপর দিয়ে ঝরনার স্বচ্ছ জল গড়িয়ে পড়ছে। সর্বোচ্চ হাঁটুসমান পানি। এত স্বচ্ছ পানি, ভাবাই যায় না। আমরা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। পানির মধ্যে নামার লোভ সামলানো গেল না একটুও। জলকেলি হলো বেশ কিছুক্ষণ।  সাদা পাথর যেমন পানির মধ্যে আছে, তেমনি ওপরেও।

ছবি: লেখক

এমন সুন্দর পরিবেশ যেন হৃদয়টা ছুঁয়ে গেল। শীতল এক অনুভুতির সন্ধান পেলাম। শীত যেন সব পালিয়ে গেল।  আমাদের আনন্দ–উচ্ছ্বসের কাছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে সাদা পাথরের ওপর দিয়ে পানির ছুটে চলা। তবে সীমান্তের কাছে না যাওয়াই ভালো। পাথরগুলো অগোছালো, কিছু আছে পিচ্ছিল, আবার কিছু আছে নড়বড়ে। তাই সতকর্তা কাম্য। নচেৎ পা মচকে আনন্দ বিষাদে রূপ নিতে পারে। সাদা পাথরের পাশে বসার ব্যবস্থা আছে।

বসে বসে এ সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে। পুরো শরীর ভিজাতে চাইলে কাপড় নিয়ে আসতে হবে। কাপড় পরিবর্তন করার ব্যবস্থা আছে। ছোট ছোট বাচ্চা গাইডের কাজ করে। চাইলে তাদের কাউকে সঙ্গে নিতে পারেন। সব খবরাখবর জানতে পারবেন। সকাল সকাল যাওয়া ভালো। পরে পর্যটকদের প্রচুর সমাগম হয়। যে নৌকা রিজার্ভ করবেন, তার চালকের মুঠোফোন নম্বর রাখবেন। পরে ফোন দিলে তিনি আপনাদের নিয়ে আসবেন।

টুকিটাকি তথ্য

সিলেট শহরে থেকেই এক দিনের মধ্যে সাদা পাথর ঘুরে দেখে আসা যাবে। পর্যাপ্ত শীতের কাপড় নিয়ে আসবেন। নৌকার ঘাটে টুকটাক কেনাকাটা, খাবারের ব্যবস্থা আছে। পরিষ্কার টয়লেট আছে, যেটা সাদা পাথরের ওখানে নেই। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাম্যান পাওয়া যাবে। প্রতিটি ছবি তিন টাকা। কথাবার্তা বলে আগে ঠিক করে নেবেন।

ছবি বাছাই করে এবং সব ছবি— দুভাবে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। কোমলপানীয়, চিপস ইত্যাদি শুকনো খাবার সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেন। ওখানে পাখির মাংস, হাঁসের মাংসসহ নানা রকম মুখরোচক খাবারের কথা বলা হবে। তবে কতটা মানসন্মত, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আাছে। সাদা পাথরের বিভিন্ন জায়গায় ময়লা ফেলার পাত্র আছে। তাই যেখানে–সেখানে ময়লা–আবর্জনা একদমই ফেলবেন না।

নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারবেন [email protected]