সোনালি প্রান্তরে: সোনার কেল্লার জয়সালমীরে
মুগ্ধ বালকের মতো জানালার ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম আমার অদেখা ভুবন। দ্রুত চলছে জয়সালমীর এক্সপ্রেস। একটু পরপর প্রকৃতি তার রং বদল করছে। কোথাও সারি সারি সবুজ ভুট্টাখেত, কোথাও-বা শান্ত ধীর নদী আর সাজিয়ে রাখা শিলা ও পাথরের স্তূপ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঘেদের রংও বদলায়, সূর্যের তেজ বাড়ে।
দিল্লি থেকে জয়সালমীর এক্সপ্রেসে যখন উঠলাম, তখন মধ্যরাতের আরও খানিক বাকি। দুই চোখে ক্লান্তির ঘুম। নিজের আসনটা ঠিকমতো খুঁজে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমাতেই ভোরের আলো এসে পড়ল ট্রেনের জানালায়। আমাদের চারজনের ছোট্ট দল। ট্রেনের কামরায় সহযাত্রী এক রাজস্থানি দম্পতি। লোকটার মাথায় ঐতিহ্যের পাগড়ি আর কথা বলছে স্থানীয় ভাষায়। ভাষাটা ঠিক হিন্দি নয় বলে নিশ্চিত করে আমাদের দলের ভাষা বিশারদ মাহমুদ।
বেলা তখন দুপুর গড়িয়েছে। আমরা ততক্ষণে আজমির চলে এসেছি। ট্রেনটা এখানে খানিক জিরিয়ে নেবে। আজমির শরিফ জংশন। আর আমরাও কিছুটা নেমে চারদিকটা দেখে নিই। আজমিরের প্রকৃতি অনেকটা রুক্ষ, বেশ গরম আর মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে মনে হবে শহরটা যেন ছন্দ মিলিয়ে কাঁদছে। ট্রেন আবার চলতে থাকে। বহু দূরের পথ তার। মরুর বুকে ক্ষুধার চেয়ে পিপাসা পায় ভীষণ।
গরম আর রোদ বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। বৃক্ষরা হারিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। জল আর নদীর দেখাও আর মিলছে না। জয়পুর, যোধপুর পেরিয়ে যাই আমরা। ‘সার্ন বার্নের’ আশায় আমি জানালা দিয়ে তাকিয়েই থাকি। চারদিকে ধু ধু প্রান্তর। কিছুক্ষণ পর দেখি ঠাই দাঁড়িয়ে আছে, পাহাড়ের সারি। কিন্তু এ পাহাড়গুলো ঠিক সবুজ নয়। তার বুকে আছে শুধু শিলা আর পাথর। শরীরজুড়ে পায়নি গুল্ম-বৃক্ষের ছোঁয়া।
সন্ধ্যা নামতে থাকে। মরুর বুকের ওপর চলছে রেলগাড়ি। হয়তো কাছের কোনো নগরীতে বাতি জ্বলছে। দূর থেকে দেখে মনে হয়, সহস্র জোনাকি খেলা করছে যেন।
ট্রেনটা যখন জয়সালমীর পৌঁছাল, ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১১টা। ১৯ ঘণ্টায় দীর্ঘ প্রায় ৯০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে অবশেষে সেই সোনালি প্রান্তরে পা পড়ল। অঞ্জন দত্ত বৃষ্টি এলে যে শহরে যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন, সেই শহরে এলাম ভরা গ্রীষ্মে। তাপমাত্রা তখন ৪৮ ডিগ্রির কাছাকাছি। জয়সালমীরকে বলা হয় ‘গোল্ডেন সিটি’। শহরের প্রতিটি ঘরের রং সোনালি।
স্টেশনে নামলেই চোখে পড়বে রাজকীয় এক ভাব। সোনালি পাথরে গড়া পুরো স্টেশনটা যেন এক ছোট খেলাঘর। দেয়ালে দেয়ালে খোদাই করা নকশা। কী অপরূপ তার কারুকাজ! কোথাও তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন শক্তিমান রাজা, পেছনে বিজয় লক্ষ্মী রানি।
আমাদের জন্য স্টেশনের বাইরে লাল জিপ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আলী ভাই, আমাদের গাইড। রাতে হোটেলে ফিরে নাক ডাকা ঘুম। সকালের নাশতা সেরেই সোজা সোনার কেল্লায়। চোখের সামনে ভেসে আসে জাতিস্বর মুকুলের চেহারা।
সোনার কেল্লায় হানা
অনেক অনেক উঁচুতে কী প্রকাণ্ড এক কেল্লা! কী বিশাল তার এক একটা দরজা। এটা পৃথিবীর বিরল ‘লিভিং ফোর্ট’ গুলোর একটা। যার ভেতরে মানুষ এখনো বাসা বেঁধে আছে। কেল্লার ভেতরে মানুষের নিত্যদিনের গৃহস্থালি কাজকর্ম চলছে আগের মতো। পুঁতির মালা, পুতুল কিংবা শাড়ি নিয়ে মনিহারি দোকান সাজিয়ে রেখেছেন সওদাগরেরা। ‘১৩০০ শতাব্দীতে একবার এই কেল্লা আক্রমণ করেছিলেন আলাউদ্দীন খিলজি। বীর রাজপুতদের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল তখন সোনার পুরী। অপমান থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছা মৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন তখন পুর নারীরা। মুসলমান শাসকেরা বারবার এভাবে রক্তাক্ত করে গেছেন আমাদের ভারতীয় সভ্যতার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
আমরা ধীরে ধীরে কেল্লার ভেতরে ঢুকছিলাম। কেল্লার সবচেয়ে উঁচু জায়গায় একটা কামান। সেখান থেকে তাকিয়ে পুরো শহরটার দেখা মেলে। চারদিকে কী অদ্ভুত সোনালি আভা চকচক করছে।
কেল্লা থেকে হালকা কেনাকাটা শেষে আমরা চলে যাই গাড়িসার লেকে। ‘হঠাৎ বৃষ্টিতে’ দেখা সেই লেক। এ মরুর শহরের একমাত্র পানির আবাসস্থল। আলী ভাই জানাল, কেবল হঠাৎ বৃষ্টিই নয়, আরও বেশ কিছু ছবির শুটিং হয়েছে এখানে।
মরুর বুকে অবাক সূর্যাস্ত
সূর্যের তেজ খানিকটা কমলে আমরা চলে যাই মরু দর্শনে। জয়সালমীর শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে থোর মরুভূমি। ইংরেজিতে এটাকে বলে দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ডেসার্ট। মরুর বুকে রাস্তা চলার এক অদ্ভুত আনন্দ। চারদিকে বালুর অনন্ত সমুদ্র। তার মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে রাস্তাটা। মাঝেমধ্যে দু-একখানা ফণীমনসাগাছ। তাঁবুর অস্থায়ী ঘরে ব্যাগ রেখে আমরা মাতি ‘ডেজার্ট সাফারিতে’। এ এক ভয়ংকর আনন্দ।
বালুর মধ্যে দ্রুত এদিক-ওদিক করে গাড়ি চালাচ্ছেন আলী ভাই। কখনো-বা এক চাকায় ভর করে। এমন দক্ষ চালক আর কখনো দেখার ভাগ্য হয়নি। মরুর বুকে একটা জায়গায় এসে আমাদের উটের পিঠে যাত্রা। সোনালি প্রান্তরের বুকে চলছি। উষ্ণ বালুর বুকে সূর্য হেসে উঠছে একটু পরপর। মরুর বুকে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। নীল দিগন্ত হয়ে আসে পাংশুটে, চরাচরজুড়ে আসে উত্তাল হাওয়া। শান্ত মরু তখন অপরূপা। চারদিকে উপচে পড়া বালু-বসন্ত। আমার চোখের শ্রেষ্ঠ সূর্যোদয় দেখেছিলাম মরুর বুকেই। সন্ধ্যার ঠিক আগেই যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় মরুর। আজীবন নিষ্ঠুর জানা মরুভূমিকে তখন প্রেমময়ী মনে হয়। সূর্যের রক্তিম আভার সঙ্গে যার বুকে হারিয়ে যেতে আপত্তি নেই যেন।
থোর মরুভূমিরই একটা অংশ মিশে গেছে পাকিস্তান প্রান্তে।
তাঁবুতে মরুর রাত
রাতে মরুর বুকে শুরু হয় উৎসব। নেচেগেয়ে আমাদের মুগ্ধ করেন স্থানীয় অধিবাসীরা। তাঁদের গায়কির ঢং একেবারে আলাদা। মাথায় একটা হাঁড়ি কিংবা কলসি নিয়ে গান গান রাজস্থানি তরুণী। তাঁর কণ্ঠে হাহাকার। এ হাহাকার যেন জলের জন্য। ধু ধু মরুর শূন্য বুক। অনেক কিছুই নেই সেখানে—নেই জল, নেই শীতাতপ যন্ত্রের ভেতরের জীবন। তবু আছে বয়ে চলা জীবন আর সুর।
রাতভর আমরা জেগে থাকি। মরুর আকাশে মায়াবী এক চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিগত জীবনের সব দুঃখ ভুলে থাকা যায়।
রহস্যে ঘেরা কুলধারা গ্রাম
পরের দিন সকালে আমাদের যাত্রা অসীম রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ‘কুলধারা গ্রাম’। এক রাতেই নাকি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এ গ্রাম আর গ্রামের মানুষ। এরপর সেই সব গ্রামের অধিবাসীদের আজও কোনো খোঁজ মেলেনি। এক রাতে ৮৪টি গ্রামের এতগুলো পরিবার কোথায় হারিয়ে গেল, তা সত্যিই ভাবায় সবাইকে। প্রায় ১৭০ বছর ধরে রাজস্থানের ধু ধু মরুভূমির বুকে এক অপার শূন্যতা নিয়ে প্রায় ৮৪টি গ্রাম ঘুমিয়ে রয়েছে। নগরায়ণের স্পষ্ট ছাপ ফুটে আছে কুলধারার পরিত্যক্ত দেয়ালগুলোতে।
ইতিহাস কথা কয়! সে সময়ের সেলিম খাঁ নামের এক শাসকের লালসার কবলে পড়েছিল কুলধারার গ্রামপ্রধানের সুন্দরী কন্যা। সেলিম সে কন্যাকে কেড়ে নেওয়ার সব আয়োজন করে বসে। কিন্তু তার আগে সকাল হওয়ার পূর্বেই রাতারাতি বিলুপ্ত হয়ে যায় এ গ্রাম আর মানুষ। কুলধারার ঘরদোর আর দেয়ালে আঁকা ছবিগুলো মন দিয়ে দেখছিলাম খুব। মনে হয় দুপুরের রোদে ঝলমল করছে ঘুমন্ত এক নগরী।
থোর মরুভূমির বুকে আরও খানিকটা চলতে থাকি আমরা। আলী ভাই একের পর এক গল্প বলতে থাকেন। ভদ্রলোক হিন্দি, বাংলা, গুজরাটিসহ নানা ভাষা জানেন। শরীরে কালো কোর্তা। একবার নাকি আমাদের ঢাকাতেও এসেছিলেন। আমাদের তিনি ঘুরতে নিয়ে যান জয়সালমীরের পুরোনো প্রসাদগুলোতে। প্রসাদগুলোর আশপাশে কেনাকাটার হাট। কোথাও-বা বেহালায় সুর তুলেছেন পাগড়ি পরা রাজস্থানি বৃদ্ধ।
সারা দিন ভ্রমণ শেষে রাতের ট্রেনে আমাদের ফেরা। স্টেশনে বিদায় দিতে আসেন আলী ভাই আর হোটেলের কয়েকজন। মনে হয়, বহুদিনের পুরোনো কোনো স্বজনকে বিদায় জানাতে এসেছেন। স্পষ্ট বাংলায় বলেন, আবার আসবেন। আমার চোখ দিয়ে কি এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল? হয়তো!
সত্যি আবার যেতে হবে। মরুর প্রেমে পড়ে গেছি যে! বারে বারে যেন আসি ফিরে এমন দেশে উষ্ণ বালুর বুকে সূর্য যেথায় ওঠে হেসে স্বপ্নমাখা মেঘের নকশা ঝরানো এ আকাশ দেখার জন্য।
লেখক: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উন্নয়ন-যোগাযোগ কর্মকর্তা