বিশ্বজুড়ে ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনা। আর বিজয়ের মাস। এর মধ্যে আয়োজন করা হয় লেখকদের আনন্দভ্রমণের। কী দারুণ ব্যাপার! বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর। পূর্ব–ঘোষিত ছিল, কীভাবে কোথায় থেকে, কখন আমরা যাত্রা শুরু করব। এ জন্য সবার মতোই আমার আর আমার সহধর্মিণী রাজিয়া সুলতানা ঈশিতার এক অন্য রকমের আবেগ কাজ করছিল। এত লেখককে নিয়ে এমন আমাদের ভ্রমণ এই প্রথম। তাই হয়তো এত আবেগ, উচ্ছ্বাস। সকাল থেকে নানা প্রস্তুতি শেষ করে ঠিক বেলা ২টায় বের হলাম। এর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লেখকদের নানা রকমের পোস্ট। কেউ বাসা থেকে রওনা দিয়েছেন, কেউবা রাস্তায়, কেউ কেউ পৌঁছে গেছেন—এমন সব। এগুলো দেখে মনে আর তর সইছে না।
কখন আমরা গন্তব্যে পৌঁছাব। ৪টা বেজে ১৫ মিনিটে রাজধানীর সদরঘাটের বাদামতলীতে পা রাখলে দেখা মেলে বাবুই প্রকাশনীর কাদের বাবুর। তখনো সূর্যের আলো ঝলমল করছে। আমাদের চোখেমুখে আনন্দের এক অপরূপ ঝিলিক। লঞ্চঘাট থেকে মধুমতি লঞ্চের প্রবেশপথে লেখকেরা দাঁড়িয়ে নিবন্ধনের টিকিট সংগ্রহ করছেন। লেখক আনন্দভ্রমণের সদস্যসচিব, কথাসাহিত্যিক, সদা হাস্যোজ্জ্বল স্বকৃত নোমান আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। সেই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দিলেন, কে কোথায় থাকবেন। কী কী করবেন!
২.
হেমন্তের গোধূলি লগ্ন। মধুমতির ছাদ। খোলা আকাশের নিচে এর মধ্যে জমায়েত হয়েছেন বেশ কয়েকজন লেখক। লেখায় দীর্ঘদিনের পরিচয় লেখক নূরুননবী শান্তর সঙ্গে। কিন্তু এর আগে একবার দেখা হলেও সেভাবে আড্ডা দেওয়ার সময় হয়নি। এবারে সেই সুযোগ হলো। কথার ফাঁকে চলে ফটোসেশন। কবি ও আইনজীবী তানজিম আল ইসলামের সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা। সেই সঙ্গে তাঁর সহবন্ধু সাজেদুল হক। আড্ডা চলতে থাকে। গোধূলি লগ্ন শেষ হয়ে নতুন দিনের প্রত্যাশায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। ৬টা ৪৫ মিনিটে লেখক আনন্দভ্রমণের আহ্বায়ক কথাসাহিত্যিক ও প্রকাশক পারভেজ হোসেন ঘোষণা দিলেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্য বুড়িগঙ্গা থেকে মনপুরার উদ্দেশে যাত্রা শুরু হবে।’
আনন্দের উলুধ্বনিতে গর্জে ওঠে আনন্দভ্রমণের লঞ্চটি। বুড়িগঙ্গা জমকালো জলে ভাসতে থাকে মধুমতি। গিজগিজ করা ২৮৫ জন লেখক। একে অপরের সঙ্গে আলাপচারিতায় দেখা যায়, কত দিনের যেন কত কথা জমে আছে। ঠাকুরগাঁও থেকে এসেছেন রাজা ভাই। তিনি প্রায় ২৫ বছরে ধরে বের করছেন ছোটকাগজ ‘চলচিত্র’। আবার ঘোষণা। এবার জানানো হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য। গানের তালে উড়ালি নৃত্য। রাতভর চলতে থাকে। স্রোতের শনশন শব্দে আমরা ভাসতে থাকি আনন্দে।
৩.
ভোরের আকাশের লাল টকটকে এক অদ্ভুত সুন্দর সূর্য। যতবার দেখি, ততবারই মন জুড়িয়ে যায়। পাশে দুটি রকেট ছুটে চলছে। উড়ছে সাদা বক। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে। আমরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ি সূর্যের ছবি তোলার জন্য। সূর্যকে পাশে রেখে সেলফি না তুললে কী আর হয়! কেউ একজন বলল, ‘ওই দেখা যাচ্ছে মনপুরা। মহিষের রাজ্য। আমরা সেখানে গিয়ে মহিষের সঙ্গে আশা করি সেলফি তুলব।’ দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মনপুরা। ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রটি কার না ভালো লেগেছিল। এই মনপুরা যেন সেই মনপুরা—সত্যি, অন্য রকমের অনুভূতি। ধীরে ধীরে আমাদের লঞ্চ মনপুরার ঘাটে পৌঁছাল। সবার হর্ষধ্বনি। সময় খুব কম। কারণ, আমাদের আবার যেতে হবে নিঝুম দ্বীপে। ট্রলার দুটি ঘাটে বাঁধা। আমরা নেমে মনপুরায় কিছু সময় কাটালাম। চনমনে রোদ। চোখ তুলে তাকানো দায়। ভরে গেল ট্রলার দুটি। ভটভট শব্দ। মেঘনার গভীরতম স্রোতে ভেসে যেতে লাগল। দুই পাশে মনপুরার সারি সারি বৃক্ষরাজি। সেখানে পরিচয় হয় চট্টগ্রাম থেকে আসা লেখক আহমদ পলাশের সঙ্গে। তারপর কত কথা। কয়েকবার বলেন, চট্টগ্রামে এলে কিন্তু অবশ্যই জানাবেন। ট্রলারের এক পাশে যেন গানের আসর বসেছে। গানের তালে চলছে হাততালি।
নিঝুম দ্বীপের কাছে এসে পথ ভুলে গেলেন ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাঝি। কোন দিক দিয়ে প্রবেশ করবেন, তা বুঝে ওঠতে পারছেন না। তারপর আমরা কিছুক্ষণের জন্য নদীতে অজানাভাবে ভাসতে লাগলাম। কেউ কেউ গুগল ম্যাপ দেখে চেঁচামেচি করতে লাগল। মাঝি খোঁজ পেলেন আরেক মাঝির কাছে। দূরকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন, হাতের ইশারায় জানান, ওই দিকে যেতে হবে। তারপর মাঝি ছুটলেন সেই নির্দেশে।
৪.
নিঝুপ দ্বীপ। বাংলাদেশের ছোট একটি দ্বীপ। নোয়াখালীর হাতিয়ায়। প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একর। রোমাঞ্চকর ভ্রমণে আমরা যেন কলম্বাসের মতো আবিষ্কার করলাম হরিণের অভয়ারণ্য। চারপাশে কেওড়াগাছ। নোনা পানি। ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবনের পর এই দ্বীপকে দাবি করা হয়। ট্রলার দুটি ভিড়ল ‘নামার বাজার ঘাটে’। ট্রলার থেকে তরুণ কথাসাহিত্যিক রণজিৎ সরকার প্রথম নেমে জড়িয়ে ধরলেন এক দ্বীপবাসীকে। যেন তিনি ধরলে নিঝুম দ্বীপকে। এরপর সবাই নামতে শুরু করে। আহ্বায়ক পারভেজ হোসেন ঘোষণা দিলেন, ‘এক ঘণ্টার মধ্যে ঘুরে আসতে হবে।’
দুপুর ১২টা ৫ মিনিট। হেঁটে বাজারের দিকে যেতে শুরু করলাম। দুই পাশে অসংখ্য নৌকা নির্মাণকাজে ব্যস্ত নির্মাণশ্রমিকেরা। তাঁদের কাছে জানা গেল, হরিণ দেখতে হলে ভোরে আসতে হবে। এরপর আমাদের মনে হলো আর হরিণ দেখা হবে না। তার চেয়ে ঘুরে দেখি দ্বীপে যা যা আছে। জানা গেল, সুন্দর একটা সমুদ্রসৈকত আছে। এর আগে কখনো শুনিনি নিঝুম দ্বীপে সমুদ্রসৈকতের কথা। আমরা দ্বীপের দিকে যেতে লাগলাম। ইটের ভাঙা রাস্তা। হেঁটে চললাম। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রসৈকত। কক্সবাজারের মতো নাহলেও সৈকতটি মন্দ নয়। ফুরফুরে বাতাস। পুরো শরীর যেন শীতল হয়ে যাচ্ছে। বালু আর বালু। দুই হাত মেলে, চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিতে লাগলাম। কী শান্তি! এই সৈকতের যত্ন নিলে পর্যটকশিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাজারের পথ দিয়ে আবার চলে এলাম নামার ঘাটে। ঘাটের পাশে একটা বিচিত্র রকমের বটবৃক্ষ। শিকড়গুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আছে। সেখানে দেখা হয় কথাসাহিত্যিক ঝর্না রহমান ও কামনূর নাহারের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে কয়েকটা ছবি তুলে আমরা ট্রলারে উঠি। কয়জন এখনো আসেননি, তাঁদের জন্য আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষারত। সবাই আসার পর আমাদের ট্রলার ছুটল মনপুরার দিকে।
৫.
মনপুরার রামনেওয়াজ ঘাট। জানি না, এ ঘাটের নামটা এমন কেন? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। বেঁধে দেওয়া সময়ের জন্য হয়তো এটা বের করা হলো না। এখানে আমরা সন্ধ্যার আগে আগে চলে আসি। পাশে বাজার। পোয়ামাছের জন্য বিখ্যাত। দেখলাম, পোয়া মাছের বিশাল বাজার। ১৩৫ টাকা কেজিতে বিক্রয় করছে। বাজারে একটি দোকানে প্রকৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক সৈকত হাবিব, আহমেদ পলাশসহ আরও কয়েকজন। গল্প চলতে চলতে বেজে ওঠে জাহাজের সাইরেন। আমাদের এবার যেতে হবে। বাজারে চারপাশে মাছধরা পাল তোলা নৌকাগুলো কী সুন্দর করে সারি করে বেঁধে রেখেছে!
নৌকাগুলোর আলোতে দূর থেকে মনে হবে যেন আকাশের তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। সুশীতল বাতাস। মধুমতি জাহাজ। আমরা একসঙ্গে মিলিত হলাম নিচতলায়। জাহাজ ছাড়ার পর শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কয়েকজনের গান শুনে মন ছুঁয়ে গেল। সদস্যসচিব ঘোষণা দিলেন, লটারির টিকিট সংগ্রহ করার জন্য। টানটান উত্তোজনা। কে বেশি টিকিট কিনতে পারে। কবি ফরিদ কবির ঘোষণা দিলেন, ১০০ টিকিট কিনবেন, কিন্তু পুরস্কার নিশ্চিত করতে হবে। পুরস্কার নিশ্চিত করা হলো। ওদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিঝুম শাহ ঘোষণা দিলেন, তিনি সর্বোচ্চ টিকিট সংগ্রহ করবেন, তবে পুরস্কার নিশ্চিত করে নয়। এভাবে চলতে থাকে লটারির টিকিট কেনার পর্ব।
কয়েকজন প্রখ্যাত কবি-কথাসাহিত্যিককে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হলো। তাঁরা আয়োজন নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করলেন। একটু অভিমানী হয়ে অল্প কথায় শেষ করেন পরম শ্রদ্ধার কবি জাহিদ হায়দার। তিনি থেমে গেলেন সবার হট্টগোলের কারণে। আমার কাছে কেন জানি মনে হলো, অভিমান করে বসে থাকার চেয়ে অভিমান ভুলে জোর করে কথা বলা ভালো। যেমনটি করলে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার।
তিনি বলে ওঠেন, ‘লেখক সমাজ মূল্যায়ন না হওয়ার কারণ লেখক সমাজই দায়ী। কিছু সুযোগ পাওয়ার আশায় একজন ছোট কর্মকর্তার কাছে দিনের পর দিন বসে থাকে।…কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল, একজন লেখকই তো সমাজ ও দেশের অভিভাবক। তাঁর চিন্তার প্রকাশে তো রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। তাঁর আদর্শে জেগে উঠবে প্রত্যেক মানুষের হৃদয়। অথচ, আজ লেখকদের অবস্থান, চিন্তাচেতনা দেখলে বড়ই কষ্ট লাগে। তবে, জাকির তালুকদারের মতো আমাদের অভিমান ভুলে চিৎকার করে জেগে উঠতে হবে।
এমন ঘোরে মাইকে কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদ মোজাফফর হোসেন কণ্ঠে ভেসে আসে লটারি বিজয়ীদের নাম। ফরিদ কবির তো নিশ্চিত পুরস্কার পাচ্ছেনই। তিনি পুরস্কার পাওয়ার পর বলেন, ‘টাকা দিয়ে সব কিছু কেনা যায়। সাহিত্যের পুরস্কার থেকে লটারির পুরস্কার পর্যন্ত।’ এর প্রতিবাদে নিঝুম শাহর প্রত্যুত্তর।
আসলেই কী আমরা টাকার কাছে সবকিছু বিসর্জন দিচ্ছি—সুখ-শান্তি, চিন্তাচেতনা, আনন্দ। এসব ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল, নিঝুম দ্বীপ থেকে ফেরার পথে ট্রলারে যখন আমার উল্লাসে মেতে ছিলাম, তখন হঠাৎ চোখ আটকে যায় মেঘনা নদীতে একঝাঁক মাছ পানিতে লাফালাফি করছিল। সেই অসাধারণ সুখকর দৃশ্যটি ঈশিতা দেখে বলে, ‘কী সুন্দর, তাই না!’
আবু সাঈদ : লেখক, গবেষক, সম্পাদক ও প্রকাশক