ভোলায় তারুয়া সৈকত

বালিয়াড়ি আর ম্যানগ্রোভ বন
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে নদীবেষ্টিত গাঙ্গেয় দ্বীপ জেলা ভোলা। এর আয়তন ৩ হাজার ৪০৩ বর্গকিলোমিটার। রুপালি ইলিশ, ধান আর সুপারির জন্য এ জেলা সুপরিচিত। ভোলার সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে তারুয়া ম্যানগ্রোভ বন আর সাগরের সৈকত মিলে অপরূপ সৌন্দর্যের আধার হিসেবে প্রকৃতিপ্রেমীদের নজর কাড়ছে। এক পাশে সৈকত, আরেক পাশে বন, সঙ্গে শোঁ শোঁ শব্দ। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মায়াবী দৃশ্য যে কারও মনে অদ্ভুত দোলা দেবে। এখানে না এলে প্রকৃতির অবারিত সাজের পসরা বর্ণনায় বোঝানো কঠিন।

তারুয়া দ্বীপ

পর্যটকদের ক্যাম্প
ছবি: সংগৃহীত

ভোলা জেলা সদর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণে চরফ্যাশন উপজেলা। উপজেলার সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় প্রায় দেড় শ বছর আগে জেগে ওঠা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ঢালচর। এ চরের তাড়ুয়া সমুদ্রসৈকতটি অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বিচ্ছিন্ন এ ঢালচর থেকে তারুয়া ট্রলারে প্রায় দেড় ঘণ্টার নদীপথ। স্পিডবোট মাত্র ২০-২৫ মিনিট। বঙ্গোপসাগরের একেবারে দক্ষিণের মোহনায় মনোরম ম্যানগ্রোভ বনসমৃদ্ধ তাড়ুয়া চর সগর্বে দাঁড়িয়ে। চারপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন সারি সারি কেওড়াগাছ। অন্য প্রজাতির গাছও নেহাত কম নয়।

তারুয়ার সৈকতে দেখা মিলবে চকচকে সাদা বালু আর লাল কাঁকড়ার মিছিল। মাথার ওপর কিংবা বেলাভূমিতে বিভিন্ন প্রজাতির হাজারো পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। তবে শীতের সময় অতিথি পাখির বিচরণে এক অতি প্রাকৃতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বর্ণিল আলোকচ্ছটা মোহিত করবে যে কাউকে। চাঁদনি রাতে এ সৈকত যেন জেগে ওঠে। মায়াবী আলোয় প্রকৃতিপ্রেমীরা ঘুমের কথা ভুলে যাবেন। নাগরিক ব্যস্ততার বন্দিজীবনে অবকাশ যাপনের জন্য প্রকৃতিপ্রেমীরা একটু সময় করে এখানে এলে প্রকৃতি তাঁদের নিরাশ করবে না।

তারুয়া ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল

তারুয়া সমুদ্রসৈকতের অতিথি পাখি
ছবি: সংগৃহীত

ঢালচরের ৩১ দশমিক ৩১ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ২৮ দশমিক ২০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে সুবিশাল বনাঞ্চল। এর মধ্যে তারুয়ার বন অন্যতম। এ তারুয়া বনে রয়েছে গেওয়া, গরান, কেওড়া, বাইন, রেইনট্রিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান গাছ। শীত এলেই এখানে আস্তানা গড়ে বিভিন্ন প্রজাতির হাজারো অতিথি পাখি।

এখানে পরিকল্পিতভাবে বনাঞ্চল শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। এখানে কোনো হিংস্র পশুর ভয় না থাকলেও বনে রয়েছে শিয়াল, বন বিড়াল, হরিণ, সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। এই বাগানের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু ভেতরে গেলেই মনে হবে, এ যেন আরেক ভুবন। সেখানে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বিশাল একটি শীতল ছায়াবিশিষ্ট মাঠ। স্থানীয়ভাবে জায়গাটা বরইতলা নামে পরিচিত।

তারুয়া সমুদ্রসৈকত

তারুয়া দ্বীপের ল্যান্ডিং স্টেশন।
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা তারুয়ার সাদা বালুর বিশাল সমুদ্রসৈকতে লোনা পানির ঢেউ শোঁ শোঁ শব্দে আছড়ে পড়ে। সাদা বালুতে লোনা পানির উঁচু ঢেউ, কাছাকাছি সবুজ বনভূমি কক্সবাজার অথবা কুয়াকাটা সৈকতের চেয়ে কারও কাছে অন্য রকম মনে হতে পারে। সৈকতে লাল কাঁকড়ার বিচরণ। বালুর ওপর ছোট ছোট পা দিয়ে দৌড়ে চলে এসব লাল কাঁকড়ার দল। মানুষের অবস্থান টের পেলে এরা চোখের নিমেষেই লুকিয়ে পড়ে বালুর গর্তে।

এ চরে চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল, পাঁতিশিয়াল, বন্য মহিষ-গরু, বনবিড়াল, বন মোরগসহ নানা প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। বক, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠ ময়ূর, কোয়েল, গুইসাপ, বেজি, কচ্ছপ নানা ধরনের সাপও আছে এ চরে।  

যাওয়ার পথ

তারুয়া দ্বীপের লাল কাঁকড়া
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা থেকে লঞ্চে সরাসরি যেতে পারবেন ভোলার চরফ্যাশনে। সেখান থেকে মোটরসাইকেল কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে চর দক্ষিণ আইচা এলাকার চর কচ্ছপিয়া ঘাটে। এরপর চর কচ্ছপিয়া ট্রলার ঘাট হয়ে স্পিডবোট বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বেশ খানিকটা জলপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো যাবে তারুয়া দ্বীপে। লক্ষ্মীপুর থেকে যেতে হলে মজু চৌধুরী লঞ্চ ও ফেরিঘাট থেকে লঞ্চ-ট্রলার-স্পিডবোটে ভোলার ইলিশা ঘাট, সেখান থেকে অটোরিকশায় ভোলা শহরে। শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে চরফ্যাশনের বাসে করে চরফ্যাশন গিয়ে পূর্ব নির্দেশিত পথে।  

থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা  

তারুয়ায় বেশ কয়েকটি টিনশেড হোম স্টে আছে। কম ভাড়ায় এখানে থাকার ব্যবস্থা আছে। অনেকে তাঁবু নিয়ে ক্যাম্প করেও থাকেন। মো. হাসানের ০১৭৩৫-২৫৪১৮০ অথবা মোস্তফা মেম্বারের ০১৭১৬-২৬৮২৪৫ নম্বরে যোগাযোগ করলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। হাসানকে বললে চাহিদামতো নদী বা সমুদ্রের তাজা মাছ রান্না করে দেবে। চাইলে বারবি-কিউও করা যাবে।

লেখক: মোবাশ্বির হাসান শিপন, শিক্ষক