সোনাদিয়া দ্বীপে রাতের ক্যাম্পিং

ছবি: সংগৃহীত

কয়েক দিন ধরে মাঘের কনকনে শীতের সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে শরীর-মনে অলসতা জেঁকে বসেছে। রাস্তার কুকুরগুলো তীব্র শীতে কাঁপছে। মুরব্বিরা বলতে শুরু করেছে, এমন হাড়কাঁপানো শীত আগে কখনো অনুভব করেনি। পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় কবলিত জেলার নাম ভেসে আসে। দৈনন্দিন জীবনের নানা সমস্যা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে বাজার খানিকটা হেসে উঠেছে শীতের সবজি মুলা, টমেটো ও শিমের আগমনে। এসেছে নতুন বছর। নতুন স্বপ্ন নিয়ে ছুটে আসে পরিযায়ী পাখি। অনুকূল পরিবেশের খোঁজে তারা ফেলে আসে নিজের ভূখণ্ড। এভাবে নিজের অজান্তে ভ্রমণ করে বিভিন্ন দেশ। সত্যি বলতে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থেকে বের না হলে সৃষ্টিজগতের অনেক কিছু অজানা থেকে যায়। পৃথিবীর একেক স্থান একেক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সেসব বৈশিষ্ট্যের জ্ঞান অর্জনে ভ্রমণের বিকল্প কিছু নেই। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ভ্রমণের পাঁচটি উপকারিতা উল্লেখ করেছেন, ভ্রমণে দুশ্চিন্তা দূর হয়/ জীবিকা অর্জন করা যায়/ জ্ঞানার্জন করা যায়/ সৌজন্য ও শিষ্টাচার শেখা যায়/ শারীরিক সুস্থতা অর্জন হয়।

পতেঙ্গার বিখ্যাত ভ্রমণ গ্রুপ ‘লাঠিয়াল’ গ্রুপের সদস্যরা পরিযায়ী পাখির মতো নিজের দেশকে ঘুরে ঘুরে দেখার, জানার যে প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা করেছিল, সেই ধারাবাহিতায় এবার ভ্রমণের জন্য বেছে নিয়েছে সোনাদিয়া দ্বীপ। সোনাদিয়া দ্বীপ বাংলাদেশের কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের একটি দ্বীপ। অপরূপ সৌন্দর্যের আধার দ্বীপটি কক্সবাজার শহর থেকে উত্তর–পশ্চিমের ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৯ বর্গকিলোমিটার। তিন দিকে সমুদ্রসৈকত এবং ছোট-বড় খালবিশিষ্ট প্যারাবন। এটি মহেশখালী খাল দ্বারা কক্সবাজারের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

গত ২৬ জানুয়ারি সকাল সাতটায় ৯ সদস্যের টিম নিয়ে আমরা পতেঙ্গা সৈকতের মোড় থেকে বাসে করে বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে আনোয়ারা চাতরী চৌমুহনী মোড়ে নামি। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাঁশখালীর প্রেম বাজারে গিয়ে যাত্রাবিরতি। হালকা নাশতা খেয়ে আবার যাত্রা শুরু। বাঁশখালী পেরিয়ে চকরিয়া অতিক্রম করছে গাড়ি। গ্রামের কাঁচাবাজারগুলো বেশির ভাগ মেইন রোডের পাশে। নিজস্ব খেতের টাটকা সবজি, চাষের তাজা মাছ, রকমারি দেশীয় ফল সাজিয়ে বসে আছেন স্থানীয় চাষিরা। অন্যরকম এক সৌন্দর্য ফুটে ওঠে গ্রাম্য বাজারে। নির্দিষ্ট বাজারের দিন দলে দলে মানুষ ভিড় করেন। চলতে চলতে চকরিয়া বাস স্টপেজে এসে আমরা গাড়ি বদল করি।

আবারও সিএনজিচালিত অটো নিয়ে মহেশখালীর দিকে যাত্রা শুরু। শুক্রবার গ্রামের মানুষকে অধিক ব্যস্ত মনে হচ্ছে। রাস্তার পাশে আমার দেখা সবচেয়ে বড় পানবাজার। মহেশখালী যে পানের জন্য বিখ্যাত, তা এই বাজার দেখলে বোঝা যায়। বেলা সাড়ে ১১টায় ঘটিভাঙ্গা নৌঘাটে পৌঁছাই।

এবার ইঞ্জিনচালিত বোটে আমাদের মূল যাত্রা শুরু। পরিষ্কার নীল জল দুই পাশে সবুজ প্যারাবন মাঝনদীতে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের বোট। দল বেঁধে খাল পেরিয়ে যাচ্ছে মহিষের পাল। মাছ ধরার জালের কুঠিতে বসে ডানা মেলে রোদ পোহাচ্ছে পানকৌড়ি। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে সাদা বক, যেন বাংলার প্রকৃত রূপ ফুটে উঠেছে চোখের সামনে। এ রকম পরিবেশে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে যে কারও গাইতে মন চাইবে...

‘আমি বাংলার গান গাই
আমি বাংলার গান গাই...
আমি আমার আমিকে চিরদিন
এই বাংলায় খুঁজে পাই।’

রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের সুন্দর এক অনুকূল পরিবেশে চলতে চলতে আমাদের বোট পৌঁছে গেল সোনাদিয়া দ্বীপের পশ্চিম সৈকতের নৌঘাটে। বোট থেকে নেমে আমাদের আগে যোগাযোগ করে রাখা আলমগীর ভাইয়ের বাসায় ব্যাগ রেখে মসজিদে চলে যাই। নামাজের পর আলমগীর ভাইয়ের বাসায় মাছ, ডাল ও ভর্তা দিয়ে দুপুরের খাবার শেষে আমরা সৈকতের ঝাউতলায় তাঁবু তৈরি করি।

কখনো কখনো আপনার মন ও অনুভূতির জন্য একটি নিঃশব্দ পরিবেশ খুবই প্রয়োজন। সেই পরিবেশ দিতে পারে সোনাদিয়া দ্বীপ। নিস্তব্ধ, কোলাহলমুক্ত পরিচ্ছন্ন এই সৈকতের ঝাউতলার তাঁবুতে খানিক বিশ্রামের পর বিকেল চারটায় সবাই সাগরের পানিতে পা ভিজিয়ে, ফুটবল খেলে, কেউ গাছের ঢাল দিয়ে তৈরি দোলনায় দুলতে দুলতে সূর্যাস্তের সাক্ষী হলাম।

ছবি: লেখক

নিশান ভাই ফোন করে নাশতা রেডি হওয়ার খবর দেয়। ঘর থেকে তৈরি করা গরম–গরম নুডলস আর পেঁয়াজুর সঙ্গে টংদোকানের চা খেয়ে সবাই লাকড়ি জোগাড় করে তাঁবুর সামনে আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। শীতের সন্ধ্যায় আগুনের হালকা তাপ গায়ে মেখে মিসবাহ ভাই গিটারে সুর তুলে গান ধরেছেন...

‘পূর্ণিমাতে ভাইসা গেছে নীল দরিয়া
সোনার পিনিশ বানাইছিলা যতন করিয়া
চ্যালচ্যালাইয়া চলে পিনিশ, ডুইবা গেলেই ভুস
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস
দম ফুরাইলে ঠুস।’

উখিয়া থেকে আসা কিছু তরুণ মিসবাহর সঙ্গে যোগ দিয়ে সন্ধ্যার আসরটা জমিয়ে তুলেছেন। গল্পে, আড্ডায় রাত প্রায় ৯টায় নিশান ভাই ঘর থেকে পরোটা বানিয়ে নিয়ে এসে আমাদের জ্বালানো আগুনের কয়লায় মুরগির বারবিকিউ তৈরি করে দিলেন। এটাই আজ রাতের খাবার। রাতের খাবার গ্রহণ শেষে গ্রুপের সবাই নিজ নিজ তাঁবুতে বিশ্রামে চলে যায়। উখিয়া থেকে আসা গ্রুপটি দল বেঁধে চাঁদের আলোয় হাডুডু খেলছে। ঢাকা থেকে আসা আরেকটি গ্রুপ আড্ডার আসর বসিয়েছে। সৈকতজুড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন পর্যটক। ইতিপূর্বে কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, কুতুবদিয়া, নিঝুম দ্বীপ, পারকি, কুয়াকাটা, বাঁশখালীসহ অনেক সৈকতে গিয়েছি; তবে সোনাদিয়া দ্বীপের মতো এমন নীরবতা কোথাও পাইনি। কিশোর মজুমদার লিখেছেন,
‘ছবি যেমন নীরব কবিতা, তেমনি নীরবতাও মুখর কবিতার জন্ম দিতে পারে।’

রাত চারটায় তাঁবু থেকে বের হয়ে দেখি পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় পুরো সৈকত ফরসা হয়ে আছে। রাতের নীরবতায় সাগরের মৃদু ঢেউয়ের শব্দগুলো অসম্ভব ভালো লাগে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় সবাইকে জাগিয়ে আবারও সৈকতে হাঁটতে গেলাম। সাতটায় সবাই ব্যাগ গুছিয়ে আলমগীর ভাইয়ের বাসায় গরম–গরম খিচুড়ি খেয়ে বোটে করে রওনা হলাম সোনাদিয়ার দক্ষিণ–পূর্ব সৈকতের বিখ্যাত শুঁটকিপল্লিতে। সারা বছর শুঁটকি উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন বাজারে পাঠানো হয়। পর্যটকেরা সবাই শুঁটকি কিনতে ব্যস্ত।

আমরাও শুঁটকি কিনে বোটে চড়ে ঘটিভাঙ্গা ঘাটে আসি, তখন বেলা দুইটা। ঘাটের পাশে হোটেলে দুপুরের খাবার শেষে মহেশখালী স্টেশন থেকে বাসে ফিরতে শুরু করি প্রাণের শহর চট্টগ্রামে।

বি. দ্র. সোনাদিয়া দ্বীপে কোনো হোটেল–রিসোর্ট নেই, স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় ক্যাম্পিং এবং খাবারের ব্যবস্থা করে যেতে হয়।