পর্যটনের সম্ভাবনা মিরসরাইয়ের মুহুরী প্রজেক্ট
প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জনপদ চট্টগ্রামের মিরসরাই। উত্তরে চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মোহনা, পূর্বে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থান চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা। নদী, মনোরম ঝরনা, বন্য প্রাণী, সবুজ অরণ্য, নির্মল হ্রদ—প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যময় সম্পদে সমৃদ্ধ এই জনপদ।
সেখানকার গিরি-নদীর মিলনস্থলে ছায়া হয়ে দিগন্তে মিশে গেছে নীল আকাশ। প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে সব সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে। এ যেন কোনো শিল্পীর কল্পনার রঙে ক্যানভাসে আঁকা ছবি। এই অঞ্চলের সৌন্দর্যে মুগ্ধে হয়ে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বলেছিলেন, ‘পানি ও কুয়াশার মাঝে সৃষ্ট ঘুমন্ত এক সৌন্দর্য।’
মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশে পশ্চিম দিকে অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুহুরী প্রকল্প বা সেচ প্রকল্প। ১৯৮৪ সালে তিনটি নদীর সম্মিলিত প্রবাহকে আড়ি বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ৪০ ফোক্ট-বিশিষ্ট একটি বৃহদাকার পানির নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করা হয়। বর্ষা মৌসুমে উপকূলীয় বনাঞ্চলকে সাগরের জোয়ার, প্লাবন, ভাঙন ও আকস্মিক জলোচ্ছ্বাসের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা ও আমন ফসলে অতিরিক্ত সেচের সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল মুহুরী প্রকল্প। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে এই বাঁধ বিশাল অবদান রেখে চলেছে। বাঁধ নির্মাণের ফল হিসেবে দুই পাশে ৫০ হাজার একর চর জেগে ওঠে। এই চর একসময় গরু-মহিষের চারণভূমি ছিল। পরবর্তী সময় স্থায়ীয় লোকজন বাঁধ দিয়ে মিঠা পানির মাছ চাষ শুরু করেন। মাছ চাষ করে ভাগ্য বদলে গেছে অনেক বেকার যুবকের। মাছ চাষ করাকে কেন্দ্র করে মিরসরাইতে গড়ে উঠেছে ২৯টি জেলেপাড়া। এসব জেলেপাড়ার হাজারো মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। জেগে ওঠা চরের সাত হাজার একরে দেশের অনেক নামীদামি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য প্রকল্প গড়ে তুলেছে। এখানে প্রায় পাঁচ শতাধিক মৎস্য প্রকল্প রয়েছে। এসব ঘেরে পাঙাশ, তেলাপিয়া, কার্প, পাবদা, গুলশা, কই, শিং, মাগুর, ট্যাংরাসহ প্রভৃতি মাছের চাষ করা হয়।
প্রজেক্টের উৎপাদিত মাছ স্থায়ী বাজারের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিদেশে রপ্তানি করা হয়।
এ ছাড়া হ্যাচারিতে মালয়েশিয়ার মানোসেক্স নামে তেলাপিয়া মাছের পোনা উৎপাদিত হয়। দেশের সবচেয়ে বড় মৎস্য জোন হিসেবে মুহুরী প্রকল্প পরিচিত। এই মৎস্য জোন থেকে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে মুহুরী প্রজেক্ট বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় একটি দর্শনীয় স্থান ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। প্রকৃতির অনাবিল মনোমুগ্ধকর শোভা দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো ভ্রমণপিপাসু এবং পর্যটক ছুটে আসেন। ব্যস্ততম যান্ত্রিক শহরের ক্লান্তি দূর করতে, মানসিক প্রশান্তির খুঁজে ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে আসেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে। আলো-আঁধারির খেলা, পরিষ্কার নীল আকাশ, সেচ প্রকল্পের পানির প্রবহমান স্রোতের শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যায় দূর থেকে। মুহুরী নদীর পানি প্রবল বেগে ছুটে চলেছে সমুদ্রের পানে। এক মুহূর্ত তার তর সইছে না, নেই এক মুহূর্তের বিশ্রাম। বাঁধের দুই পাশে নিচ থেকে পাথর দিয়ে বাঁধানো এবং ওপর দিকে দূর্বাঘাসের পরিপাটি বিছানা। বাঁধের উত্তরে নীল জলরাশি আর দক্ষিণে বিস্তীর্ণ মৎস্য অভয়ারণ্য ও বন বিভাগের সবুজ বেষ্টনী। প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত সবুজের সমারোহে রয়েছে পাইনগাছের সারি, ঝাউবন ও কাশফুলের ভরা ঘাস।
মুহুরীর জলরাশিতে নৌভ্রমণের সময় খুব কাছ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস, সাদা বক এবং প্রায় ১০০ জাতের হাজারো পাখির দেখা পাওয়া যায়। পাখিদের কিচিরমিচির ডাক কানে আসে। আছে মানুষের জীবন ও জীবিকার বিভিন্ন চিত্র। নদীতে জাল ফেলে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, ভাসমান মাছ চাষ, লোনাপানিতে ভেসে চিংড়ি পোনা সংগ্রহের দৃশ্য সবার নজর কাড়ে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বিভিন্ন ফাঁদ পাতে মাছ ধরার জন্য।
বাঁধের একটু সামনে গেলে দেখা মিলবে উপকূলীয় বন বিভাগ কর্তৃক সাজানো কৃত্রিম বন। বনের ফাঁকে ফাঁকে সর্পিল আকারে বয়ে গেছে ছোট ছোট নদী। হরিণ, বানর ও অনেক বন্য পশুপাখি রয়েছে এখানে।
চিকচিক করা বালু, জল আর রোদের খেলা চলে সারাক্ষণ। নদীর পানিতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য পর্যটকদের আকর্ষণ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখানে অবস্থিত। গোধূলির শেষ আলোয় দিগন্তরেখায় তাল মিলিয়ে এক ভিন্নমাত্রা যোগ করে বায়ুকলগুলো। মুহুরী প্রজেক্টের আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য অবলোকন করে পর্যটকেরা রোমাঞ্চিত হন।
আনন্দময় সময় কাটাতে আসা পর্যটকেরা মনে করেন অবকাঠামো উন্নয়ন, বিভিন্ন জাতের বনজ, ভেষজ ও ঔষধি গাছ লাগিয়ে স্থানটিকে আরও সবুজ সমারোহে পরিণত করা গেলে, এটি হতে পারে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অনন্য আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র। এই পর্যটন খাতে আয় হবে দেশি-বিদেশি মুদ্রা।
লেখক, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।