রাজশাহী টু কুয়াকাটা যেভাবে, যত আনন্দ

বহুদিনের ইচ্ছা, সমুদ্র অভিযানে যাওয়ার। বহুজনের বহু অভিমত কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটাকে ঘিরে। স্বচক্ষে না দেখলে প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। কথায় আছে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। এভাবে হুটহাট সিদ্ধান্তে সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা যাব তা ভাবনাতীত।

‘ইক্বরা এডুকেশন সেন্টার’, রাজশাহী এ ভ্রমণের আয়োজন করেন। ৬০–এর বেশি ডেলিগেট। খরচের একাংশও তাঁরা বহন করেন। ডেলিগেট প্রতি মাত্র ১৩০০ টাকার মধ্যেই যাতায়াত, নাশতা, হোটেল, খাবার খরচসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেন। এটাই সুযোগ, শত ব্যবস্তার মধ্যেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করি। বন্ধু সাকিবের মাধ্যমে এরশাদ আর আমি সফরের সঙ্গী হই।

১২ ফেব্রুয়ারী রাজশাহী মহানগর থেকে বিকেলের দিকে বাসে কুয়াকাটার দিকে রওনা বলে আমাদের জানানো হয়। সকাল সকাল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখি। বিকেল পাঁচটার দিকে বিনোদপুর গেট থাকতে বলা হয়। কিন্তু গাড়ি এল সন্ধ্যার কয়েক মিনিট আগে। বাসে উঠলাম, প্রত্যেক সদস্য অমায়িক। আমরা যাঁরা অতিথি হিসেবে ছিলাম, তাঁদের সেবার কমতি ছিল না। যারা কর্তৃপক্ষের ছিলেন, তারা অধিকাংশ সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

বাস চলতে লাগল। ভয় হচ্ছিল। তৃতীয় সারির জানালার পাশে বসলাম। এমনিতেই বাস জার্নি খুব কষ্টকর। বমি করতে করতে বেহাল বরাবরই। যদি এমনটা হয়, এই ভেবে বমিনাশক ট্যাবলেট নিয়ে রাখি। যাক তার দরকার হয় নি। গাড়িতেও বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। এর মতো নিরাপদ ও আরামদায়ক বাসযাত্রা আগে কখনো করি নি। তাতে একটানা ১০ ঘণ্টা করে। আকাশের তারা আর নগরের প্রজ্বলিত কুণ্ড দেখতে দেখতে কেমনে সময় যাচ্ছিল বুঝতেই পারি নি। যথা সময় নামাজ আর নাস্তা বিরতি ছিল। সেই সঙ্গে ভ্রমণের যে সিডিউল নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার কোনো হেরফের হয় নি। প্রতিটি বিষয় নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল বিন্যাসে আবদ্ধ। বেশ শিক্ষনীয় বিষয়।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক্কেবারে কোল ঘেঁষে বাস চলছে। প্রথম এই রোডে দক্ষিণ বঙ্গে যাওয়া। সব কিছুই নতুনত্বের ধাঁচ। সবাই প্রবল আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। বিশাল বিশাল চুল্লী, ইঞ্জিনিয়ারদের থাকার জন্য আধুনিক মানের সুউচ্চ অট্টালিকা। পুরো বিদ্যুৎকেন্দ্রে আলোর উদ্দামতা। পাশের পদ্মাবতী; জ্বলজ্বল করছে। লালন শাহ সেতু অতিক্রম করেছে কুষ্টিয়ায়। একটু পশ্চিমে হার্ডিঞ্জব্রিজ। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পারি নি।

বেশ আরামের ঘুম দিই। কীর্তনখোলা ব্রিজে হঠাৎ জেগে চোখ পড়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। লালচে সিরামিক ইটের সুন্দর নকশায় আলোকিত ক্যাম্পাস। আসা-যাওয়ার পথে হয়তো অনেক দর্শনীয় স্থান মিস করেছি। জার্নিটা দিনেও হতে পারব। আপাতত দুচোখ ভরে উপভোগ করতে পারতাম।

ভোর ৫.৪০ টার দিকে কাঙ্খিত স্থান কুয়াকাটা পৌঁছালাম। উঠলাম একটি আবাসিক হোটেলে। রুম বুকিং দেওয়াছিল তিনটি। কোনোরকমে ব্যাগ রাখার জায়গা পেয়েছিলাম। আজানের পরপরই বেরিয়ে পড়ি মসজিদের দিকে। নামাজ পড়ে সোজা চলে যাই বহুল আকাঙ্ক্ষিত কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট। হোটেল থেকে মাত্র চার মিনিটের পথ। তখন সাগরে ভাটা পড়েছে। নিস্তব্ধ, কোনো তেজ নেই। নদী না সাগর পার্থক্য করা বেশ কঠিন। শুধু মাছ ধরার ট্রলার ভাসছিল।

তখনো সূর্য ওঠেনি। মোটরসাইকেল আর ভ্যানওয়ালা মামারা ডাকাডাকি করছে, ‘আসেন মামারা আসেন, সূর্যোদয় পয়েন্ট যাবেন, সময় বেশি নাই, দেরি হলে দেখতে পারবেন না।’

যাতায়াত ১০০ টাকা, প্রায় ৫ কিমি পথ, বালুর বিচরণ। আরও বেশ কয়েকটি পয়েন্টের কথা বললেন, ঝাউবাগান, লাল কাঁকড়র দ্বীপ, লেবু বন, ফাতরার চর আরও। সব পয়েন্ট মোটরসাইকেল করে ঘুরিয়ে দেখাবেন দুজনের ১ হাজার ২০০ টাকা ফি আসবে জানালেন।

সফরসঙ্গীদের অনেকেই চললেন, যাঁদের পকেট গরম। বন্ধু এরশাদ আর আমি পণ করলাম, যতটুকু পারি হেঁটেই দেখব। যথারীতি হাঁটা শুরু করলাম। তখন সূর্য রক্তিমার আভা ছড়াচ্ছে। মেঘ আর কুয়াশায় জড়ানো। প্রায় দুই কিলোমিটার যেতেই দেখি ঝিনুকের বিস্তার। সংগ্রহ করতে লাগলাম বাচ্চাদের মতো অনেক সময় ধরে। আমাদের দেখাদেখি অনেকেই।

ঐ যে যারা সূর্যোদয় দেখতে গেলেন, কেউই নাকি স্পষ্ট দেখতে পারেন নি মেঘাচ্ছন্নতার জন্য। দুজন বেশ খুশি মনে বললাম, ‘বেশ ভালোই হয়েছে, টাকা বেঁচে গেল।’ আমরা কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান, ঝাউ বাগান, আমলকি বাগান ঘুরে দেখি আর ফটো তুলি।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আবারও সেই জিরো পয়েন্ট আসি। এরই মধ্যে পুরো সাগর পার লোকে লোকারণ্য। বেঞ্চের বিশাল সারি। শেষাবধি চোখ পড়ে না। সবাই উপভোগে মাতোয়ারা। সমস্ত চিন্তা অতীত রেখে যে যার মতো মেতেছে। যেন সবাই সুখী, কোনো কষ্ট নেই, শৈশবের বেভুল। হয়তো সবাই সাগরকন্যার কাছে ঝেড়ে-মুছে দিচ্ছে প্রত্যেকের নেতিবাচক নিজস্বতা। আমাদের সঙ্গীসাথিরা খেলাধুলায় মেতেছে। হাঁড়ি ভাঙা, স্ট্যাম্পে ঢিল ছোড়া, দৌড় প্রতিযোগিতা, ফটোসেশন, গোসল প্রভৃতি। বেশ উপভোগ্য।

জোয়ার শুরু হচ্ছে। চলে এলাম হোটেলে দুপুরের খাবারের জন্য। সামুদ্রিক মাছের রেসিপি। সাগরে এসে সামুদ্রিক মাছ না খেলে কী জমে? জমিয়ে খাওয়া হলো। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে যার যার মতো বেড়িয়ে পড়ি সৈকতসংলগ্ন মহিলা রাখাইন বাজার, বৌদ্ধ মন্দির, মিয়ানমার থেকে ভেসে আসা ২০১২ সালে উদ্ধারকৃত ছোট পালতোলা জাহাজ (ইত্যাদিতে দেখিয়েছিল) দেখতে এবং আরও অন্যান্য।

বাজারে হরেকরকমের পণ্য; চুড়ি, মালা, খোঁপা, কানের দুল, চাবিরতোড়া, নাম না জানা কত কী। অধিকাংশই সামুদ্রিক ঝিনুক, শামুক, শঙ্খ, মাছের কাঁটা দিয়ে তৈরি। কোনো মেয়ে তার প্রিয়জনের সঙ্গে এই বাজারে এলে হয়তো বেচারাকে ফতুর করেও তৃপ্তি পাবে না। প্রকাশ্যে বা মনে মনে বলেও থাকতে পারে যদি আরও কিছু কিনতে পারতাম!

আমি ছেলে হয়েও চোখ ফেরাতে না পারার দশা। কিনলাম প্রিয় জনদের জন্য একজোড়া শামুকের চুড়ি, শামুকের তিনটি মালা, ঝিনুকের চারটি খোঁপা, আর নিজের জন্য নিলাম ‘ঘুরে এলাম কুয়াকাটা’ লেখাসংবলিত কাচের স্লেট। ইচ্ছে ছিল কিনতেই থাকি। তার আর সাধ্য কই। পকেট যে প্রায়ই ফাঁকা। মূল উদ্দেশ্য এখনো বাকি।

মাগরিবের নামাজ পড়ে মাছের বাজার ঘুরে দেখি কী কী ফ্রাই খাওয়া যায় সাধ্যের মধ্যে। সাগরে যাব অথচ সামুদ্রিক প্রাণী খাব না, তা কি হয়। সে তো কবেকার ইচ্ছে। বহু দামাদামি করে কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি, অক্টোপাস, স্কুইড নিলাম। মোট ৩৫০ টাকা। আহ্! কী অমৃত।

সময় শেষ। সন্ধ্যা ছয়টায় হোটেল থেকে রিলিজ নেওয়ার পালা। আগেভাগেই বাসে উক্ত সিট দখলে নিলাম। অপেক্ষায় আছি, কখন বাস ছাড়বে আর রাজশাহী পৌঁছাব। এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। স্বপ্নে দেখি, কুয়াকাটা নিয়ে বেশ আক্ষেপ করে লিখতেছি—

হে সাগরকন্যা,

তোমারই তারিফে আসিয়াছিলাম, দূর-বহুদূর।

তুমি সাজিলে না, না উড়ালে শাড়ির ঝলকিত আঁচল ঐ।

লাল টিপটাও আড়ালে রাখিলে, নয়নে বিঁধলে না!

তুমি তেজোহীন, আমারে ছন্নছাড়া কেনই বা না করিলে?

তুমি কি অভিমানী, আমারে হেলিলে, এমন তো কথা না?

তোমারই আকাশ কি তব নীলে ভাসে না?

তবে কি পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্ররেই সাধিব?

ওরাও তোমারই ন্যায়, তবে বিশেষত্বে আলাদা।

কেন করিলে না মুগ্ধ আমারে? বৃথা এ ভ্রমণ।

এমন তো কথা না।

সকাল হয়ে গেছে। সাড়ে ছয়টা। ভাইয়েরা ডাকতেছিল ‘সবুজ, এরশাদ বিনোদপুর এসে গেছি।’

*লেখক: সবুজ আহমেদ, সমাজবিজ্ঞান, রাজশাহী বিশ্বিবদ্যালয়

**নাগরিক সংবাদ-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]