বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ: প্রচার ও প্রসারে বিশেষ পরিকল্পনা

সুন্দরবন
ফাইল ছবি

পর্যটনের সম্ভাবনাময় একটি দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। একটু নজর দিলে এ খাত থেকে প্রচুর আয় করা সম্ভব। এটিকে বলা হয় অদৃশ্য অর্থনৈতিক শক্তি। পর্যটন হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম আয়ের খাত। অনেক উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম আয়ের খাত হচ্ছে পর্যটন।

পর্যটনশিল্প অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য ‘লাইফ ব্লাড’ হিসেবে কাজ করে ওইসব দেশের অর্থনীতি ও সামাজিকব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। এ শিল্পের সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অনেক শিল্প নির্ভর করে। পর্যটন একটি বহুমাত্রিক ও শ্রমঘন শিল্প। সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারণশীল ও বৃহৎ বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড হিসেবে এ শিল্প বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় পর্যটন খাত থেকে।

পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর, যেমন পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, বিমানবন্দর ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতিবছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যেকোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি। আমাদের সম্ভাবনাও প্রচুর রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের জন্য অত্যন্ত অনুকূল।

বিদেশি পর্যটক যে দেশে যত বেশি, সে দেশের পর্যটন থেকে আয় ততই বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্স বা ইউরোপের দেশে বিদেশিদের আনাগোনা অনেক বেশি। তাই এসব দেশে পর্যটন থেকে আয়ের পরিমাণও বেশি। এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ডে পর্যটন খাত থেকে আয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণও কিন্তু বিদেশি পর্যটক। ভারত বা শ্রীলংকা থেকে আমাদের অঞ্চলে পর্যটন আয় বেশি। এর কারণ, তাদের পরিকল্পিত চিন্তাভাবনা।

ছোট রাষ্ট্রগুলো যেমন হংকং, সিঙ্গাপুর, ম্যাকাউ, মালদ্বীপ, ফিজি কিন্তু পর্যটন খাত থেকে প্রচুর আয় করে শুধু বিদেশিদের আগমনের জন্যই। চীন, জাপান, মালয়েশিয়া পর্যটন খাত থেকে প্রচুর আয় করে দেশি পর্যটকের চেয়ে বিদেশি পর্যটকের জন্য।

পর্যটনশিল্পের প্রচারের জন্য ট্রেন, বাস, স্টিমার ও লঞ্চ প্রভৃতির যাত্রী টিকিটে সংশ্লিষ্ট এলাকার ট্যুরিস্ট বা ঐতিহ্যের ছবি যুক্ত করা যায়। সংশ্লিষ্ট রেলস্টেশন থেকে টিকিটে সেই এলাকার পর্যটন এলাকার ছবি ও একেবারেই সংক্ষিপ্ত শিরোনাম দিতে হবে। এতে মনের অজান্তেই যাত্রীরা সংশ্লিষ্ট এলাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন। জেলাভিত্তিক না করা গেলেও রেলের টিকিটে অঞ্চলভিত্তিক এ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তবে বাস বা নৌযাত্রীদের টিকিটে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রাধান্য দিতে হবে। বাসমালিকদের ক্ষেত্রে সরকার এ রকম আদেশ জারি করতে পারে। আর একটি সুপারিশ খুব কার্যকর হতে পারে,Ñসেটি হলো রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল বা নৌবন্দরে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভ্রমণের চিত্র দেয়ালে তুলে ধরা যায় এবং ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করলে খুব ভালো হবে। ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা কাছের এলাকা ঘুরে আসতে অনুপ্রাণিত হবেন বলে মনে করি।

পাঠ্যপুস্তকে আরও বেশি করে ট্যুরিস্ট স্পট নিয়ে লেখা ও ছবি অন্তর্ভুক্ত করা যায়। অনেক উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কালচার সম্পর্কে বাস্তব অবস্থা জানতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় সহযোগী হতে পারে। ভ্রমণফিচার বা ট্যুরিস্ট স্পট নিয়ে যেসব ব্যক্তি বা সংস্থা লেখালেখি করে, তাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য বিভিন্ন পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যায়। অনেক দৈনিকে ভ্রমণ ফিচার ছাপা হয়। প্রায় সব পত্রিকায় ভ্রমণ ফিচারের জন্য আলাদা ব্যবস্থা  রয়েছে। এসব বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে। ভালো পাতার পত্রিকারও মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা করতে পারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা সংস্থা। বিভিন্ন দূতাবাসে লিফলেট বা তথ্য সংবলিত ম্যাগাজিন বা বই পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বিদেশি বা প্রবাসীদের আকর্ষণ করা যাবে। ভারতের ভ্রমণ স্পটগুলো প্রচারের জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে। এর জন্য তারা বিভিন্ন সাইটও খুলেছে অনলাইনে। এগুলো খুবই তথ্যসমৃদ্ধ। যেমন একটা সাইট ‘ইনক্রিডেবল ইন্ডিয়া’। এটি ভিডিও, ছবি এবং তথ্যে সমৃদ্ধ একটি পর্যটন সাইট। ভারতের মতো আমরাও এ রকম বিভিন্ন সাইট খুলতে পারি। আর যেসব সাইট বিদ্যমান, সেগুলো আরও তথ্যসমৃদ্ধ করতে পারি।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য আলাদা পরিকল্পনা নিতে হবে। একই সঙ্গে পাহাড়, সমুদ্রসৈকত, নদী, পাথর, বনাঞ্চল, ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্থাপত্য, বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা ইত্যাদির প্যাকেজ পৃথিবীর আর কোনোও একক স্থানে নেই। শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্যটনে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে, বাজেট বাড়াতে হবে। বিদেশিরা অনেক সময় খোলামেলা পরিবেশ পছন্দ করেন। এসব সে দেশের কৃষ্টি-কালচার। বিদেশিদের জন্য কক্সবাজার, কুয়াকাটা বা সৈকত এলাকায় সংরক্ষিত এলাকা তৈরি করা দরকার।

বাঙালির ভিড় এড়িয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারলে বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে। সর্বোপরি ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে যোগাযোগ ও নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। কয়েকটি স্পট বাদে এ ক্ষেত্রে আমরা খুবই পিছিয়ে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাইডও তৈরি করতে হবে আমাদের। যাঁরা বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতেও দক্ষ হবেন, কৌশলী হবেন। বিদেশিদের আস্থা অর্জন করতে পারবে। এ জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশিদের জন্য আমরা আলাদা জোন করতে পারি।

সেখানে আবাসিক ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশিরা যেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, তেমনই বিপুল পরিমাণ খরচ করবেন তাঁরা। এতে আমরাই লাভবান হব। ভারতে দেখেছি, ট্রেনে বিদেশিদের জন্য আলাদা টিকিটের ব্যবস্থা আছে।

আমরাও তা করতে পারি। রেলসুবিধা বাড়াতে হবে যাতে বিদেশিরা আরামদায়ক বোধ করে। যেসব পর্যটন এলাগুলোতে রেললাইন নেই, সেখানে রেললাইন সম্প্রসারণ করতে হবে। বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে জাতীয় পরিকল্পনায় পর্যটনশিল্পকে আগ্রাধিকার প্রদান, জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, স্পটভিত্তিক বিশেষ পর্যটন পুলিশ গড়ে তোলা, পরিকল্পিত প্রচার চালানো, দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা এবং পরিকল্পিত বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করি।

সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাংলাদেশও পর্যটন খাত থেকে প্রচুর আয় করতে পারবে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ইত্যাদি রাষ্ট্রের আমাদের দেশের মতো বৈচিত্র্যময় ট্যুরিস্ট স্পট নেই। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সৈকত, পাহাড়, ধর্মীয় স্থাপনা  ইত্যাদির ভেরিয়েশন রয়েছে আমাদের দেশে। তার পরও উল্লিখিত দেশে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে পর্যটন শীর্ষস্থানীয় একটি খাত হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলংকা বা মালদ্বীপ পর্যটন খাত থেকে অনেক আয় করে থাকে।

এসব দেশের বিভিন্ন উদ্যোগ আমাদের দেশে উদ্যোগ নিয়ে বা স্থানিক চাহিদার ভিত্তিতে রূপান্তর করে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, যানবাহনগুলোতে সুযোগ–সুবিধা বাড়িয়ে আমরা বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করতে পারি। স্যোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন, গণমাধ্যম বা দূতাবাসের মাধ্যমে আমাদের পর্যটন এলাকা নিয়ে তৈরি লিফলেট, প্রামাণ্যচিত্র, ভিডিও ইত্যাদি প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পারি।
লেখক:  কবি ও প্রাবন্ধিক